সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার পাক্কা ছয় মাস পর অবশেষে গঠিত হলো চার দলীয় ডাচ কোয়ালিশন সরকার। এদ্দিন বিভিন্ন বিজয়ী দলের সাথে চলছিল দেন–দরবার। নির্বাচনে এক এক দলের এক এক ধরনের নির্বাচনী মেনিফেস্টো। এদের কেউ বাম, কেউ কট্টর ডান কেউবা মধ্যপন্থী। ফলে সমঝোতায় পৌঁছাতে এই দীর্ঘ সময়ক্ষেপণ। তবে এমন পরিস্থিতি এই প্রথম নয়। এর আগেও এমনটি ঘটেছিল। পাশের দেশ বেলজিয়ামে সরকার গঠন করতেই বছর দেড় দুই পার হয়ে যাবার মত ঘটনা আছে। এবারে যে চমক তা হলো ডাচ রাজনীতিতে এই প্রথম একটি ‘চরম ডানপন্থী’ সরকার ক্ষমতায় বসতে যাচ্ছে, যা মুক্তচিন্তা ও গণতন্ত্রের জন্যে অশনি সংকেত। ‘টলারেন্ট’ বা ‘সহনশীল’ দেশ বলে এদ্দিন উত্তর সাগর পাড়ের ছোট্ট কিন্তু অতি উন্নত দেশ হল্যান্ডের যে সুনাম বা পরিচিতি ছিল, তা বেশ কয়েক বছর আগ থেকে খোঁয়া যেতে শুরু হলেও এই চরম ডানপন্থী সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে চিরতরে নির্বাসনে গেল সে কথা নির্দ্বিধায় বলা চলে। গেল বছর ২৩ নভেম্বর অনুষ্ঠিত পার্লামেন্ট নির্বাচনে মোট ১৫০টি সংসদীয় আসনের ৩৭টি আসন জয় করে বিজয়ী হলেন চরম ডান, অভিবাসী ও ইসলাম–বিরোধী নেতা হিসাবে পরিচিত নেতা খেয়ার্ট বিল্ডারস ও তার রাজনৈতিক দল ‘পারতাই ফর ফ্রাইহাইদ’ বা ফ্রিডম পার্টি। পঁচিশটি আসন পেয়ে দ্বিতীয় স্থান দখল করে লেবার পার্টি ও গ্রিন পার্টির মিলিত জোট, অন্যদিকে বিগত সরকারে কোয়ালিশনের নেতৃত্বে থাকা দল, ফেই ফেই দে ২৪টি আসন পেয়ে তৃতীয় স্থান দখল করে। এই দলটি হারিয়েছে ১০ টি আসন। হল্যান্ডে কখনোই এক দল নির্বাচনে নিরুঙ্কুশ বিজয়ী হতে পারেনি এই পর্যন্ত। ফলে বরাবর গঠিত হয়ে এসেছে কোয়ালিশন সরকার। এবারের নির্বাচনে ‘কোরান নিষিদ্ধ, মুসলিম ও বিদেশিদের জন্যে হল্যান্ডের দরজা বন্ধ করা’ ইত্যাদি ইস্যু নিয়ে খিয়ের্ট বিল্ডার্স ভোটারদের কাছে গিয়েছিলেন। ভোটাররা তাতে অভূতপূর্ব সাড়া দিয়ে তার দলকে ভোট দিয়ে শীর্ষস্থানে পৌঁছে দেন, যা বিল্ডার্স নিজেও আশা করেননি বলে নির্বাচনোত্তর সময়ে জানান। দেশের যে সমস্ত ‘কনভেনশনাল’ রাজনৈতিক দল ছিল সেগুলি এককাট্টা হয়ে খিয়ার্ট বিল্ডার্সের বিরুদ্ধে লড়েছিল, কিন্তু নির্বাচনী হাওয়া বিল্ডার্সের নৌকায় লেগেছিল একটু বেশি করেই এবং অন্যান্য দলগুলিকে অনেক পেছনে রেখে হু হু করে তার নৌকাকে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। স্বাভাবিক নিয়মে নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও যে দল আসন সংখ্যার ভিত্তিকে অন্য সব দলের চাইতে এগিয়ে থাকে, সেই দলের প্রধান দেশের প্রধানমন্ত্রী হন। সেই হিসেবে ফ্রিডম পার্টির নেতা, খিয়ের্ট বিল্ডার্স এবার প্রধান মন্ত্রী হবার কথা। কিন্ত না তেমনটি হলো না। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি তার সাথে কোয়ালিশনে যেতে রাজি হলোনা। এমন কী বাঁধ সাধলো তার দলের সাথে জোট বাঁধতে যাওয়া তিনটা দলও। এই তিনটা দল হলো : ১) নিউ সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট (এন এস সি), ২) কৃষক–নাগরিক মুভমেন্ট (বি বি বি) ও ৩) পিপলস পার্টি ফর ফ্রিডম এন্ড ডেমোক্রেসি (ফেই ফেই দে)। চার দলীয় এই জোটের তিনটি দল এক সুরে বললো, বিল্ডার্স যদি প্রধানমন্ত্রী হতে চান, তাহলে আমরা তার সাথে সরকার গঠনে যাবোনা। কেননা তিনি যে সমস্ত নীতি ও আদর্শে বিশ্বাস করেন এবং যেই আদর্শ আর নীতি বিক্রি করে ভোটে জিতেছেন তা আমাদের (ডাচদের) চেতনা ও চিন্তাধারার সাথে যায় না। এক পর্যায়ে বিল্ডার্স নির্বাচনী প্রচারণায় ‘ইসলাম–বিরোধী’ যে সমস্ত বক্তব্য রেখেছিলেন তা থেকে সরে আসতে বাধ্য হন এবং এই মর্মে প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন। এরপর শরিক দলগুলি তার দলের সাথে জোট গঠনে এগিয়ে আসে। শুরু হয় আলোচনা।
কিন্তু দীর্ঘ আলোচনা ও দেন–দরবার শেষে যে চুক্তির ওপর ভর করে কোয়ালিশন সরকার গঠনের ঘোষণা দেয়া হলো তাতে মুক্তচিন্তা ও গণতন্ত্রমনা দল ও গোষ্ঠী তাদের আশংকা প্রকাশ করলেন এই বলে, দেশ এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে চলবে যা দেশের ভবিষৎ–এর জন্যে ভালো না। সেই চুক্তি প্রসঙ্গে আসছি একটু পর। তবে এর আগে বলে নেই, যেহেতু খিয়ের্ট বিল্ডার্সকে কোন দল প্রধান মন্ত্রী হিসাবে দেখতে রাজি নয়, সেহেতু নূতন প্রধানমন্ত্রী কে হবেন এ নিয়ে বর্তমানে বেশ জল্পনা–কল্পনা চলছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন টিভি আলোচনা ও পত্র–পত্রিকায় যে নামটি বারবার উচ্চারিত হচ্ছে তা হলো, ৬৭ বছর বয়েসী রোনাল্ড প্লাসটেরক। মজার ব্যাপার হলো, নতুন কোয়ালিশন সরকার হচ্ছে চরম ডানপন্থী, অথচ রোনাল্ড প্লাসটেরক হচ্ছেন তার ঠিক উল্টো ভাবধারার। তিনি লেবার পার্টির অন্যতম নেতা এবং বিগত সরকারে তিনি ছিলেন শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান বিষয়ক মন্ত্রী। জানা গেছে খিয়ার্ট বিল্ডার্স তার (রোনাল্ড প্লাসটেরক) ওপর ভর করে আগামী কোয়ালিশন সরকার গঠন ও চালাতে সক্ষম হবে আশাবাদী। এদিকে যখন রোনাল্ড প্লাসটেরক–এর মনোনয়ন প্রায় নিশ্চিত সেই সময় (এই লেখা শেষ করার মুহূর্তে) জানা যায়, তিনি প্রধানমন্ত্রী না হবার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। কারণ বিগত দিনে তার কিছু অনিয়ম নিয়ে এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তবে তিনি এই সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। এখন বিল্ডার্সের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ তিনি কাকে নূতন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে জাতির কাছে উপস্থিত করেন। যাই হোক –
