ঈদের ছুটিতে চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় শিশুসহ ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। ফটিকছড়ি, বোয়ালখালী, মীরসরাই, সীতাকুণ্ড, চন্দনাইশ ও আনোয়ারায় এসব দুর্ঘটনা ঘটে।
ফটিকছড়ি প্রতিনিধি জানান, ফটিকছড়িতে বাসের ধাক্কায় মো. আব্দুল্লাহ (১৭) ও মো. মোস্তাকিন (১৩) নামে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। গত শুক্রবার বিকাল ৫টায় চট্টগ্রাম–খাগড়াছড়ি সড়কের নাজিরহাট পৌরসভার মধ্য দৌলতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে এ ঘটনা ঘটে। জানা যায়, নিহত মো. আব্দুল্লাহ নাজিরহাট পৌরসভার ৬ নং ওয়ার্ডের ইমাম নগর এলাকার মো. তৌহদুল আলমের ছেলে। মো. মোস্তাকিন নাজিরহাট পৌরসভার ৫ নং ওয়ার্ডের ওমান প্রবাসী মো. ইউসুফ চৌধুরীর ছেলে। এছাড়াও এ ঘটনায় গুরুতর আহত আরো একজন হলেন মাইজভান্ডার দরবার শরীফ এলাকার মো. জানে আলমের ছেলে মো. রাহাত (১৬)। সম্পর্কে তারা ৩ জনই খালাতো ভাই। নিহত দুজন কোরআনের হাফেজ। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, তারা তিনজন একটি মোটরসাইকেলে করে সড়ক পার হওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় পিছন থেকে এসে দ্রুতগতির একটি যাত্রীবাহী বাস তাদের ধাক্কা দেয়। পরে তাদের উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হয়। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আরেফিন আজিম বলেন, গুরুতর আহত অবস্থায় ৩ জনকে মেডিকেলে নিয়ে আসা হয়। তন্মধ্যে একজন মৃত ছিল। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে চট্টগ্রামে পাঠানোর পথে আরো একজন মারা গেছে। অন্য একজন চিকিৎসাধীন আছে। নাজিরহাট হাইওয়ের থানার সেকেন্ড অফিসার আনিসুর রহমান বলেন, ২ কিশোরের মৃত্যুর ঘটনায় বাসটি জব্দ করা হয়েছে। এ ঘটনায় ফটিকছড়ি থানায় মামলা দায়ের করা হয়।
এদিকে ঘটনার পরদিন শনিবার ঘটনাস্থলে রাস্তার মাঝখানে মোস্তাকিনের লাশবাহী এম্বুল্যান্স রেখে মানববন্ধন করেছে স্থানীয়রা। এ সময় তারা বলেন, চট্টগ্রাম–খাগড়াছড়ি সড়কের হাটহাজারী থেকে ফটিকছড়ি পর্যন্ত প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনায় ঝরছে তাজা প্রাণ। সড়কটি সমপ্রসারিত হয়েছে কিন্তু ডিভাইডার না দেয়াতে প্রতিদিন মানুষ মরছে। তারা দ্রুত এ সড়কে ডিভাইডার দেয়ার দাবি জানান।
বোয়ালখালী প্রতিনিধি জানান, ঈদের দ্বিতীয় শুক্রবার বিকেল সাড়ে তিনটায় চট্টগ্রাম–কক্সবাজার সড়কের পটিয়া উপজেলার মনসার টেক এলকায় বাসের সাথে মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই চাচাতো ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে। নিহতরা হলেন উপজেলার পশ্চিম গোমদন্ডী এলাকার মো. ওসমানের ছেলে মো. হৃদয় (২২) ও ফোরকান বাদশার ছেলে মো. ইমরান। হৃদয়ের বাবা ওসমান বলেন, আমার ছেলে ঈদে একটি শার্ট কিনে দিয়েছিল। সেটি পড়ার জন্য বারবার অনুরোধ করেছিল। ঈদের পরের দিন পড়েছি। কিন্তু শার্টের বোতাম লাগানোর আগেই ছেলে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল। আমি ছেলেকে ছাড়া কী করে থাকবো?
জানা যায়, মোটরসাইকেল আরোহী হৃদয় ও ইমরান শান্তির হাট এলাকা থেকে বোয়ালখালীর দিকে যাচ্ছিলেন। এ সময় পটিয়া থেকে ছেড়ে যাওয়া চট্টগ্রামমুখী একটি যাত্রীবাহী লোকাল বাসের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে বাইক আরোহী দুজন ছিটকে পড়ে ঘটনাস্থলে মারা যায়। যাত্রীবাহী লোকাল বাসটি জব্দ করেছে পটিয়ার হাইওয়ে থানা পুলিশ।
মীরসরাই প্রতিনিধি জানান, মীরসরাইয়ে সড়ক পার হওয়ার সময় মোটরসাইকেলের ধাক্কায় বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. জানে আলম চৌধুরী (৭০) নিহত হয়েছেন। গত শুক্রবার সকালে ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের ঢাকামুখী অংশের সুফিয়ারোড এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত জানে আলম চৌধুরী মীরসরাই সদর ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ডের নওশা মিয়া চেয়ারম্যান বাড়ির মৃত হাফেজ আহম্মদের ছেলে।
নিহতের স্বজন সোহেল চৌধুরী বলেন, আমার কাকা পরটা আনার জন্য শুক্রবার সকালে সুফিয়ারোড এলাকায় নুর জাহান ক্লাবের সামনে তার ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি রেখে রাস্তার পূর্ব পাশে গিয়েছিলেন। রাস্তা পার হওয়ার সময় মহাসড়কের ঢাকামুখী অংশে একটি দ্রুত গতির মোটরসাইকেল তাকে ধাক্কা দিলে গুরুতর আহত হন তিনি। স্থানীয়রা উদ্ধার করে একটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। শুক্রবার মাগরিবের পর রাষ্ট্রীয় সম্মাননা শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। তিনি স্ত্রী, এক ছেলে ও মেয়ে সন্তান রেখে গেছেন। মীরসরাই সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শামসুল আলম দিদার বলেন, আমরা ঘাতক মোটরসাইকেলটি আটক করেছি। এ ঘটনায় মোটরসাইকেল চালক ও মোটরসাইকেলে থাকা আরোহীও আহত হয়েছেন। তাদের উদ্ধার করে চমেক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। জোরারগঞ্জ হাইওয়ে থানার ওসি সোহেল সরকার বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের বিষয়ে কেউ লিখিত অভিযোগ দেয়নি। দিলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সীতাকুণ্ড প্রতিনিধি জানান, ঈদ ও নববর্ষের ছুটিতে উপজেলায় পৃথক তিনটি সড়ক দুর্ঘটনায় শিশুসহ ৫ জন নিহত হয়েছে। অন্তত ১৭ জন গুরুতর আহত হয়েছেন। গত মঙ্গলবার বিকালে উপজেলার শীতলপুর আবুল খায়ের কারখানার গেট সংলগ্ন এলাকায় ও শনিবার রাতে বারআউলিয়া এবং ভাটিয়ারী বানুর বাজার এলাকায় এ দুর্ঘটনাগুলো ঘটে। পৃথক তিনটি দুর্ঘটনায় নিহতরা হলেন ফেনীর সোনাগাজী এলাকার বাসিন্দা মো. নুরের নবী শিমুল (২৪), কুমিল্লা চান্দিনার বাসিন্দা গৌতম নাথ (৫০), চট্টগ্রামের পতেঙ্গার বাসিন্দা উম্মে নুরাইয়া মেহজাবীন (১৩), সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়নের ফুলতলা এলাকার বাসিন্দা শাহাদাত হোসেন রাফসান (১৩) ও মানসিক ভারসাম্যহীন অজ্ঞাত (৩২) এক নারী। হাইওয়ে পুলিশ জানান, রাঙ্গামাটি থেকে ছেড়ে আসা ঢাকামুখী একটি প্রাইভেটকার গত শনিবার রাত ৯টায় মহাসড়কের বারআউলিয়া মাজার গেট এলাকা অতিক্রমকালে নিয়ন্ত্রণ হারায়। এ সময় প্রাইভেটকারটি মহাসড়কের পাশে থাকা একই পরিবারের ৫ পথচারীকে চাপা দেয় এবং মহাসড়কে বেশ কয়েকবার উল্টে গিয়ে স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা তিনটি প্রাইভেট কারের উপর ছিটকে পড়ে। দুর্ঘটনা পরবর্তীতে আহত পথচারী ও প্রাইভেট কারের যাত্রীদের উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পথচারী শাহাদাত হোসেন রাফসানের মৃত্যু হয়। অন্যদিকে রাত সাড়ে আটটায় মহাসড়কের ভাটিয়ারী বানুর বাজার এলাকায় ঢাকামুখী একটি লরি মানসিক ভারসাম্যহীন অজ্ঞাত এক নারীকে চাপা দেয়। এ সময় ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। এর আগে গত মঙ্গলবার বিকালে চট্টগ্রামমুখী গ্রামবাংলা পরিবহনের যাত্রীবাহী বাস বেপরোয়া গতিতে মহাসড়কের শীতলপুর আবুল খায়ের কারখানা গেট এলাকা অতিক্রমকালে একইমুখী পণ্যবাহী একটি ট্রাকের পেছনে সজোর ধাক্কা দেয়। এ সময় দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া বাসের সামনে থেকে চালক শিমুল লাফিয়ে নিচে নামলে বাসটি চালককে চাপা দিয়ে ঘটনাস্থল থেকে দেড়শ ফুট দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ে। দুর্ঘটনায় বাসের সামনের অংশে থাকা যাত্রী গৌতমের ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়। গুরুতর আহত হয় বাসে থাকা আরও দশ যাত্রী। দুর্ঘটনা পরবর্তীতে চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার রাতে আহত বাসযাত্রী মেহজাবীনের মৃত্যু হয়।
বারআউলিয়া হাইওয়ে থানার ওসি খোকন চন্দ্র ঘোষ জানান, পৃথক দুর্ঘটনায় দুই পথচারীসহ ৫ জন নিহত হয়েছে। দুর্ঘটনা পরবর্তীতে মহাসড়ক থেকে দুর্ঘটনা কবলিত গাড়িগুলো সরিয়ে থানায় এনে রাখা হয়েছে। নিহতদের মধ্যে চারজনের মরদেহ তার স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
চন্দনাইশ প্রতিনিধি জানান, চন্দনাইশে দ্রুতগতির কাভার্ডভ্যানের ধাক্কায় জাহাঙ্গীর আলম (৪০) নামে এক টেক্সিচালকের মৃত্যু হয়েছে। গত শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কের জামিরজুরী রাস্তার মাথা পেট্রোল পাম্পের সামনে এ ঘটনা ঘটে। নিহত জাহাঙ্গীর সাতকানিয়া নতুন চর খাগরিয়া এলাকার মৃত বকসু মিয়ার ছেলে। জানা যায়, শুক্রবার রাতে পটিয়ার একটি পেট্রোল পাম্প থেকে টেক্সিতে গ্যাস নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন জাহাঙ্গীর। জামিরজুরী রাস্তার মাথা এলাকায় পৌঁছলে বিপরীত দিক থেকে আসা দ্রুতগতির একটি কাভার্ডভ্যান টেক্সিটিকে ধাক্কা দিলে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এ সময় গাড়ির এক যাত্রীও গুরুতর আহত হয়। তাকে দোহাজারী হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। তবে তার পরিচয় জানা যায়নি। দোহাজারী হাইওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ খান মোহাম্মদ এরফান জানান, তিনি দুর্ঘটনার বিষয়ে অবগত হলেও এ ব্যাপারে পুলিশকে কেউ জানায়নি।
আনোয়ারা প্রতিনিধি জানান, আনোয়ারায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নুর মিয়া (৩৮) নামে এক নসিমনচালকের মৃত্যু হয়েছে। গত রোববার বিকেল সাড়ে পাঁচটায় জুঁইদন্ডী ইউনিয়নের আমিনার ঘাটা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত নুর মিয়া উপজেলার বটতলী ইউনিয়নের ওয়াপদারপাড়া গ্রামের লেদু মিয়ার পুত্র। এলাকাবাসীরা জানান, বটতলী রুস্তমহাট থেকে নছিমনে মালবোঝাই করে জুঁইদন্ডী যাওয়ার সময় দ্রুতগতির কারণে আমিনার ঘাটা এলাকায় গিয়ে চালক নিয়ন্ত্রণ হারালে গাড়িসহ উল্টে পড়ে যায়। এতে গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে গুরুতর আহত হয় নুর। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন।
আনোরা থানার ওসি সোহেল আহম্মদ জানান, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে জুইদন্ডী ইউনিয়নে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নুর মিয়া নামে এক নসিমনচালকের মৃত্যু হয়েছে। তবে এই ঘটনায় কোনো অভিযোগ পাইনি।