পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র গোষ্ঠী গুলির সাথে আমার দীর্ঘদিন থেকে এক ধরনের নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। ব্যতিক্রম শুধু কে এন এফ বা খুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট। এ গোষ্ঠীটির পথচলা খুব বেশীদিনের নয়। চার পাঁচ বছর থেকে। যে নৃ গোষ্ঠী থেকে কে এন এফ গঠিত হয়েছে তাদের জনসংখ্যা ১২ থেকে ১৩ হাজারের বেশী নয়। বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, খুমি আর ম্রো’ রা এর অন্তর্ভুক্ত। এরা মূলত পার্বত্য অঞ্চলের আদি ধর্ম ক্রামা এবং খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী। শুরুতে এদের বিশেষ করে এ দলের নেতা নাথান বোমের জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাত এবং বঞ্চনাজনিত ক্ষোভ কে এন এফ গঠনে তাকে উৎসাহিত করে। কারণ ইতিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা বিভাগ থেকে ডিগ্রি নিয়ে নাথান এখানে সেখানে চাকরীর সন্ধান করে ব্যর্থ হন। ব্যবসা করতে গিয়েও তেমন কিছু করতে পারেননি বরং পুঁিজ হারান। শেষমেষ একটি এনজিও গঠন করেন। এই এনজিও’কে ভিত্তি করে কোন কোন পক্ষ নাথানের গায়ে হাওয়া দেন। সে হাওয়ায় নাথান ফুলেফেঁপে ওঠেন। নাথান ১৯৯৭ সালে সম্পাদিত র্পাবত্য শান্তি চুক্তিতে পার্বত্য অঞ্চলের প্রান্তিক ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীগুলিকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগের আঙ্গুল তোলেন। বলাবাহুল্য সে অভিযোগের আঙ্গুল চাকমা যারা সরকারের সাথে পার্বত্য শান্তি চুক্তিতে মূল ভূমিকা রাখেন তাদের দিকে নির্দিষ্ট করে। এরই মধ্যে কে এন এফ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির স্বশস্ত্র শাখা শান্তিবাহিনীর সদস্যদের সাথে সংঘর্ষেও লিপ্ত হয়। তবে কে এন এফ পাদ প্রদীপের আলোয় আসে যখন প্রকাশ হয় তারা টাকার বিনিময়ে তাদের আস্তানায় জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারকীয়া নামক একটি ইসলামিক মিলিট্যান্ট গোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। ইতিমধ্যে আরো জানাজানি হয় রাঙামাটী র্পাবত্য জেলার বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাইছড়ি, বিলাইছড়ি এবং বান্দরবান র্পাবত্য জেলার রোয়ংছড়ি, রুমা, থানছি, লামা ও আলীকদম নিয়ে কুকি চিন স্বতন্ত্র এক আবাসভূমি গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছে কে এন এফ। কে এন এফ’র সামরিক শাখা কে এন এ বা কুকি চিন ন্যাশনাল আর্মির সদস্য সংখ্যা ৪০০ এর কাছাকাছি বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়।
এসব ঘটনা জানাজানির পর কে এন এফ’ এর বিরুদ্ধে বান্দরবানে যৌথ সামরিক অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানের তোড়ে টিকতে না পেরে কে এন এফ’ এর সম্মুখ সারির নেতারা তখন পালিয়ে পাশ্ববর্তী ভারতীয় মিজোরামে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। এখানে সম্ভবত নাথান এবং তার দলের নেতারা মিজোরামের কুকি নেতাদের সংশ্রবে আসেন এবং তাদের দ্বারা প্রভাবিত হন। ঊল্লেখ্য ইতিপূর্বে মনিপুরের কুকি এবং মেইতীদের মধ্যে চলমান সংঘাত সংর্ঘষে মিজোরামের কুকিরা মনিপুরের কুকিদের পক্ষ নিয়ে বিভিন্ন সভা সমাবেশ করে। এ থেকে অনুমান করা যায় নাথানরাও সে একই চিন্তা চেতনায় আলোড়িত হন।
এরই মধ্যে বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়্যারম্যান এর নেতৃত্বে একটি কমিটি নাথানদের সমঝোতার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ জীবনে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সে উদ্যোগের ফলশ্রুতিতে এ কমিটির সাথে নাথানদের প্রথমে চারটি ভার্চুয়াল আলোচনা এবং পরবর্তীতে যথাক্রমে ৫ নভেম্বর ২০২৩ এবং ৫ মার্চ ২০২৪ দুটি সরাসরি আলোচনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তৃতীয় বৈঠকটি নির্দিষ্ট হয় ২২ এপ্রিল ২০২৪।
তৃতীয় বৈঠকে বসার আগেই হঠাৎ ২ এপ্রিল ২৪ কে এন এফ’এর ৭০/৮০ জনের একটি দল রাত আটটায় রুমা থানা সদরে সোনালী ব্যাংকে ডাকাতি করে। সাথে ঐ ব্যাংকের ম্যানেজারকেও জিম্মি করে নিয়ে যায়। পরদিন অর্থাৎ ৩ এপ্রিল ২০২৪ কে এন এফ থানচি’তে বেলা ১১ টায় সোনালি এবং কৃষি ব্যাংকে হামলা চালায়। এবং রাতে থানচিতে পুলিশ তল্লাশী চৌকিতে হয়রানিমূলক গুলি বর্ষণ করে। একদিন পর র্যাব অপহৃত ব্যাংক ম্যানেজারকে উদ্ধার করে।
চলমান শান্তি আলোচনার মাঝে কে এন এফ’এর ব্যাংক ডাকাতি পুরা জাতিকে হতবাক করে। প্রশ্ন উঠে হঠাৎ কে এন এফ এ্রকম একটি হঠকারি সিদ্ধান্ত নিল কেন? একই সাথে প্রশ্ন উঠে কে এন এফ’ এর এ তৎপরতা গোয়েন্দা সংস্থা সমূহ পূর্বে টের পেলনা কেন? আরো প্রশ্ন উঠে কে এন এফ অন্য কোন লক্ষ্যবস্ত্তু বাদ দিয়ে ব্যাংকে কেন হামলা চালাতে গেল? তাদের কি টাকার খুব প্রয়োজন ছিল?
