পবিত্র মদিনায় রওজাপাকে যেয়ারত
মহান পবিত্র রবিউল আউয়াল মাস। এ মাসে পবিত্র মদিনায় যেয়ারত নিয়ে আজকের প্রয়াস। পবিত্র মদিনায় গমন করে রওজাপাকে সালাম পেশ করতে পারাটা উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য অতীব সৌভাগ্যের বিষয়। ২০/২৫ বছর আগে সৌদি কর্তৃপক্ষ ও ধর্মীয় বিজ্ঞজন হজ্বযাত্রীগণকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতেন হাজীরা যাতে পবিত্র মদিনায় মসজিদে নববীতে নামাজের নিয়তে যান। সেই সুযোগে যেয়ারত করা যাবে। পরবর্তীতে হয়ত সৌদি কর্তৃপক্ষ বা ধর্মীয় বিজ্ঞজনের মধ্যে নমনীয়তা এসে যায়। পবিত্র মদিনায় যেয়ারতের নিয়তে গমন করা আমাদের হানাফী মাজহাব মতে অতীব গ্রহণযোগ্য বিবেচিত। এই বিষয়ে দেওবন্দ মতাদর্শ এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত তথা সুন্নী মতাদর্শ একমত। কিন্তু আহলে হাদীস তথা সালাফীরা দ্বিমত পোষণ করে থাকেন। যেয়ারতের গুরুত্ব প্রসঙ্গ নিয়ে ১০/১২ টির অধিক হাদীস শরীফে উল্লেখ দেখা যায়।
তিন মসজিদ বাদে অন্য মসজিদের উদ্দেশ্যে সফর না করা বিষয়ে হাদীস শরীফ রয়েছে। তথা মসজিদুল হারম, মসজিদে নববী ও মসজিদুল আকসা। আমাদের হানাফী মাজহাব এ হাদীস শরীফটি যেয়ারতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় বলে বিভিন্ন কিতাবের মাধ্যমে উল্লেখ পাওয়া যায়।
ভারতবর্ষে হাদীস শরীফ দরসের সূচনাকারী দিল্লিতে শায়িত হযরত শেখ আবদুল হক মুহাদ্দেস দেহলভী (রহ.) রচিত “জয্বুল কুলুব ইলা দিয়ারিল মাহ্বুব” এবং সাহারানপুর মাদ্রাসার দীর্ঘ ৬০ বছরের শায়খুল হাদীস হযরত শেখ যকরিয়া (রহ.) রচিত “ফাজায়েলে হজ্ব”এর মদিনা মুনাওয়ারা অধ্যায়ে উল্লেখ পাওয়া যায় যে যেয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করা বিষয়ে।
অপরদিকে নবী পাক (স.)’র ওফাতের পর হযরত বেলাল (র.) দামেস্ক থেকে যেয়ারত করতে আসেন। হযরত বেলাল (র.) কে নবী পাক (স.) স্বপ্ন দেখান। এতে নবী পাক (স.) স্বপ্নে হযরত বেলালকে বলতেছেন, “ইহা কত বড় অবিচার যে, তুমি আমার যেয়ারত করতে আস না।” সেই সময়ে তিনি স্বপ্ন থেকে জাগ্রত হয়ে সিরিয়া থেকে পবিত্র মদিনায় আগমন করেন। রওজাপাকে পৌঁছেন খুব বেশি আহাজারি ও কান্নাকাটি করেন। নিজের চেহারা মাটিতে লুটিয়ে নেন। হযরত ইমাম হাসান (র.) ও হযরত ইমাম হোসাইন (র.)’র আবদার অবজ্ঞা করা সম্ভব নয় বিধায় মসজিদে নববীতে আজান দেন। এতে দীর্ঘ দিন পর হযরত বেলাল (র.)’র আজানের আওয়াজ শুনে মদিনা মুনাওয়ারায় কান্নার রোল পড়ে যায়।
উল্লেখ্য পবিত্র মক্কায় ঈমান আনায় অত্যধিক জুলুমের শিকার হওয়ার মধ্যে হযরত বেলাল (র.) অন্যতম। যেহেতু তিনি ছিলেন কৃতদাস। নবী পাক (স.)’র অতি প্রিয় এ সাহাবা মসজিদে নববীর মুয়াজ্জিন ছিলেন, আজান দিতেন। নবী পাক (স.)’র ওফাতে না দেখার বিরহ ব্যথায় তিনি সিরিয়া চলে যান।
মুসলিম বাহিনী ফিলিস্তিনের জেরুজালেম অবরোধ করে। খ্রিস্টান ধর্মগুরু শর্ত দেন–তিনি জেরুজালেমকে মুসলিম খলিফার নিকট সমর্পণ করতে চান। এতে আমিরুল মোমেনীন ওমর ফারুক (র.) জরুরী বার্তা পেয়ে মদিনা মুনাওয়ারা থেকে জেরুজালেম গমন করেন। তথায় এক বিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব হযরত কাফ আহবার (র.) আমিরুল মোমেনীন হযরত ওমর ফারুক (র.)’র নিকট ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত ওমর (র.) মদিনা প্রত্যাবর্তনের সময় হযরত কাফ (র.) কে বললেন, আপনি কি আমার সাথে মদিনা মুনাওয়ারা যেতে চান? আপনি কি মদিনা মুনাওয়ারা গমন করে রসূল (স.)’র যেয়ারত করার বাসনা রাখেন? তখন হযরত কাফ (র.) বললেন-“আমিরুল মোমেনীন আমি ইহাই করবো।” মদিনা মুনাওয়ারা এসে পৌঁছার পর হযরত ওমর (র.) সর্বপ্রথম যে কাজটি করেন–তাহা ছিল আল্লাহর রাসূল (স.)’র রওজাপাকের যেয়ারত।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ সিরিয়া থেকে পবিত্র মদিনায় বাহক প্রেরণ করনে রওজা পাকে তাঁর পক্ষ থেকে সালাম পৌঁছাতে।
অপরদিকে হজ্ব সংক্রান্ত অসংখ্য পুস্তকে রওজাপাকের যেয়ারতের গুরুত্বের উপর হাদীস শরীফে উল্লেখ করা আছে। যা আহলে হাদীস বা সালাফীরা মানতে রাজি নয়। আজ থেকে প্রায় ৪ শত বছর আগে মহান আশেকে রাসূল হযরত শেখ আবদুল হক মুহাদ্দেস দেহলভী (রহ.) রচিত ‘জজবুল কুলুব ইলা দিয়ারিল মাহবুব’ গ্রন্থেও যেয়ারতের গুরুত্ব নিয়ে বেশকিছু হাদীস শরীফ উল্লেখ করে গেছেন। তার কয়েকটি নিম্নরূপ:
হ “যে ব্যক্তি আমার কবর যেয়ারত করবে, তার নিমিত্তে আমার সুপারিশ অবধারিত।”
হ “যে ব্যক্তি আমার কবর যেয়ারত করবে, তাঁর জন্য আমার সুপারিশ হালাল হবে। তাকে আমার সুপারিশ করতে কোন বাধা থাকবে না।”
হ “যে ব্যক্তি আমার যেয়ারতে আসে, আমার যেয়ারত ব্যতীত এতে তার অন্য কোন উদ্দেশ্য ক্রিয়াশীল হয় না, কিয়ামতের দিন তার জন্য সুপারিশ করা আমার উপর তার হক।”
হ “যে ব্যক্তি হজ্ব করবে এবং আমার মৃত্যুর পর আমার যেয়ারত করবে, সে এমন হবে যেন, সে আমার জীবদ্দশায় আমার সাক্ষাৎ লাভ করল।”
হ “যে ব্যক্তি আমাকে স্বপ্ন দেখেছে, সে সত্যকে প্রদর্শন করেছে।”
