শহীদ বুদ্ধিজীবী রায় সাহেব কামিনীকুমার ঘোষ

মোয়াজ্জেম হোসেন | বৃহস্পতিবার , ২৫ জুলাই, ২০২৪ at ১১:৩০ পূর্বাহ্ণ

ভারত বর্ষের নবমদশম শতাব্দীতে রাজা ছিলেন বিশ্বশৃঙ্গ সরকার। তখন কাঞ্চনা তৎপুত্র কাঞ্চন সরকারের রাজ শাসনের অধীনে ছিল। কাঞ্চন সরকারের নামের মিল রেখে এই স্থানের কাঞ্চনা নামকরণ হয় বলে ইতিহাস গবেষক অধ্যাপক ড. আহমদ শরীফ তার ‘চট্টগ্রামের ইতিহাস’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন। ইতিহাস সমৃদ্ধ কাঞ্চনা প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টি। পাহাড়, পর্বত, সবুজ ভুমির রূপ বৈচিত্র্যময় কাঞ্চনাকে আরো ঐতিহ্যমণ্ডিত করেছে। এই কাঞ্চনায় জন্মগ্রহণ করেছেন অনেক ক্ষণজন্মা শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, আলেমওলামা, আধ্যাত্মিক সাধক, সাহিত্য ও সংস্কৃতিসেবী।

আলো জ্বেলে আলোকিত করার এই বাসনায় বাংলাদেশ স্বাধীনের আগে কিংবা ভারতীয় উপমহাদেশেরও আগে এই তল্লাটে গুণীজনরা আমাদের এই সময়কার ইতিহাসকে ঋদ্ধ করেছেন অকাতরে। বর্তমান সময়ে এসে যার সুফল আমরা ভোগ করছি কিংবা উপভোগ করছে অনিন্দ্যসুন্দর পসরা যার আদি আগেই সবুজ বাংলার শ্যামল প্রান্তর কাঞ্চনা। যাদের পদচারণায় মুখরিত জনপদের সংখ্যা সংখ্যাতীত। তেমনি এক আলোকিত মানুষ শহীদ বুদ্ধিজীবী রায়সাহেব কামিনী কুমার ঘোষ। যিনি ইতিহাসের বহু সন্ধিক্ষণের সাক্ষী। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় অভাবনীয় সাফল্য তিনি বিনিয়োগ করেছেন দেশের জন্য। প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ প্রতিষ্ঠা কিংবা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সাথে কামিনী কুমার ঘোষের নাম ওতপ্রোতভাবে লেগে আছে। প্রান্তিক জনপদে উনার ছোঁয়ায় বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে আমূল পরিবর্তিত হচ্ছিল কাঞ্চনা। যার পুরোধা এই বরেণ্য শিক্ষাবিদ। গ্রামের মানুষকে আলোকিত করার মহান ব্রত নিয়ে জনপদ আলোকিত করা এই ক্ষণজন্মার উদ্দেশ্য ছিল বিশালাকার। তাই, আমরা দেখতে পায় একের পর একে শিক্ষালয় স্থাপনের সাথে নিজেকে সংযুক্ত করে একটা জনপদের অগণিত মানুষকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার মহান দায়িত্বে তিনি ছিলেন সদা বিরামহীন।

কামিনীকুমার ঘোষ ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দের ১লা জানুয়ারি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার কাঞ্চনা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতাচৈতন্য চরণ ঘোষ, মাতাকমলা ঘোষ। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষায় তিনি বৃত্তিসহ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তিনি ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে গণিতে প্রথম শ্রেণিতে বৃত্তি নিয়ে অনার্স পাস করেন। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আইন বিষয়ে বৃত্তিসহ উত্তীর্ণ হন। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা থেকে ফিরে তিনি তার চাচা বঙ্গচন্দ্র ঘোষের সাথে আইন পেশায় নিযুক্ত হন। তিনি বিয়ে করেছিলেন বাঁশখালী উপজেলার পালেগ্রাম চৌধুরী বাড়ির কন্যা শৈলবালাকে। ব্যক্তিগত ভাবে তিনি ১১ সন্তানের জনক ছিলেন।

১৯২১ খ্রিস্টাব্দে তিনি মহাত্মা গান্ধীর ভারত শাসন আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে আইন পেশা ছেড়ে দেন এবং আন্দোলনে সর্বাত্মক ভাবে জড়িয়ে যান। অনেকের মতে তিনি ছিলেন চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলের শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম নায়ক।

তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনামলে সাতকানিয়াতে ছিল মাত্র হাতে গোনা কতগুলো প্রাথমিক বিদ্যালয়। চট্টগ্রামের শিক্ষা ব্যবস্থার এই শূন্যতা অনুধাবন করে তিনি উদ্যোগ নেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার। তিনি গ্রামবাসীদের সহযোগিতায় শুরু করেন এস বি ঘোষ ইনস্টিটিউট (উচ্চ বিদ্যালয়) এবং এলাকাবাসীর স্বাস্থ্যসেবার জন্য একটি হাসপাতাল। সাতকানিয়াবাশঁখালী এডুকেশন সোসাইটি গঠন করে তিনি গ্রামে গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নেন। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে সঙ্গীদের সহযোগিতায় তিনি স্থাপন করেছিলেন আমিলাইষকাঞ্চনা বঙ্গচন্দ্র ঘোষ নামে একটি ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয়। স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য জমি দান করেছিলেন কাকা বঙ্গচন্দ্র। পরে এটি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত সাতকানিয়া সরকারি কলেজর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ছিলেন কামিনীকুমার। যা এখন দক্ষিণ চট্টগ্রামের একটি স্বনামধন্য সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

কামিনীর সমাজসেবামূলক ও শিক্ষা প্রসারণমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য ব্রিটিশ সরকার তাকে রায় সাহেব খেতাবে ভূষিত করেন। তিনি ২৮ বছর চট্টগ্রামের জেলা পরিষদের সদস্য এবং সাত বছর সভাপতি ছিলেন। ১৬ বছর তিনি চট্টগ্রাম জেলা স্কুল বোর্ডের সদস্য, কাঞ্চনার (কাঞ্চনা, ডলুকূল, আমিলাইষ) নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট, বেঞ্চ কোর্টের সভাপতিসহ বিভিন্ন গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৪ এপ্রিল শনিবার বেলা ১২টায় পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী দোহাজারী ক্যাম্প থেকে কাঞ্চনায় আক্রমণ চালায়। হানাদার বাহিনী কামিনী কুমারের বাড়িতে আক্রমণ করলে বাড়ির লোকজন বৃদ্ধ কামিনী কুমারকে বাড়ির শৌচাগারে লুকিয়ে রাখে, পরবর্তীতে কামিনী কুমার ঘোষ শৌচাগার থেকে বেরিয়ে বাড়িতে যাওয়ার পথে এক রাজাকার তাকে সনাক্ত করে এবং হানাদার বাহিনী গুলি করে তাকে হত্যা করে। তাকে এভাবে নির্মমভাবে হত্যা সেদিন শুধু কাঞ্চনাবাসী নয়, পুরো সাতকানিয়াবাসীকে ব্যতিত করে। তিনি যে আলোর মশাল জ্বেলেছিলেন, সে আলোয় আলোকিত হয়েছে পুরো সাতকানিয়া। তার ছোঁয়া ও দেখানো পথে অনেক খ্যাতিমান মানুষ জন্ম নিয়েছে এই জনপদে। তিনি ছিলেন সত্যিকারের সফল এক আলোর পথের যাত্রী। একজন অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি।

লেখক: প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধনিমগ্নতা
পরবর্তী নিবন্ধউচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে আধুনিক কৃষি ব্যবস্থাপনা বিভাগ চালু করা দরকার