প্রথম প্রশ্নের উত্তরে দুটি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া যায় প্রথমত কে এন এফ’ এর একটি উপদল হয়ত শান্তি আলোচনা থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেয় অর্থাৎ তারা শান্তি আলোচনার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এ দল শান্তি আলোচনা ভন্ডুল করার উপায় হিসাবে হয়ত ব্যাংক ডাকাতিকে অবলম্বন করে। এটি সত্য হলে তারা ইতিমধ্যে সফলও হয়েছে। কারণ ৩ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে শান্তি কমিটি কে এন এফ’এর সাথে শান্তি আলোচনা বাতিল ঘোষণা করে। গোয়েন্দাদের আগাম তথ্য না থাকার পিছনে কারণ হিসাবে এটা নিশ্চিত ধরে নেওয়া যায় তারা শান্তি আলোচনার উপর অতি আস্থাশীল ছিলেন এবং সে আস্থা তাদের মাঝে এক ধরনের আত্মতুষ্টি সৃষ্টি করে। ফলশ্রুতিতে তাদের দিক থেকে অবস্থা এমন ছিল ওরা ত চলেই আসছে আর তাদের পিছে অত সময় ব্যয় করার কি প্রয়োজন! এ আত্মতুষ্টি কে এন এফ’কে বেপরোয়া হওয়ার সাহস যুগিয়েছে অবধারিতভাবে। ব্যাংক বেছে নেওয়ার কারণ হয়ত কে এন এফ আরো অস্ত্র সংগ্রহে তৎপর হয়ে উঠেছে। যারা শান্তি আলোচনা ভন্ডুল করে সশস্ত্র সংঘাতের পথে পা বাড়াতে চাইবে তাদের ত অস্ত্র লাগবে। সে অস্ত্র যোগানে অর্থ প্রয়োজন। তারা হয়ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ব্যাংক ডাকাতি সে অর্থের যোগান নিশ্চিত করবে। আমাদের দক্ষিণ সীমান্ত সন্নিহিত অঞ্চল রাখাইন প্রদেশ জুড়ে ভূ–রাজনীতির সংঘাত চলছে। সেখানে অস্ত্রের ছড়াছড়ি। টাকার বিনিময়ে অস্ত্রের অভাব নাই। রাখাইনে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দারুণ অভাব। এ অভাব পূরণে আমাদের এপার থেকে অর্থের বিনিময়ে সে পন্য চোরাচালানের মাধ্যমে রাখাইনে পৌঁছানোর লোকের অভাব নাই। রাখাইন অঞ্চল থেকে টাকার বিনিময়ে অস্ত্র সংগ্রহে কে এন এফ’ এর মরিয়া প্রচেষ্টা হয়ত এই ব্যাংক ডাকাতি।
ব্যাংক ডাকাতির পরপরই আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোর অবস্থানে চলে যায়। এখানে কর্তৃপক্ষের অবস্থান একেবারে পরিস্কার আর তা হল কে এন এফ তাদের দাবী সমূহ বৈঠকে জানাতে পারত। সেখানে আলোচনার মাধ্যমে একটি সিদ্ধান্তে হয়ত পৌঁছানো যেত। কে এন এফ সে কাজটি না করে এক অবিমিশ্যকারী বা হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্বের সংকট তৈরী করে বসে।
পরিণতিতে ইতিমধ্যে রুমা – থানচি ইত্যাদি এলাকায় যৌথ বাহিনী অভিযান চালিয়ে কে এন এফ’এর অনেক সক্রিয় সদস্য এবং সর্মথককে আটক করেছে। কে এন এফ’এর হঠকারিতা এবং চলমান যৌথ বাহিনীর অভিযান পুরা বান্দরবান জুড়ে একটি অস্বস্তি এবং শংকার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। বাংলা বছর শেষে চৈত্র সংক্রান্তি এবং বর্ষ বরন বৈসাবি বা বিজু পাহাড় অঞ্চলের মানুষের সবচেয়ে বড় উৎসব। এ উৎসবকে ঘিরে পাহাড়ের অর্থনীতিতে সৃষ্টি হয় প্রাণচাঞ্চল্য। হাজার হাজার পর্যটক পার্বত্য বান্দরবানে গমন করেন এসব পালাপার্বনে। এই ঘটনায় বান্দরবান পর্যটক হারাবে নিশ্চিতভাবে। পর্যটন শিল্পে বিনিয়োগকারীরা বিপর্যস্ত হবে। সার্বিকভাবে বান্দরবানের অর্থনীতিতে কে এন এফ ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
বান্দরবানের রুমা–থানচিতে কে এন এফ কর্তৃক সংগঠিত সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে আমাদের ইলেক্ট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়া সরব এবং রীতিমত সোচ্চার। নানা আলোচনা সমালোচনায় মুখর টিভি পর্দা। নানা উদ্ভট তত্ত্ব আর তথ্যের আলোকে কে এন এফ’কে নিয়ে টিভি’র আলোচকরা যেমন সোচ্চার তেমনি এ ঘটনায় আইন শৃংখলা বাহিনী বিশেষ করে গোয়েন্দা সক্ষমতা নিয়েও বাঁকা প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্ত্তু অবাক করা বিষয় হল পার্বত্য অঞ্চলে আমাদের মূল ধারার রাজনৈতিক দলগুলির ব্যর্থতা নিয়ে কারো কোন উচ্চবাচ্চ্য নাই। বা সে উচ্চবাচ্চ্য করার যোগ্যতাও আমাদের আলোচকদের নাই। এ প্রেক্ষিতে আমরা একটু বিশ্লেষণ করে দেখলেই বুঝতে পারব আমাদের পার্বত্য জনগোষ্ঠীর সাথে আমাদের মূল রাজনৈতিক দলগুলির তেমন কোন আত্মিক বন্ধন গড়ে ওঠেনি। প্রায়শই আমাদের রাজনৈতিক নেতারা পার্বত্য অঞ্চলের বিষয়গুলিকে সামরিক বিষয় বলে সামরিক বাহিনী বা আইন শৃংখলা বিষয়ক ধরে নিয়ে তাদের কাঁধে বিষয়টি চাপিয়ে দিয়ে নিজেরা সমতলের ছায়াতলে নিশ্চিত নিরাপদে থেকে বিবৃতি বক্তব্যের মধ্যে নিজেদের কর্তব্য শেষ মনে করেন। না হলে আমরা কখনো দেখিনি আমাদের কোনো ডাকসাইটে রাজনৈতিক নেতাকে বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, খুমি আর ম্রো’ জনগোষ্ঠীর কোন আচার অনুষ্ঠানে, কোন আপদ বিপদে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। বরং যেকোন দুঃসময় দুর্বিপাকে দুর্ঘটনায় সামরিক বাহিনীকে তা সমাধানে এগিয়ে দিয়েছেন। সামরিক বাহিনীর কাজ বা দায়িত্ব কি? মূলত তাদের দায়িত্ব কোন একটা বিস্ফোরন্মুখ বিষয়কে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং রাজনৈতিক নেতারা যেন উদ্ভুত বিষয়ের রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছাতে পারেন সে সুযোগ সৃষ্টি করা। ৯৭ সালের পূর্বে দীর্ঘ দিন নিজেদের দক্ষতা আর ত্যাগের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক বাহিনী রাজনৈতিক নেতৃত্বের সামনে সশস্ত্র সংঘাতের অবসান ঘটিয়ে শান্তির একটি বাতাবরণ সৃষ্টির সুযোগ করে দেয়। শেখ হাসিনার সাহসী রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং কূটনৈতিক বিচক্ষণতা সে সময় তাকে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরে এগিয়ে নিয়ে যায়। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি রাজনৈতিক নেতাদের সামনে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষের সাথে একাত্মতার এক বিশাল সুযোগ এনে দেয়। এ সুযোগ গ্রহণে আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের হয়ত অনীহা নয়ত অযোগ্যতার কারণে আজোও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন নৃ গোষ্ঠীর মানুষগুলিকে অন্য দ্বীপের মানুষের মত করে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। এই বিচ্ছিন্নতাবোধ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান সমস্যাসমূহের জন্ম। এ উপলব্ধি আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের মাঝে যত দ্রুত প্রবাহিত হবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমূহ তত দ্রুত বিদূরিত হবে। অন্যথায় র্পা্বত্য চট্টগ্রাম আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য জন্য নতুন নতুন সমস্যার জন্ম দেবে। কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট তাদের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে এ বার্তাটিই জোরালোভাবে তুলে ধরেছে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক