বৈচিত্র্যে চট্টগ্রাম

ড. ওবায়দুল করিম, সমাজবিজ্ঞানী | বৃহস্পতিবার , ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ১১:৩৩ পূর্বাহ্ণ

প্রাচীন ও মধ্যযুগে ভারতবর্ষে নগর গড়ে উঠেছিলো, তিনটি কারণে। প্রথমটি তীর্থ স্থানকে কেন্দ্র করে, যেমন গয়া, কাশী, আজমীর, দ্বিতীয়টি বাণিজ্যকে লক্ষ্য করে, যেমন বোম্বে, কলকাতা, এবং তৃতীয়টি সেনাছাউনীকে কেন্দ্র করে যেমন দিল্লী। ভারতবর্ষের বাইরে তীর্থস্থানকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শহর হচ্ছে যেমন মক্কা, ভ্যাটিকান সিটি, বাণিজ্যকে কেন্দ্রে করে জেদ্দা, নিউ ইয়র্ক ইত্যাদি। আর আমাদের প্রিয় বাংলাদেশে এই তিন বৈশিষ্ট্য নিয়ে গড়ে ওঠা শহর হচ্ছে চট্টগ্রাম। বার আউলিয়া ও মাইজভাণ্ডার শরীফের তীর্থ স্থান, বন্দরকে কেন্দ্র করে বাণিজ্য নগরী, আর যোগাযোগ ও সেনাছাউনীর গুরুত্ব তো আছেই। এই তিন বৈশিষ্ট্যের কারণে চট্টগ্রাম জেলা, বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম নগরের সম্ভাবনার দিকগুলো কি হতে পারে, দেখা যাক।

নগর শুধুমাত্র কতক স্থাপনা নয়। একটি ভৌগোলিক এলাকা নির্ধারণ করে। আর কিছু জনসমষ্টি। তাঁদের মিথষ্ক্রিয়া আর নগরে বাস করবার নাগরিক বোধ বা ঈরারপ ঝবহংবং বা নাগরিকত্ববোধ।

ভৌগলিক বিবেচনায় এই ভারতবর্ষে, চট্টগ্রামের অবস্থান অনন্য। ভারতের সাংস্কৃতিক মিশেল ভারতের পশ্চিমে বা আর্যাবর্তের পশ্চিমে যেমনটি হয়েছে, চট্টগ্রাম এর ব্যতিক্রম ছিলো। খাইবার গিরিপথ দিয়ে শক, হুন, পাঠান, তুর্কী, মোঘলদের আক্রমণ ভারতের পশ্চিমে সংস্কৃতির যে আদল দিয়েছে, চট্টগ্রামে এর প্রভাব ছিলো, মাত্রায় কম। কারণ চট্টগ্রাম কখনোই ভারত শাসনে পরিবর্তনের করিডোর হয়নি। ফলে এখনকার সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক আবহ চট্টগ্রামকে অনন্য মাত্রায় নিয়ে যায়। দিল্লী যেমন, সেনা ছাউনিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিলো, তেমনটি হয়নি, চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে, যদিও এখন সেনানিবাস এখানেও বর্তমান।

চট্টগ্রাম সুলতানী বা মোঘল শাসনের বাইরেও ছিলো বেশ কিছুকাল। চট্টগ্রামের সান্নিধ্যে ছিলো আরাকান ও রাখাইনদের সাথে। চট্টগ্রামে শাসনের জায়গায়, ইসলামের প্রচার হয়েছে মূলত ধর্মীয় সাধক ও বণিকদের মাধ্যমে, এঁদের মাঝে সুফী মতাদর্শীরাও ছিলেন। এঁদের সমাধি ধর্মীয় চেতনাকে নির্ভর করে চট্টগ্রামকে এক তীর্থস্থানে পরিণত করে। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির মাইজভাণ্ডার শরীফ এর ওরশ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এ মতের অনুসারীদের আগমন; তীর্থস্থানকে কেন্দ্র করে বৃহত্তর চট্টগ্রামের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে জানান দেয়।

নগর গড়ে উঠবার জন্য ভৌগোলিক অবস্থানের আনুকূল্য বেশ প্রয়োজন। চট্টগ্রামের তা আছে। সমুদ্র, পাহাড় ও উত্তরদক্ষিণের লম্বাদ্রি ভূমি চট্টগ্রামের নগর, মহানগর ও কসমোপলিটন নগর হয়ে উঠবার সম্ভাবনাকে তৈরি করেছে। শুধুমাত্র প্রয়োজন কর্তৃপক্ষের এই বোধের গোড়ায় জলসিঞ্চনের।

ভৌগোলিকভাবে চট্টগ্রাম, দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সাথে দক্ষিণ এশিয়ার করিডোর। মিয়ানমারের অশান্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমাদের দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সাথে এবং ASEAN এর সামাজিক, অর্থনীতিক বিকিরণ থেকে দূরে রেখেছে। একথা কে না জানে, একক উন্নয়নের ধারণা খুব কাজের নয়। উন্নয়ন হচ্ছে গুচ্ছবদ্ধ ধারণা। ইউরোপের উন্নয়ন সীমান্তের দেশগুলোকে সাথে নিয়েই হয়েছে। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় সন্নিহিত সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স মূলত গুচ্ছবদ্ধ বা Cluster Development এর ফল। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, হংকং ও গুচ্ছ উন্নয়নের সাক্ষী। Chattogram, দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ASEAN এর সহযাত্রী হতে পারতো বা পারে।

চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুরের চেয়ে কম সুন্দর নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রেই বেশি। এই ল্যান্ডস্কেপকে পর্যটন ও ইকোট্যুরিজম শিল্পে রূপান্তরের সম্ভাবনা এই চট্টগ্রামেই সবচেয়ে বেশি। মূল্যবোধ ও বিশ্বাস এবং সাংস্কৃতিক বাধা এর প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে যার সংস্কার দরকার।

সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রগুলোকে ব্যবহারের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ব্যবহার করতে না পারা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।

প্রকৃতি পর্যটনের মূল রসদ। শিবালিক রেঞ্জের অংশ রামগড় থেকে চট্টগ্রামের শহরতক পাহাড় পর্যটনকে এক বিশেষ মাত্রায় নিয়ে যেতে পারে। মালয়েশিয়ার গেন্টিং হাইল্যান্ড এর মতো বিশাল পর্যটন স্থাপনা হতে পারে এখানে। ইতোমধ্যে সীতাকুণ্ডের ইকোপার্ক এবং মীর সরাই এলাকার জলপ্রপাত ও কৃত্রিম লেক কিছুটা বিনোদনের সুযোগ করে দিলেও, পুরো সম্ভাবনাকে আমরা এখনও ব্যবহার করতে পারিনি। মনে রাখা দরকার এই অঞ্চলের বনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা যেমন প্রয়োজন ঠিক তেমনি একে পরিবেশ শিল্পে রূপান্তর করাও দরকার। পৃথিবীতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে শিল্পের সব খাতকে ছাড়িয়ে, পর্যটন বড় নির্ভরযোগ্য খাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুবাই তার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। তেল নয়, পর্যটন হয়ে উঠছে দুবাইয়ের অর্থনীতির প্রাণ।

বৃহত্তর চট্টগ্রামের কথা যদি বলি, তাহলে চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সম্ভাবনা বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে অবশ্যই এগিয়ে থাকবে। বাঁশখালীর ইকোপার্ক, চুনতির বনাঞ্চল, কক্সবাজারের গেম রিজার্ভ এর মতো পরিবেশকে সংরক্ষণ করে ইকোট্যুরিজম গড়ে তোলা যায়। ডুলাহাজরা বঙ্গবন্ধু সাফারী পার্ক যেমনটি আমাদের পর্যটন খাতকে বিস্তৃত করেছে, চট্টগ্রামের অন্যান্য অংশকেও এমন পর্যটনের অংশ করা যায়।

চট্টগ্রামকে বাংলাদেশের গেটওয়ে বললে অত্যুক্তি হবে না। বন্দর সে সম্ভাবনা আগেই দেখিয়েছে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী টানেল, সাংহাই মডেলে নদীর দুই পাশেই শহর ও অন্যান্য বাণিজ্যিক স্থাপনা গড়ে তুলবার সুযোগ করে দিয়েছে। এমনকি প্রয়োজন হলে আর বড় আকারের বিমান বন্দর গড়ে তোলা যায়, বিশেষ করে বর্তমান হযরত শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এর সামর্থ্যের দিক বিবেচনা করলে; চট্টগ্রাম বিমানবন্দর বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের জন্য কমিউনিকেশন হাবও হতে পারে।

পশ্চিম গোলার্ধের বিভিন্ন জায়গা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন পূর্বমুখী বিমান ওয়ে পয়েন্ট হিসেবে চট্টগ্রামকে ছুঁয়ে যায়। শুধু তাই নয়, দক্ষিণ থেকে উত্তরে উড়ে যাওয়া বিমানও চট্টগ্রামের আকাশকে ব্যবহার করতে হয়। এই গুরুত্ব ভবিষ্যতে আরো বাড়বে। এক্ষুণি, একটি আধুনিক আন্তর্জাতিক বিমাবন্দর নিয়ে চিন্তার বিস্তারের প্রয়োজন। সময়ের আগে চলতে শেখা খুবই জরুরি।

চট্টগ্রামকে নিয়ে বৃহত্তর উন্নয়ন পরিকল্পনায় সন্দ্বীপ, হাতিয়া ও নিঝুম দ্বীপকেও অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। চট্টগ্রামের কুমিরা থেকে ফেরী সার্ভিসকে আরো ভালোভাবে সচল করে, সন্দ্বীপকেও মালয়েশিয়ার পেনাং এর মত দীর্ঘ মেয়াদে গড়ে তোলা যায়। দক্ষিণে সেন্টমার্টিন দ্বীপকেও উন্নয়ন পরিকল্পনায় আনা প্রয়োজন।

চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে কিছুটা পৃথক। এই বৈচিত্র্য ধরে রাখতে হবে। সাম্পান, মেজবান ইত্যাদি তার বৈশিষ্ট্য। উল্লেখযোগ্য যে বলা হয়, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, জীব বৈচিত্র্যকে রক্ষা করে আবার জীব বৈচিত্র্য সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে রক্ষা করে। গ্রীন ফরেস্ট বা রেইন ফরেস্ট বলতে চট্টগ্রামকে সামনে নিয়ে আসে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক প্রকৃতি থেকেও চট্টগ্রামের ভৌগোলিক প্রকৃতি কিছুটা ভিন্ন।

এই দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশে হচ্ছে ভূপ্রকৃতিতে নিম্নাঞ্চল বা বেসিন রিজিয়ন। এই কারণে উত্তরপশ্চিম ও উত্তর থেকে প্রবাহিত প্রায় নদ বা নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। এই ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম অঞ্চল ব্যতিক্রম। এই অঞ্চল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কিছুটা উঁচু। ফলে সমুদ্রের পানির স্তর বাড়লে বাংলাদেশের কিছু অঞ্চল পানির নিচে তলিয়ে গেলেও চট্টগ্রামের এই সম্ভাবনা নেই। এই জন্য চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য পরিকল্পনা যথার্থই টেকসই হতে পারে।

চট্টগ্রামে একটি জাতিতাত্ত্বিক যাদুঘর আছে। এতে চট্টগ্রামের জনজীবনের সাংস্কৃতিক জীবনাচারের পরিবেশনা নেই। একটি বিশেষায়িত যাদুঘর প্রয়োজন, চট্টগ্রামের জন্য, জাতিতাত্ত্বিক পরিবেশনার সাথে সাথে, প্রাচীন ইতিহাস, স্থাপত্য ইত্যাদি দেখবার ব্যবস্থাও থাকতে পারে।

কর্ণফুলীকে কেন্দ্র করে কোন রিভার ক্রুজিং এর বন্দোবস্ত নেই। অথচ শহরে এইটি হচ্ছে বিনোদনের প্রাণ। এখনো নেই নদীর পাশ ঘিরে ড্রাইভিং এর ব্যবস্থা। চট্টগ্রাম থেকে সাগরের পাশ দিয়ে যথাদ্রুত সময়ে মেরিন ড্রাইভকে মীর সরাই পর্যন্ত বিস্তৃত করা দরকার।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে EPZ বা Export Processing Zone এর ভূমিকা জ্ঞাত। খাদ্যের পরের চাহিদা শিক্ষা। শিক্ষা ছাড়া উন্নয়ন একেবারেই অসম্ভব। EPZ এর মতো Special Education Zone করা যেতে পারে, চট্টগ্রামে। সরকার সমস্ত ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরি করে দিবে এবং পৃথিবীর তাবৎ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এ সুযোগে নামমাত্র ভাড়ায় উচ্চশিক্ষার কার্যক্রম চালু রাখতে পারে। চট্টগ্রাম এই শিক্ষা ও অর্থনৈতিক কাজে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। যোগাযোগ ও দূষণমুক্ত পরিবেশ ও নান্দনিক পরিবেশের জন্য চট্টগ্রাম এক আদর্শ স্থান আর এই কারণে শিক্ষার সমপ্রসারণে চট্টগ্রামকে এডুকেশন হাব হিসেবেও বিবেচনা করা যেতে পারে।

শহর শুধু তীর্থস্থান, সেনা ছাউনি বা বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে তা নয়। এখনকার নগরবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, শিক্ষালয়কে কেন্দ্র করেও গড়ে উঠতে পারে নগর। আমাদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে হাটহাজারী শহরের বেড়ে ওঠা নিয়ে এক গবেষণার প্রয়োজন। এবং এইটি নিশ্চিত এই পুরোনো শহরকে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা থাকবেই।

চট্টগ্রাম, উত্তরদক্ষিণে বিস্তৃত বিশাল জেলা। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, কোনো সাংস্কৃতিক কেন্দ্র থেকে প্রায় পনেরো মাইলের পরে ঐ কেন্দ্রের সংস্কৃতি পরিবর্তিত হয়। এইটি লাগোয়া জায়গার সংস্কৃতির প্রভাবে হয়। ফলে টেকনাফ থেকে মীরসরাই পর্যন্ত সংস্কৃতি, ভাষার পরিবর্তন বেশ লক্ষণীয়। এই বৈচিত্র্য অন্য জেলাগুলোতে কম। চট্টগ্রামের এই সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য চট্টগ্রামকে এক বিশেষ মর্যাদায় আসীন করেছে।

চট্টগ্রাম, এই শহর একটি প্রাচ্যের নান্দনিক ও জীবনের সামগ্রিক বিবেচনায় একটি আধুনিক মেগাসিটি হতে পারে তবে এর জন্য চাই উদ্যোগ।

লেখক : সমাজবিজ্ঞানী, উপাচার্য, চট্টগ্রাম বি জি এম ই এ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন এন্ড টেকনোলজি, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদৈনিক আজাদী ও ড. মুহাম্মদ ইউনূস
পরবর্তী নিবন্ধস্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র আজাদীকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া সময়ের দাবি