স্টেডিয়াম লাগোয়া নেভেল এভিনিউতে এক সময়কার হেলিপ্যাডে ঢুকতেই হাতের বাঁদিকে ছিমছাম এক রেস্তোরাঁ, নাম মেরিটাইম মিউজিয়াম ক্যাফে। দেশে গেলে সেখানে মাঝে মধ্যে বসি। সেখানকার বীফ শিক কাবাব, সাথে গার্লিক নান আমার প্রিয়, সাথে কফি। মার্চের শেষ দিকে এক সন্ধ্যায় সেখানে বসে কফি খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছিলাম অনুজপ্রতিম ইয়ার চৌধুরীর সাথে। হ্যাংলা–পাতলা লম্বাটে গড়ন, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, চোখে চশমা, কিছুটা লাজুক প্রকৃতির যা তার এই বয়সে ইদানীং খুব একটা চোখে পড়েনা। নিজেকে সে নিজের মাঝে গুটিয়ে রাখে, ভালো ইংরেজি লেখে, কেমন বলে (স্পোকেন) জানা নেই। তবে ধারণা করি ভালোই হবে, কেননা ভারতের ব্যাঙ্গালুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বছর চারেক পড়াশুনা করে ব্যাচেলর সায়েন্স অফ কম্পিউটার সায়েন্সে পাশ দিয়েছে। তার পুরো নাম চৌধুরী ইয়ার মাহবুব সিদ্দিকী। দেশে (চাটগাঁ) গেলে মাঝেমধ্যে তার সাথে দেখা হয়, ফোন করে ডেকে কথা বলি, আড্ডা দেই। কোথায়ও কখনো বিশেষ প্রয়োজনে যেতে হলে, যদি একা থাকি, তাকে ডেকে নেই। যেমন গেল মার্চের শেষের দিকে হঠাৎ শরীর বেঁকে বসলে হাসপাতাল যেতে হয়। বিগত ৩৩ বছরে এই প্রথম শারীরিক অসুস্থতা হেতু দেশের এক হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। দেশে গেলে প্রয়োজনে–অপ্রয়োজনে ভাগ্নে কুনাল থাকে প্রায় সর্বক্ষণ। সেদিন তার অফিস ছিল, তাকে ডাকিনি। বাসায় একা, কোমড়ে প্রচন্ড ব্যথা, উঠতে বসতে কষ্ট হচ্ছে। ধারণা করা হয়েছিল এক নাগাড়ে দীর্ঘক্ষণ চেয়ারে বসে কাজ করার ফল এটি। যে চেয়ারে বসে কাজকর্ম করি সেটি ডাইনিং টেবিলের। ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করার জন্যে উপযুক্ত নয়। তড়িঘড়ি করে নূতন চেয়ার কেনা হলো। কিন্তু না, কোন ফল হলো না। ফোন করি আমাদের পারিবারিক বন্ধু, বড় ভাইয়ের অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ডাক্তার দুলাল দাশকে। তখন সকাল আনুমানিক সাড়ে নটা। ড. দুলাল দাশকে বললাম, ভালো কোন ডাক্তার জানা থাকলে যেন এপয়েন্টমেন্ট করেন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে তিনি ফোন করে বললেন, এপয়েন্টমেন্ট করেছি ভালো এক ডাক্তারের সাথে, বিকেল পাঁচটায়, জামালখান তার চেম্বার। তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন রেখে দেই। তখন আমার প্রচন্ড ব্যথা। বিকেল পাঁচটা তক অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। ফোন করি পরম শুভাকাঙ্ক্ষী দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক সাহেবকে। উনি বললেন, ‘কোন সমস্যা নেই, আমি এখনই ওয়াহিদকে (তাঁর জ্যেষ্ঠ সন্তান, দৈনিক আজাদীর পরিচালনা সম্পাদক) বলে দিচ্ছি।’ মিনিট বাদে ফোন করলেন ওয়াহিদ মালেক। বললেন, ‘হাসপাতালে ফোন করে দিয়েছি। আপনি গেলেই হবে।’ পাঁচ তারকা হিসাবে পরিচিত এপোলো–ইম্পেরিয়াল হাসপাতালের চেয়ারম্যান ওয়াহিদ মালেক। ইয়ার চৌধুরীকে ফোন করতেই খানিক বাদে সে চলে এলো আমার বাসায়। নিচে ড্রাইভার ইব্রাহিম প্রস্তুত। হাসপাতাল পৌঁছে রিসেপশনে নাম বলতেই টের পাই সবকিছু প্রস্তুত। মুহূর্তেই নার্স এগিয়ে এলেন, ডাক্তার এলেন, ভালো করে দেখলেন। এক্সরে করালেন। ভাগ্য সুপ্রসন্ন, তেমন মন্দ কোন উপসর্গ পাওয়া গেলোনা। হাসপাতালের ভারতীয় ‘সিইও‘ ফোনে রোগীর সাথে কথা বললেন। বুঝতে অসুবিধা হয়না, ওয়াহিদ ভাইয়ের এক টেলিফোনের কারণে এই বাড়তি যত্ন। হাসপাতালের বিল চুকিয়ে ফিরে আসি বাসায়, অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে।
যাই হোক, বলছিলাম ইয়ার চৌধুরীর কথা। হাসপাতালে সেদিন যে কয়েক ঘন্টা থাকতে হয়েছিল বেচারা ইয়ার আমার পাশে সারাক্ষণ বসেছিল। অবশ্য রোজা থাকায় তার খাওয়া–দাওয়ার কোন ব্যাপার–স্যাপার ছিলনা। ইয়ারের সাথে পরিচয় বছর দশেকের বেশি হবে। হল্যান্ড ডায়াস্পোরা সংগঠন, ‘বাসুগ’–এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি হয়ে সে ইতিমধ্যে বেশ কিছু কাজ করেছে। গবেষণামূলক কিছু সার্ভে, ঢাকায় সম্মেলনে যোগ দেয়ার মত কাজ করেছিল। তাতে তার বিশেষ আর্থিক কোন প্রাপ্তিযোগ ছিল না। কিন্তু যা ছিল তা হলো কাজের প্রতি তার প্রচন্ড আগ্রহ, নূতন কিছু জানা, শেখার চেষ্টা, আন্তরিকতা এবং কমিটমেন্ট। তার এই আন্তরিকতা, নিঃস্বার্থ মনোভাব আমাকে মুগ্ধ করে বেশি। তাই যখন ফ্রি থাকি, বিশেষ কোন কাজ থাকেনা তখন তাকে ডাকি। সেও মাঝে মধ্যে ফোন করে খবর নেয়, কেমন আছি, কোন কিছুর প্রয়োজন আছে কিনা ইত্যাদি। একদিন ব্যথায় যখন অনেক রাত অবধি ঘুম আসছিলো না, সে রাত আড়াইটার দিকে ফোন করে জানতে চায় কোন প্রয়োজন আছে কিনা, আমার বাসায় আসতে হবে কিনা। ইয়ার থাকে সদরঘাট এলাকায়, নিজেদের বাড়িতে। দেশে যখন চারিদিকে, নিকটজন থেকে শুরু করে পরিচিত অনেকেই, কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত, স্বার্থ ছাড়া এক কদম পা ফেলে না, তখন ইয়ার নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে আমার কোন কাজ এগিয়ে নিতে এগিয়ে আসে, ডাকার আগেই। বয়সে আমার চাইতে বেশ ছোট। তার সাথে আমার আড্ডা বলতে সাধারণ অর্থে যা বুঝি, তা হবার কথা নয়। আমাদের আড্ডা কিংবা আলোচনার বিষয়ও বেশ ইন্টারেস্টিং। নূতন নূতন বিষয় জানতে পারি তার কাছ থেকে।
২) সেদিনের সান্ধ্যকালীন আলোচনার বিষয় ছিল ‘আমাদের পূর্বপুরুষ’। এক পর্যায়ে ইয়ার বলে, আমাদের পূর্বপুরুষ ‘হোমো স্যাপিয়েন্সরা’ পৃথিবীতে একমাত্র বুদ্ধিমান মানব–প্রজাতি ছিল না। হোমো স্যাপিয়েন্সদের চাইতেও আরো বুদ্ধিমান মানব প্রজাতি ছিল। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল হোমো নিয়ান্ডারথ্যাল, হোমো ইরেক্টাস ও হোমো সোলোয়েনসিস। এই সমস্ত মানব প্রজাতি অনেক দিন আগ থেকেই বিলুপ্ত। এদের বসবাস ছিল আফ্রিকা, ইউরোপ এবং এশিয়ায়। এরা যে ছিল সে জানা ছিল, কিন্তু যে সমস্ত কারণে এই সমস্ত মানব প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে তা জানা ছিলনা। সেটি যখন ইয়ার বললো তখন বেশ উৎসাহিত হয়ে পড়লাম এই বিষয়ে আরো কিছু শোনার জন্যে। এর কারণ হিসাবে ইয়ার জানায়, ‘অন্যান্য মানব প্রজাতির বিলুপ্তির কারণ নিয়ে বেশ কিছু বিতর্ক রয়েছে। একটি তত্ত্ব হলো যে, সম্পদ ব্যবহারের দক্ষতা ও অভিযোজন–ক্ষমতার জন্যে আমাদের পূর্ব–পুরুষ ‘হোমো স্যাপিয়েন্সরা’ টিকে গেছে, অন্যরা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই ব্যাপারে আর একটি তত্ব হলো, আমাদের পূর্ব–পুরুষ ‘হোমো স্যাপিয়েন্সরা’ সহিংসতার মাধ্যমে অন্যদের নির্মূল করেছে কিংবা বিলুপ্তির দিকে নিয়ে গেছে।’ কারণ হিসাবে ইয়ার বলে, দেখা গেছে ‘হোমো স্যাপিয়েন্সরা’ যেখানে গেছে সেখানেই অন্য মানব প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কী করে আমাদের পূর্ব–পুরুষ ‘হোমো স্যাপিয়েন্সরা’ টিকে গেল এই নিয়েও মজার গবেষণালদ্ধ তথ্য রয়েছে জানিয়ে ইয়ার বলে, ‘এর বড় সম্ভাবনা হলো আমাদের ভাষা আবিষ্কার বা কথা বলা, ভাব বিনিময় করার সক্ষমতা। এই সক্ষমতা আমাদের টিকে থাকার সুবিধা দিয়েছে বা অন্যভাবে বলা যায়, ‘হোমো স্যাপিয়েন্সরা’ বিশ্বজয় করেছে তাদের অনন্য ভাষার কারণে। উল্লেখ্য, নিয়ান্ডার্থালরা প্রায় ৩০ হাজার বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল, অন্যদিকে প্রায় ১২ হাজার বছর আগে ফ্লোরেন্স দ্বীপ থেকে হোমো ফ্লোরেসিয়েন্সিস বা শেষ মানব প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়।
৩) মানব চরিত্র প্রসঙ্গে ইয়ার বলে, বলা হয়ে থাকে কৃষিকাজ মানুষকে অলস বানিয়েছে। আমাদের তাবৎ রোগ–বালাই এসেছে এই কৃষিকাজ থেকে। কৃষি উৎপাদন না হলে মানুষ মারা যেত। কারণ জানতে চাইলে ইয়ার বলে, গবেষণা থেকে জানা যায়, ফসল উৎপাদন না হলে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। আগে মানুষ মারা যেত হাম, যক্ষা, বসন্ত, প্লেগ ইত্যাদি সংক্রামক রোগের কারণে। বর্তমানে মারা যায় ‘অসংক্রামক’ রোগে, যেমন ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ইত্যাদি। আগেকার দিনে কোন এলাকায় রোগ বিস্তার হলে এই এলাকা ছেড়ে মানুষ অন্য কোথায়ও চলে যেত। মহামারী বিস্তৃত হবার সুযোগ পেতো না। আবার কৃষিভিক্তিক সমাজ ব্যবস্থায় মানুষ সাধারণত একটি বা দুটি ফসলের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ফলে কোন কারণে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হলে খাদ্যাভাব দেখা দিত, দুর্ভিক্ষ দেখা দিত, মানুষ মারা যেত। কিন্তু প্রাচীনকালে শিকারী সমাজ এই দিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। কেননা তারা কোন একটি নির্দিষ্ট ফসলের ওপর নির্ভরশীল ছিল না। ফলে দুর্ভিক্ষ, জলোচ্ছাস যাই হোক না কেন, তাদের খাবার জোগাড় হয়ে যেত। আর যাই হোক না কেন নানা রকমের ফলমূল খেয়ে তারা টিকে থাকতে পারতো। আর কোন এলাকায় রোগের বিস্তার ঘটলে তারা সেই এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেত। মহামারী বিস্তৃত হবার সুযোগ পেতো না।
আমি গভীর আগ্রহের সাথে ইয়ারের এই সমস্ত মজার মজার কথা শুনতে থাকি। সে টের পায় শ্রোতার আগ্রহের। বলে, জানেন দাদা, অনেক সময় স্বামী–স্ত্রীর চেহেরার মাঝে এক ধরনের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এর পেছনেও রয়েছে মজার ‘ফাইন্ডিংস‘। ততক্ষণে রাত বেশ এগিয়ে গেছে। ইয়ারকে থামিয়ে দিয়ে বলি, আমাদের বোধকরি এখানে আর বেশিক্ষণ আর বসে থাকা যাবেনা। রেস্তোরাঁর ক্লোজিং–টাইম হয়ে গেছে প্রায়। রওনা দেই বাসার দিকে। ভাবি বিশাল এই পৃথিবীর কত কিছুই আমাদের অজানা। যে জ্ঞান নিয়ে আমরা চলি সে যেন বিশাল সমুদ্রের এক বিন্দু জল।
লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট