রমজান মাস আসলেই বা তার আগে থেকেই দ্রব্যমূল্য নিয়ে ব্যবসায়ী মহল, সরকার, প্রশাসন এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে চাঞ্চল্যের শুরু হয়। সিন্ডিকেটের কারচুপি কারসাজি বেড়ে যায়। উদ্দেশ্য একটাই বেশি মুনাফা করা। সরকার ও প্রশাসন চাই যেভাবে হোক দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রেখে সর্ব সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রেখে সাধারণ মানুষ যেনো কষ্ট না পায়। সেখানে বাজার নিয়ন্ত্রণে ভোক্তা অধিকার সংস্থার বিশেষ ভূমিকা থাকে। অন্যদিকে অসাধু ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফার লোভে দ্রব্যমূলের দাম বাড়ানোর সুযোগ খুঁজে। কারণ রমজানে স্বাভাবিকের চেয়ে খাদ্য চাহিদা বেড়ে যায়। এটা খুবই সত্য যে অভাবগ্রস্থ পরিবার দীনমজুর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা হয়ে যায়। তারা কিছুতেই চাহিদা মেটাতে পারে না। তাদের মলিন মুখ দেখলে কার না মায়া হয়। যত ব্যবস্থাই করুকনা কেন দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার পূর্বশর্ত হলো সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা। সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে হবে। যাতায়াত সুগম হতে হবে এবং মুনাফাখোরদের দমন করতে হবে। আমাদের দেশ আমদানী নির্ভর। যেহেতু ডলারের দাম বেশি ও উঠানামা করে তাতে জিনিসপত্রের দাম স্থিতিশীল রাখা যায় না।
তারপরেও যারা মানুষের অন্ন নিয়ে বেশি মুনাফা করতে চাই তাদের বুঝা উচিত এই পবিত্র মাহে রমজানের দিনে এটা গুনাহ, মহাপাপ। সব চেয়ে বেশি দোষী হলো যারা মজুতদারী করে। যারা দাম নিয়ে সিন্ডিকেট করে। মানুষ বা যে কোনও প্রাণী বেঁচে থাকে খাদ্য গ্রহণ করে। যে খাদ্য তার পুষ্টি যোগায়, দৈনন্দিন জীবনে কর্মকক্ষতা ঠিক রাখে। যারা এই মূল্য বৃদ্ধির জন্য দায়ী তাদের ক্ষমা নেই। ইহজগতে তাদের প্রায়শ্চিত্ত করতেই হবে। কারণ তারা দ্ররিদ্র জনগোষ্টির মুখের গ্রাস কেরে নিচ্ছে। তারা বোঝে না একজন অভুক্ত লোকের দীর্ঘশ্বাস কত মর্মস্পর্শী। আজ অতি মুনাফা করে রাতারাতি ধনী হওয়ার লোভে তারা এটা করছে। সেটা ক্ষণস্থায়ী, কোনওভাবে সে এ পাপ থেকে মুক্তি পাবে না। চিরকাল উপলব্ধি করে ও দেখে আসছি জিনিষের সরবরাহ বাড়লে পণ্যের দাম অটোমেটিক কমে যায়। সেখানে সিন্ডিকেট করেও লাভ হয় না। যেমন টমেটো কিছুদিন আগেও ৮০ টাকা ছিল। মৌসুমি সবজি হিসাবে উৎপাদন বেড়ে যাওযায় এখন ২০–৩০ টাকা বা আরো কমে পাওয়া যায়। এই ভাবে প্রতিটি উৎপাদশীল পণ্যের সরবরাহ বাড়লে দাম কমতে বাধ্য। সুতরাং উৎপাদন ও আমদানি বাড়াতে না পারলে মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা দুঃসাধ্য। সরকারের চেষ্টার শেষ নেই, মূল্যও বেঁধে দেওয়া গেছে তবুও কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। এবারে বাজার ঊর্ধ্বগতি হওয়ার কারণ ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধ, ইসরাইল–ফিলিস্তিনের যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীল অবস্থা। যেহেতু আমদানী নির্ভর দেশ আমরা বৈদেশিক মুদ্রার কথাও মাথায় রাখতে হবে। ভোক্তা অধিকার সংস্থা, খাদ্য মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং সর্বোপরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে এ ব্যপারে খেয়াল রাখার পরেও মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। দোকানে দোকানে ভোক্তা অধিকারের কর্মকর্তারা যাচ্ছেন। তদারকি করছেন মূল্য তালিকা টাঙাচ্ছেন। তারা সে স্থান ত্যাগ করার পরেই আবার দাম বাড়িয়ে নিচ্ছেন। যেনো লুকোচুরি খেলা চলছে। যারা অর্থবান তারা যদি একমাসের পণ্য একসাথে ক্রয় করে বাসায় নিয়ে যায় তারাও মজুদদারীর পর্যায়ে পড়ে। তাতে অন্য সাধারণ জনগণের ক্রয়ে অসুবিধা হয়। এর সাথে যোগ হয় ভেজাল, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্যের বেচাকেনা। এই জন্য শাস্তিও পাচ্ছে। তবুও কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। আরও কঠিন আইন হওয়া উচিত। তবে এই খানেই আমার একটা বক্তব্য হচ্ছে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ঠিক রাখার ও শৃংখলা বজায় রাখার জন্য জনগণ অর্থাৎ ক্রেতা সাধারণের একটা বিশেষ ভূমিকা আছে। বেঁধে দেওয়ার পরেও বিক্রেতা যখন দাম বেশি নিচ্ছে সে মুহূর্তে ক্রেতা সাধারণ একত্রিত হয়ে যদি কঠোর প্রতিবাদ করে তবে অনেকটা ঠিক হতে বাধ্য। আমাদের একটা স্বভাব প্রায় দেখা যায় ‘মাপ করে দাও’। এটার কারণে কোনও আইন কার্যকর হয় না সংশোধন হয় না। বেশ কয়েক বছর আগে ভারতে কোলকাতা শহরে একবার ট্রাম বাসের ভাড়া একপয়সা বাড়িয়েছিল। সেটার প্রতিবাদে সাধারণ জনগণ রাস্তায় বসে পড়ে রাস্তা বন্ধ করে দেয়। কর্তৃপক্ষ সেটা বাতিল করতে বাধ্য হয়। সুতরাং জনগণকে প্রতিবাদী হতে হয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় জনগণই সকল ক্ষমতার মালিক বলা হয়। আবার জনগণকেই কেন্দ্র করে রাষ্ট্রে সকল সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এ মুহূর্তে সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা। এখানে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে ভোক্তা অধিকার দপ্তরেরও বাজার নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেষ্টার ত্রুটি নেই। ১ ডজন লেবু ১ম রোজার আগের সন্ধ্যায় কিনলাম ৮০ টাকায় পরের সন্ধ্যায় সেটা হয়ে গেল ১৪০ টাকা। এটা মাল ধরে রাখার কারসাজিতে হয়। এখানে মন মানসিকতার প্রশ্ন দেখা দেয়। মন মানসিকতা পরিবর্তন না হলে। কিছুতেই কিছু হবে না। মুসলিম জাহানের কথা বলছি এই পবিত্র রোজার মাসে আরব বিশ্বসহ অন্যান্য মুসলিম দেশের কথা চিন্তা করুন– তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে জিনিসপত্রের দাম কার চেয়ে কে বেশি কমিয়ে রাখবে। শুধু সোয়াব কামাবার জন্য। আর আমাদের দেশে তার ঠিক উল্টো। মাহে রমজান আসলে ক্ষুদ্র থেকে সব বড় বড় ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফার লোভে খাদ্য দ্রব্য মজুত করে কৃত্রিম সংকট তৈরী করে। দেশের সর্বত্রই জনগণকে জিম্মি করে ব্যবসা করে। তাই জনগণের উদ্দেশ্যে বলা যায়। যেখানে অযৌক্তিক মূল্যস্ফীতি সেখানে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ গড়ে তোলুন। চিরকাল জনগণের শক্তিই প্রাধান্য পেয়েছে। জনগণের রায়কে উপেক্ষা করতে গিয়ে পাকিস্তান নামক দেশটি ১৯৭১ সালে দ্বিখণ্ডিত হয়েছে যেটা কখনো সম্ভব হতো না। আমরা বিশ্বাস করি জনগণ যদি সচেতন হয় যদি কার্যকর ভাবে সম্মিলিত হয়ে ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চালায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আসবেই। ব্যবসায়ীরা কিছুটা হলেও বিবেকবান হবেন। আল্লাহর ইবাদাত যারা করেন দেখেছি করোনা মহামারীতে যেখানে মানুষ মানুষের জন্য কেঁদেছে সেই ক্রান্তিলগ্নেও কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে ইমারজেন্সি ওষুধ থেকে শুরু করে সব জিনিষের উপর বেশি মুনাফা করেছে। আজ সময় এসেছে ব্যবসায়ীদের অযৌক্তিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। ভোক্তা অধিকারের পক্ষে কাজ করতে হবে। সব পণ্যের মূল্য তালিকা নির্ধারণ করে দিতে হবে। উদ্দেশ্য যেখানেই অনিয়ম, মজুতদারী, সেখানেই প্রতিবাদ। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য নিশ্চয়ই ভেঙে পড়বে। সর্বোপরি দ্রব্য মূল্য নিয়ন্ত্রণে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
লেখক: প্রাক্তন চিফ অ্যানাসথেসিও লজিস্ট, বাংলাদেশে রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম