বেশ কয়েক বছর আগে এ–দেশেরই স্বনামধন্য দুইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন অধ্যাপক মিলে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন যেখানে সংবাদপত্রে নারী ও শিশু নির্যাতন বিষয়ক সংবাদের উপস্থাপনা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে জেন্ডার সংবেদনশীলতার স্বরূপ উন্মোচনের চেষ্টা করেন। তাদের এই গবেষণাপত্রটির ভাবনা মূলত আর একটি আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনের সুপারিশমালা থেকে উদ্ভূত যেখানে বলা হয়েছে ‘‘নারী নির্যাতন, নারীর মানবাধিকার প্রশ্নে নারী উন্নয়নে গণমাধ্যমে নারী বিষয়ক খবরের নেতিবাচক উপস্থাপন পরিলক্ষিত হয়।’’ কেননা আমরা জানি, ‘‘যে কোনো বিষয়ে জনমত তৈরি, তথ্যের ব্যাপক প্রসার ও প্রচারের মাধ্যমে মানুষের চিন্তা চেতনাকে প্রভাবিত করার অন্যতম হাতিয়ার গণমাধ্যম।’’
এবারে আসি আমাদের সংবাদপত্রগুলোতে নারী নির্যাতন বিষয়ক খবরাখবর প্রকাশের বর্তমান হাল–হকিকত নিয়ে। এখনো কোনো কোনো সংবাদপত্রে নির্যাতিতার ছবি প্রকাশ করা হয়। যেমন শিকলে বাধা গৃহবধূর ছবি, চিকিৎসক স্বামীর আঘাতে আহত চিকিৎসক স্ত্রীর ছবি, সালিসে পেটানো গৃহবধুর ছবি, যৌতুক না পেয়ে চুল ন্যাড়া করা দেওয়া গৃহবধূর ছবি, এসিডে ঝলসানো গৃহবধূর রঙিন ছবি, রডের আঘাতে ছেলেশিশুর পিঠে কালশিটে পড়া ছবি, ঘুষি মেরে শিশু গৃহকর্মীর গাল–চোখ ফুলিয়ে দেওয়ার ছবি এবং এরকম আরো অসংখ্য ছবি। সেই সঙ্গে নির্যাতিত নারীর নাম ঠিকানাও প্রকাশ করা হয়। অভিযুক্ত নির্যাতনকারীর নাম, পরিচয় ও ছবি প্রকাশিত হলেও তা হারিয়ে যায় নির্যাতিত নারীর ব্যক্তিগত জীবনালেখ্য বর্ণনার অন্তরালে। নির্যাতিত নারীর জীবনচিত্র নিয়ে চিত্রিত হয় অহেতুক বর্ণিল বাক্য রচনা। এদিকে আইনে বলা আছে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে সরাসরি দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না, তাহলে নির্যাতিত নারীর জীবন নিয়ে অহেতুক বর্ণনার ক্ষেত্রে একই ধরনের বিধি–নিষেধ আরোপ করা প্রয়োজন নয় কি? যে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে সে কেমন ছিল বা তার ব্যক্তিগত জীবনাচার কেমন ছিল সে বিষয়সমূহ তদন্তের স্বার্থে একজন তদন্তকারী পুলিশ অফিসারের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য হতে পারে কিন্তু সংবাদপত্রের জন্য তা কতোটা প্রয়োজনীয়?
আশার বিষয় যে পত্রিকাগুলোতে এখন আর ধর্ষনের শিকার নারীর নাম, ঠিকানা ও ছবি প্রকাশিত হয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ধর্ষকের ছবি প্রকাশ করা হয়। ধর্ষনের শিকার নারীর নাম, ঠিকানা ও ছবি প্রকাশ না করে সংবাদপত্রগুলো দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিলেও শারীরিক নির্যাতনের ছবি প্রকাশ করে সেই দায়িত্বশীলতায় চিড় ধরিয়েছে কোনো কোনো পত্রিকা। নির্যাতনের ভয়াবহতা প্রকাশার্থে নির্যাতনের ছবি ছাপানো হলেও এতে নির্যাতিতারই সম্মানহানি ঘটে। আমাদের মনে রাখতে হবে, গণমাধ্যম একটি পারিবারিক মাধ্যমও বটে। এর পাঠক শিশু–কিশোর থেকে শুরু করে বাড়ির বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তিটি পর্যন্ত। নির্যাতনের সচিত্র বর্ণনা যে শিশু–কিশোরদের মনে প্রভাব ফেলতে পারে সে বিষয়টি সংবাদপত্র গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা দরকার বলেই মনে করি।
পাশাপাশি সংবাদপত্রে নারী ও শিশু নির্যাতনের যে সংবাদ প্রকাশিত হয় তা কখনো কখনো অসম্পূর্ণ ও একপেশে। নির্যাতনের খণ্ডিত রূপ এতে ফুটে ওঠে। নারী ও শিশুকে হত্যা করা, ধর্ষণ করা, অপহরণ করা যে কত সহজ তারই সংখ্যাতাত্ত্বিক বিবরণ দিয়েই সংবাদগুলো দায় সামলায় যেন! এসব সংবাদে এতদ্সংক্রান্ত আইনগত দিকটি প্রায়শই অনুপস্থিত। বিচ্ছিন্নভাবে নির্যাতনের খবর পরিবেশন করাতেই সংবাদপত্রগুলোয় দায় যেন! খবরের পেছনের খবর বা এ–নিয়ে অনুসন্ধানমূলক খবর পরিবেশনের তেমন কোনো তাগিদ সংবাদপত্রগুলোতে দেখা যায় না। কখনো হয়তো নির্যাতনের ঘটনার ফলোআপ প্রকাশিত হয়েছে কিন্তু অপরাধীর শাস্তির বিষয়টি অনুচ্চারিত থাকে মোটাদাগে।
তবে দেশের প্রথম সারির কিছু সংবাদপত্র নারী ও শিশু নির্যাতনের সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে ভাষার ব্যবহারে সাবধানতা অবলম্বন করছে যা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। কিন্তু ভাষা ব্যবহারের এই অভ্যাসটি দেশের সকল পত্রিকারই রপ্ত করা উচিত। এই প্রসঙ্গে কিছু সুপারিশ উপস্থাপন করতে চাই যেমন নির্যাতনের শিকার যেকোনো নারীর ছবি ও পরিচয় প্রকাশ করার বিষয়ে সংবেদনশীলতার পরিচয় দিতে হবে। এ সংক্রান্ত সংবাদের ফলোআপ রিপোর্ট ছাপাতে এবং অপরাধীর শাস্তির বিষয়টিও তুলে ধরতে হবে। সংবাদে ব্যক্তি হিসেবে নারীর গোপনীয়তা ক্ষুণ্ন করে এমন বিষয় প্রকাশ থেকে বিরত থাকতে হবে। সাদামাটা সংবাদ নয়, ব্যাখ্যামূলক ও অনুসন্ধানী সংবাদের ওপর জোর দিয়ে সংবাদটি আরো গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করা দরকার বলে মনে করি। কেবল ভেতরের পৃষ্ঠায় এ–সংক্রান্ত্ত সংবাদের স্থান না দিয়ে প্রথম বা শেষ পৃষ্ঠায় বা ফার্স্ট লিড বা সেকেন্ড লিড বা বেশি কলাম জুড়ে নারী নির্যাতনের সংবাদ প্রকাশ হলে ভাল হয়। এ সংক্রান্ত সংবাদ পরিবেশনে সংবাদের গুরুত্ব প্রদানে বাইলাইন স্টোরি ও নারী প্রতিবেদক কর্তৃক প্রতিবেদনের সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে। তাছাড়া নারী পাতার বাইরেও নারী প্রতিবেদকদের রিপোর্ট প্রকাশ করা উচিত। পাশাপাশি সংবাদ ও ছবি প্রকাশের ক্ষেত্রে সংবাদপত্রগুলোর জন্য জেন্ডার সংবেদনশীল গাইড লাইন প্রণয়ন করাও জরুরি।