হ “যে ব্যক্তি হজ্ব করল এবং আমার যেয়ারত করল না, সে আমার উপর জুুলুম করল।”
হ “যে ব্যক্তি মদিনায় এসে আমার যেয়ারত করবে, আমি তার জন্য সুপারিশকারী ও সাক্ষ্য প্রদানকারী হব।”
হ “যে ব্যক্তি আমার কবর যেয়ারত করবে, আমি তার জন্য সুপারিশকারী এবং সাক্ষী হব।”
হ “যে ব্যক্তি আস্থা স্থাপন করে যেয়ারত করবে, কিয়ামতের দিন সে আমার আশ্রয়ে থাকবে। আর যে ব্যক্তি মক্কা এবং মদিনার কোন এক হেরম শরীফে মৃত্যুবরণ করবে, সে কিয়ামতের দিন আযাব থেকে নিরাপদ থাকবে।”
হ “যে ব্যক্তি ইসলাম নির্দেশিত হজ্ব আদায় করার পর, আমার কবর যেয়ারত এবং ইসলামী জিহাদ করবে, আর বাইতুল মুকাদ্দসে নামাজ পড়বে, আল্লাহ তাআলা তার উপর ফরজকৃত বিষয় সম্পর্কে সওয়াল করবেন না।”
হ “যে ব্যক্তি মক্কা শরীফে গিয়ে হজ্ব আদায় করবে, আর আমার মসজিদে এসে আমার কবর যেয়ারত করবে তার জন্য দুটো হজ্ব মবরূর (কবুল) লেখা হবে।”
হ “যে ব্যক্তি আমার মৃত্যুর পরে আমার যেয়ারত করবে, সে যেন আমার জীবদ্দশায় আমার সাক্ষাৎ করল। আর যে ব্যক্তি আমার যেয়ারত করবে, তার জন্য কিয়ামতের দিন আমার সুপারিশ সুনিশ্চিত। আর উম্মতের মধ্যে যে ব্যক্তির শক্তি সামর্থ থাকা সত্ত্বেও আমার যেয়ারতে আসবে না, তার কোন ওজর আপত্তি থাকতে পারে না।”
হ “যে ব্যক্তি মৃত্যুর পর আমার কবর যেয়ারত করবে, সে যেন আমার জীবদ্দশায় আমার সাক্ষাৎ করল। আর যে ব্যক্তি আমার কবর যেয়ারত করে না, সে আমার উপর জুুলুম করল।”
হ “যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার নিকট নবী পাক (স.)’র উচ্চ মর্যাদা এবং ওয়াছিলা দান করার জন্য দরখাস্ত করবে, তার জন্য কিয়ামতের দিন তার সুপারিশ অবধারিত। আর যে ব্যক্তি নবী পাক (স.)’র কবর যেয়ারত করবে, সে নবী পাক (স.)’র প্রতিবেশী হিসাবে থাকবে।”
বর্তমানকালে পবিত্র মদিনায় লাখ লাখ যেয়ারতকারীর সমাগম। সে লক্ষে মসজিদে নববীতে থাকে সমাগম। বাদশাহ আবদুল্লাহর আমল থেকে রওজাপাকে সালাম পেশ করতে রাত দিন ২৪ ঘন্টা খোলা। জন্নাতুল বাকী হেতু অপর তিন দিকে শতাধিক ১৫/২০ তলায় স্টার মানের হোটেলসমূহে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত লক্ষাধিক যেয়ারতকারীর অবস্থান। লাখ লাখ যেয়ারতকারীর সমাগমে পবিত্র পবিত্র মদিনায় থাকে এক নূরানী পরিবেশ।
এ যেন প্রিয় রাসূল (স.)’র সান্নিধ্যে তাঁর অতি স্নেহভাজন উম্মতরা অবস্থানে আছেন সালাম পেশ করে ধন্য হতে, হৃদয়ে প্রশান্তি লাভ করতে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট