একজন সন্তান হিসেবে নিজের জন্মদাতা পিতাকে মূল্যায়ন করা বড়ই কঠিন– আর যদি সে পিতা হন দেশ মাতৃকার স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সংগঠক তাহলে এটা আরোও জটিল। মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশের অনেক বড় নেতা তৎকালীন এমপি মন্ত্রী বা তাদের পরিবারের ছেলেমেয়েরা অংশ নিলেও –একমাত্র আমার পিতার বড় সন্তান পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন। আমার বাবা মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরীর মৃত্যুর পর জাতীয় সংসদে শোক প্রস্তাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান–মরহুম চৌধুরীর সততা ও দেশপ্রেমের বর্ণনার পাশাপাশি, মহান মুক্তিযুদ্ধে তার সন্তান শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরীর দেশের জন্য বলিদানের কথা শ্রদ্ধার সাথে তুলে ধরেন। আজ ১ জুলাই–আমার বাবা মহান মুক্তিযুদ্ধে দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলীয় লিবারেশন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহকর্মী সাবেক মন্ত্রী মরহুম জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর ৫১তম মৃত্যুবার্ষিকী, স্বভাবিকভাবেই এসময়টাতে আমি একটু স্মৃতিকাতর থাকি ।
দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপট তৈরীতে এই জনপদে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহকর্মী ও আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন একজন সংগঠক হওয়ায় তিনি ছিলেন খুব ব্যস্ত একজন মানুষ, সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মী। সংসার, পরিবার, জাগতিক মোহ, বৈষয়িক বিষয়ে তিনি কখনো আগ্রহী ছিলেন না। সে হিসেবে সন্তান হিসেবে তাকে খুব কম পেতাম, তার স্নেহ আদর, সময়টার বেশীর ভাগ বরাদ্দ ছিলো সংগঠন ও দেশের জন্য। পরিবারের কোনো সমস্যা বা কিছু চাইলেই তিনি উদাস হয়ে বলতেন–দেশের মানুষ কষ্টে আছে, দেশের মানুষের অভাব দূর করতে আর কল্যাণের জন্য তিনি মন্ত্রী হয়েছেন, আমাদের জন্য না।
বাবাকে নিয়ে তাই আমার অনেক সীমিত স্মৃতি, প্রাপ্ত বয়স্ক হবার পরও তার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতাম না। একটা কথা খুব মনে পড়ে, দেশের জন্য তার মমত্ববোধের এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় প্রমাণ। মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিকে এপ্রিলের ১৩ তারিখ তার বড় সন্তান, আমার অগ্রজ শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী রাউজান পাহাড়তলী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সামনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে সম্মুখসমরে শাহাদাত বরণ করেন, এটা আমার বাবা জানতেন না। বাবা তখন মুক্তিবাহিনীর সাউথইস্ট জোনের যুদ্ধ পরিচালনা করছেন –দেশে থাকা পরিবারের খবর নেওয়ার সময় নাই। ভাই এর শহীদ হওয়ার পর আমি কিছুদিন পর মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং শেষ করে মুক্তাঞ্চল –মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে বাবার সাথে দেখা করতে যাই। বাবা আমাকে দেখেই জিজ্ঞেস করলেন, “সাইফুদ্দিন কই, কি করে?” আমি একটু হতচকিত হয়ে বললাম, কক্সবাজার ফ্রন্টে মুক্তি বাহিনীর হয়ে পাক হানাদারদের সাথে সে যুদ্ধ করছে। বাবা কিছু সময় চুপ থেকে বললেন, আমার ছেলে পাক হানাদার এর হাতে যুদ্ধ করতে গিয়ে শহীদ হয়ে গিয়েছে, তোমরা আমাকে মিথ্যা বলবে না– বলে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলেন, পরক্ষণে বললেন, যাও আমি দেশ মাতৃকার স্বাধীনতার জন্য আমার বড় ছেলেকে উৎসর্গ করলাম।
সেই সময়ে তার দৃঢ়তা, দেশপ্রেম ও সন্তানের প্রতি মমত্ববোধ, বিয়োগের কষ্টের যে আবেগঘন পরিবেশ, তা আমি কখনো ভুলতে পারবো না। আমার বাবা মরহুম জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরী নিজের সন্তান, পরিবার তাদের ভবিষ্যৎ – সহায় সম্পদ এসবের কথা ভাবতেন না। তার ধ্যান ব্রত আর স্বপ্ন ছিল আওয়ামিলীগ সংগঠন ও পূর্ব পাকিস্তানের দুঃশাসন শোষণ থেকে কিভাবে এদেশের মানুষকে কিভাবে মুক্তি দেওয়া যায়। পাকিস্তান আমল থেকেই –জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, এই অঞ্চলে রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগের বিকাশে যে কয়জনকে প্রাথমিক অবস্থায় পেয়েছিলেন তাদের অন্যতম মরহুম এম,এ আজিজ, আমার বাবা মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরী।
২৫শে মার্চ রাতে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীনতার ঘোষণা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সর্বপ্রথম টেলিফোন যোগে আমাদের দামপাড়া পল্টন রোডের বাসভবনে পৌঁছান। পরবর্তীতে এই বার্তা এম এ হান্নান মারফত রেডিওতে প্রচার হয়। মরহুম জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরী এই বিশ্বাসকে খুবই গুরুত্ব দিতেন – দিনমান তিনি মেতে থাকতেন রাজনৈতিক কর্মকান্ডে, সাংগঠনিক কাজে। দেশের সম্পদ, রাষ্ট্রের আমানত আর মন্ত্রী তত কে তিনি কখনো নিজের বা পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে দেখেননি। সততা, রাষ্ট্র ও দেশের প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ–একজন রাজনৈতিক নেতার মূল চারিত্রিক গুণ হওয়া বাঞ্ছনীয় আমার বাবা মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরী কঠিনভাবে লালন করতেন ।
আজকাল অনেককেই দেখি– দেশের নেতা জনপ্রতিনিধি বা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কোনো দায়িত্ব পেলে তার লাইফস্টাইল বদলে যায়–তার দুই/তিন পুরুষ কিছু করার চিন্তা করতে হয়না অথচ শুধু আমার বাবা নয় সেই সময়কার বাবার সাথে থাকা বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রী সভার অনেক সদস্য পরবর্তীতে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা দুরের কথা মানবেতর জীবন কাটিয়েছেন। দেশপ্রেম সততা ও দায়িত্ববোধের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমার বাবা জহুর আহমদ চৌধুরী। তিনি তার পরিবার সন্তানদের জন্য বিশাল মিল ফেক্টরী জমি জমা নগদ টাকা রেখে যেতে পারেননি অথচ তার সেই সুযোগ ছিলো তিনি ছিলেন পাকিস্তান আমলের এমপি এবং স্বাধীন বাংলাদেশে শ্রম, পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রী, স্বাস্থ্য, সমাজকল্যাণ মন্ত্রী, কিন্তু তারপরও তিনি চাননি তার সন্তানরা কোনো ব্যবসা বাণিজ্য বা রাষ্ট্রীয় সুবিধা নিক। তিনি যখন মন্ত্রী – আমি নিজেও তরুণ, জীবন–জীবিকার জন্য ব্যবসা বাণিজ্য করার চেষ্টা করছিলাম, যতবারই বলতাম বিভিন্ন কাজে, তিনি গমভীরভাবে বলে উঠতেন, আমি তোমাদের ভাই বোন পরিবারের জন্য মন্ত্রী হই নাই, পুরো দেশের মানুষের দায়িত্ব আমার । পাকিস্তান ৯ মাস যুদ্ধ করে তান্ডব চালিয়ে এদেশকে ধ্বংস করে ফেলেছে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করে আমাকে দেশ গঠনে দায়িত্ব দিয়েছেন –এ বিশ্বাস আমানত রক্ষা করতে হবে।
তাঁর সততার সবচেয়ে বড় প্রমাণ তিনি চট্টগ্রাম শহরের দামপাড়া পল্টন রোডে যে বাড়ীতে বসবাস করতেন ঐতিহাসিক ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত আমাদের এই বাড়িটি আমার রত্নগর্ভ মা শহীদ জননী মরহুমা জাহানারা বেগমের পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত। দেশের ৪ টি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়েরর দায়িত্বে থাকা একজন মন্ত্রী তার মৃত্যুর পর পরিবারের জন্য একখন্ড জমি বা নগদ ২০০০ টাকাও রেখে যেতে পারেননি – এটা অন্তত তার সন্তান হিসেবে আমাদের জন্য মর্যাদার, একজন দেশপ্রেমিক সৎ রাজনৈতিক নেতার পুত্র হিসেবে এটাই আমার জীবনের অহংকার
দেশ স্বাধীনের আগে তিনি চট্টগ্রামসহ বৃহত্তর কুমিল্লা নোয়াখালী, কক্সবাজারসহ বৃহত্তর অঞ্চলে সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম ও একই সাথে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কর্মকান্ডে সারাদিন কর্মব্যস্ত থাকতেন, মূলত তিনি দামপাড়ার বাসায় থাকতেন না– তার রাজনৈতিক কার্যালয় ছিল স্টেশন রোডের পর্যটন মোটেল–সারাদিন তিনি নেতাকর্মীদের সাংগঠনিক দিক নির্দেশনায় ব্যস্ত থাকতেন। আমরা ভাই বোনেরা তাকে খুব কম সময়ের জন্য পেতাম, রাতে যখন বাসায় আসতেন আমরা তখন ঘুম। দায়িত্ব পালনে তিনি কখনো আবেগকে প্রশ্রয় দিতেন না। সন্তান হিসেবে বা পরিবারের অন্য সদস্যদের তিনি সময় দিতে পারতেন না, বৈষয়িক ছিলেন না ।
তাঁর মৃত্যুর তার কোটের পকেটে মাত্র ১২০০ টাকা পেয়েছিলাম, এটাই ছিল তার সঞ্চয় বা আমাদের জন্য রেখে যাওয়া সম্পদ। আমি গর্বিত আমি একজন স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী, সৎ, দেশপ্রেমিক আদর্শবান রাজনীতিবিদের সন্তান।
সততা ও দেশপ্রেম একজন রাজনৈতিক নেতা বা কর্মীর মূল সম্পদ, সেই সূত্রে আমার বাবা মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরী আমাদের এই সম্পদ দিয়ে ঋণী ও সমৃদ্ধ করে গিয়েছেন। মহান আল্লাহ আমার পিতা, জনতার নেতা মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরীকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করুন। আমিন।
লেখক; বীর মুক্তিযোদ্ধা, সভাপতি, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ ও মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরীর ২য় সন্তান