যে সমস্ত নীতিমালার উপর ভর করে নূতন কোয়ালিশন সরকার গঠন হতে যাচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হলো : ১) এসাইলাম ও মাইগ্রেশন আইনে কড়াকড়ি আরোপ; শরণার্থীদের স্থায়ী রেসিডেন্ট পারমিট দেয়া হবে না; যে সমস্ত শরণার্থী বা রেফুজির আবেদন প্রত্যাখ্যাত হবে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে, প্রয়োজনে ‘ফোর্সড ডিপোর্টেশন’ অর্থাৎ জোর করে ফেরত পাঠানো হবে; যে সব শরণার্থী হল্যান্ডে বসবাসের অনুমতি পান, তাদের সোশ্যাল হাউজিং (বাসা) পাবার ক্ষেত্রে এদ্দিন যে প্রাধান্য ছিল তা আর পাবেন না; আগে যারা বসবাসের অনুমতি পেতেন তারা অটোমেটিক তাদের পরিবারের সদস্যদের হল্যান্ড আনতে পারতেন, এখন থেকে তা বাতিল করা হবে; ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে থেকে যাতে শরণার্থী অনুপ্রবেশ করতে না পারে সে জন্যে বর্ডারে নিরাপত্তা ও চেক বাড়ানো হবে; ২) হল্যান্ডে উচ্চতর পড়াশুনা করতে আসা বিদেশী শিক্ষার্থী আসা কমানোর লক্ষ্যে ডাচ ভাষায় শিক্ষা বাড়ানো হবে; ই ইউ (ইউরোপীয় ইউনিয়ন) এর বাইরে থেকে আসা শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ফী বাড়ানো হবে; ইন্টেগ্রেশন প্রসেসে (নাগরিক হবার জন্যে আত্মীকরণ পদ্ধতি) ‘হলোকাস্ট‘ বিষয়ে শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হবে; ডাচ নাগরিকত্ব পাবার সম্ভাব্যতা পাঁচ বছর থেকে বাড়িয়ে দশ বছর করা হবে; প্রচলিত নিয়মে মোটামুটি ডাচ বলতে ও বুঝতে পারলে ডাচ–নাগরিকত্ব দেয়া হয়; আগামীতে তা বাতিল করে নূতন আইনে ডাচ ভাষায় ‘লেভেল–বি’ থাকতে হবে; বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে প্রচলিত ইংরেজি–মাধ্যম কমিয়ে ডাচ ভাষা ব্যবহার বাড়ানো হবে; শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষা ও শিক্ষা পদ্ধতির উন্নয়ন করতে হবে এবং তা কার্যকর ও রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ হতে হবে (এর ফলে শিক্ষাঙ্গনে কোন আন্দোলন করা যাবে না, যেমনটি বর্তমানে হল্যান্ডের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গাজায় ইসরাইলের গণহত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ ও আন্দোলন চলছে); ৩) সোশ্যাল সিকিউরিটি যে সুবিধা রয়েছে তা হ্রাস করা হবে– যেমন, বেকার ভাতা যা বর্তমানে দুই বছর, সেটি কমিয়ে ১৮ মাস করা হবে; ৪) আরো শঙ্কার বিষয় হচ্ছে এই সরকার পরিবেশ–বান্ধব পদক্ষেপ থেকে সম্পূর্ণ সরে এসে জলবায়ু উন্নয়নে যে বাজেট সেখান থেকে ১.২ (এক পয়েন্ট দুই) বিলিয়ন ডলার কমাবে; হল্যান্ডে দুটোর পরিবর্তে চারটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হবে; এবং ৪) জনস্বাস্থ্যে খরচ কমাতে হবে; ৫) অনুন্নত দেশগুলিতে অনুদান ও সাহায্যের পরিমাণ আগ থেকেই কমানো হয়েছিল, নুতন এই কোয়ালিশন সরকার তা আরো কমিয়ে আনবেন বলে ইতিমধ্যে ঘোষণা দেয়া হয়।
এখন দেখার বিষয় সরকার যদি উপরে উল্লেখিত পদক্ষেপগুলি কার্যকর করতে যায়, তাহলে তা কতটুকু সহজ হবে। কেননা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্র হিসাবে ইউনিয়নের প্রচলিত নিয়ম–নীতিমালাকে একেবারে পাশ কাটিয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। তাছাড়া বিরোধী দল তো রয়েছেই। তারাও নিশ্চয় এই ব্যাপারে সক্রিয় ও সরব থাকবে। দেখা যাক, আগামী দিনগুলিতে আপাত শান্ত ডাচ রাজনীতি কোনদিকে টার্ন নেয়। আর তা দেখার জন্যে আমাদের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট