নতুন অর্থবছরের জন্য সরকারের ব্যয় অনুমোদন করেছে জাতীয় সংসদ। গতকাল রোববার সংসদে ২০২৪–২৫ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার এই বাজেট অনুমোদন করা হয়। এদিন সকাল ১১টায় স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের অধিবেশন শুরু হয়। অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী নির্দিষ্টকরণ বিল, ২০২৪ সংসদে উপস্থাপন করলে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়। এর আগে শনিবার সংসদে পাস হয় অর্থবিল। ১ জুলাই থেকে এ বাজেট কার্যকর হবে। এর আগে রাষ্ট্রপতির সম্মতি সাপেক্ষে নির্দিষ্টকরণ আইন গেজেট আকারে প্রকাশিত হবে। খবর বিডিনিউজের।
গত ৬ জুন ‘টেকসই উন্নয়নের পরিক্রমায় স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রা’ শিরোনামে এ বাজেট সংসদে উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী। সংসদ সদস্যদের ১১ দিনের আলোচনা শেষে তা পাস হলো। গত বছর বাজেট দিতে গিয়ে ‘স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে’ যাত্রার সংকল্প করেছিলেন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল। তবে ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বদলে যাওয়া বিশ্ব বাজার, ডলার সংকট আর মূল্যস্ফীতি সেই যাত্রাকে কঠিন করে তুলেছে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার দুই বছর আগে যে কৃচ্ছ্রের পথে হাঁটতে শুরু করেছিল, সেই অবস্থান বদলে সাহসী হওয়ার সুযোগ ঘটেনি নতুন অর্থমন্ত্রী মাহমুদ আলীর জন্য। তার মধ্যেই বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডারে স্বস্তি আনার চেষ্টায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ঋণ নিতে গিয়ে আর্থিক খাতের নানামুখী সংস্কারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে হচ্ছে।
স্মার্ট বাংলাদেশে পৌঁছানোর নির্বাচনী স্লোগানটি আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিতে অটুট আছে। তবে অর্থমন্ত্রী মাহমুদ আলী তার বাজেটে অর্থনীতিকে পথে ফেরানোর ওপরই গুরুত্ব দিচ্ছেন। ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেটে এবার উন্নয়ন ব্যয় ৮.২৫ শতাংশ বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮১ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ২ লাখ ৬৫ হাজার টাকা, যা আগেই অনুমোদন করা হয়।
বাজেটে রাজস্ব খাতে আয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। এই অংক বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত রাজস্ব আয়ের ১৩.১৮ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে কর হিসেবে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা আদায় করা যাবে বলে আশা করছেন মাহমুদ আলী। ফলে এনবিআরের কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে ১৭ শতাংশের বেশি। টাকার ওই অংক মোট বাজেটের ৬০ শতাংশের মতো।
গতবারের মতো এবারও সবচেয়ে বেশি কর আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট থেকে, ১ লাখ ৮২ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা। এই অংক বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৫.৬৩ শতাংশ বেশি। বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে ভ্যাট থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা ছিল ১ লাখ ৬৩ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা। সংশোধনে তা বাড়িয়ে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৬৬ কোটি টাকা করা হয়।
আয়কর ও মুনাফার উপর কর থেকে ১ লাখ ৭৫ হাজার ৬২০ কোটি টাকা রাজস্ব পাওয়ার আশা করা হয়েছে এবারের বাজেটে। বিদায়ী সংশোধিত বাজেটে এর পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা। নতুন বাজেটে আমদানি শুল্ক থেকে ৪৯ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা, সম্পূরক শুল্ক থেকে ৬৪ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা, রপ্তানি শুল্ক থেকে ৭০ কোটি টাকা, আবগারি শুল্ক থেকে ৫ হাজার ৮০৫ কোটি টাকা এবং অন্যান্য কর ও শুল্ক থেকে ১ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা আদায়ের পরিকল্পনা করেছেন অর্থমন্ত্রী। এছাড়া বিদেশি অনুদান থেকে ৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা পাওয়া যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন।
বরাবরের মতোই বাজেট ঘাটতি পূরণে অর্থমন্ত্রীকে নির্ভর করতে হবে অভ্যন্তরীণ এবং বিদেশি ঋণের ওপর। মাহমুদ আলী আশা করছেন, বিদেশ থেকে ১ লাখ ২৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ঋণ করে ওই ঘাটতি তিনি মেটাবেন। অভ্যন্তরীণ খাতের মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে রেকর্ড ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে আরও ৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে বাজেটে।
বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে ৭.৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। ৬ মাসের প্রাক্কলনের ভিত্তিতে অর্থবছর শেষে তা ৫.৮ শতাংশ হবে বলে সরকার ধারণা করছে। আর মে মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯.৮৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অর্থমন্ত্রী আশা করছেন, তার নতুন বাজেট বাস্তবায়ন করতে পারলে মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশের মধ্যে আটকে রেখে ৬.৭৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি পাওয়া সম্ভব হবে।
মঞ্জুরি দাবি ও ছাঁটাই প্রস্তাব : নতুন অর্থবছরের বাজেটের ওপর সংসদে উত্থাপিত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ খাতের ৫৯টি মঞ্জুরি দাবির বিপরীতে বিরোধী দল ও স্বতন্ত্রসহ ৭ জন সংসদ সদস্য মোট ২৫১টি ছাঁটাই প্রস্তাব আনেন। এর মধ্যে কেবল আইন, শিক্ষা ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ছাঁটাই প্রস্তাবের ওপর আলোচনা হয়। সব প্রস্তাবই কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। অন্যান্য বছর বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় বা বিভাগের ছাঁটাই প্রস্তাবের ওপর আলোচনা হলেও এবার মাত্র তিনটি মন্ত্রণালয়ের ওপর আলোচনা হয়েছে।