যাকাত–ইসলামের ৫টি স্তম্ভের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্তম্ভ। একটি তাঁবুর যদি ৫টি খুঁটি থাকে, মাঝখানের খুঁটিটা হল যাকাত। ঈমান ও নামাজের পরেই যাকাতের স্থান। মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কালামে পাকে মোট ৮২ জায়গায় নামাজের কথা বলেছেন। আবার সাথে সাথে যাকাতের কথাও বলেছেন। তাই যাকাত ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্তম্ভ–যাকাত ফরজ হওয়ার পর কেউ যদি যাকাত আদায় না করে তার ভয়াবহ শাস্তির কথা বলা হয়েছে আল্লাহর কোরআনে। যাকাত গরিবের হক, অধিকার– এটি করুণা নয় বরং গরিব মানুষেরা যাকাত গ্রহণ করে যাকাতদাতাকে দয়া করেছেন, জাহান্নামের কঠিন শাস্তি থেকে বাঁচিয়েছেন। সূরা আয যারিয়াতের ১৯ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলছেন, ‘তাদের ধন–সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিত লোকদের অধিকার রয়েছে’। যাকাতের মোট ৮টি খাত রয়েছে, যেটি সূরা তাওবার ৬০ নাম্বার আয়াতে বর্ণিত আছে, ‘সাদাকা হচ্ছে ফকির–মিসকিনদের জন্য, এর (ব্যবস্থাপনায়) নিয়োজিত কর্মচারীদের জন্য, যাদের অন্তঃকরণ (দ্বীনের প্রতি) অনুরাগী (করা প্রয়োজন) তাদের জন্য, গোলামী থেকে আজাদ করার মধ্যে, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে, আল্লাহতায়ালার পথে ও মুসাফিরদের জন্য; এটা আল্লাহতায়ালার নির্ধারিত ফরজ, আল্লাহতায়ালা বিজ্ঞ, কুশলী। এই ৮টি খাত ছাড়া অন্য কোন খাতে যাকাত আদায় করা যাবে না। ফকির তারাই–যাদের ঘরে অন্তত চলার মত সম্পদ রয়েছে। মাসের ২০ দিন মোটামুটি চলে কিন্তু অন্য ১০ দিন চলা কষ্টকর হয়ে যায়। মিসকিন–তাদের কিছুই নেই, ভবঘুরে জীবনযাপন করে, আর যারা এর ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত তাদেরকে দেওয়া যাবে– তারা পারিশ্রমিক গ্রহণ করছেন, যাকাত নয়। ইসলামের প্রতি আকর্ষণ রয়েছে এমন অন্য ধর্মের লোকদেরও যাকাত দেওয়া যাবে, এর ফলে যদি তারা ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আসেন। তাই বলে নন–মুসলিমদের গণহারে দেওয়া যাবে না। দাসমুক্তি প্রথা এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে যারা অন্যায়ভাবে জালিমের কারাগারে বন্দি রয়েছেন তাদের মুক্তির জন্যে যাকাতের অর্থ প্রদান করা যেতে পারে। যারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে, যুদ্ধ করে যেমন: ফিলিস্তিনি মুজাহিদগণ ইসলাম বিরোধী শক্তি ইহুদীদের বিরুদ্ধে জিহাদে রত আছেন তাদের জন্য যাকাতের অর্থ দেওয়া যাবে। মুসাফিরদের জন্য– মুসাফির নিজ দেশে অনেক ধনী কিন্তু সফরে এসে ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে সর্বস্বান্ত হারিয়েছেন, তাদেরকেও দেওয়া যাবে– শরীয়ত এটা জায়েজ করেছেন। যাদের সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ কিংবা সারে বায়ান্ন তোলা রূপা কিংবা নিসাব পরিমাণ সম্পদ রয়েছে তাদের উপরে যাকাত ফরজ হয়। এখন কেউ যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা সত্ত্বে যাকাত আদায় করে না তাদের জন্য কঠোর শাস্তির উল্লেখ রয়েছে পবিত্র কালামে পাকে, যেমন: সূরা আত তাওবার ৩৪ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলছেন, ‘যারা সোনা, রূপা পুঞ্জিভূত করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদের কঠিন পীড়াদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও’। একই সূরার ৩৫ নং আয়াতে বলছেন, ‘যেদিন সোনা–রূপা জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে অথবা তা দিয়ে তাদের কপালে, তাদের পার্শ্বে ও তাদের পিঠে স্যাঁক দেওয়া হবে (এবং তাদের বলা হবে), এ হচ্ছে তোমাদের সেই সম্পদ যা তোমরা নিজেদের জন্যে জমা করে রেখেছিলে, অতএব যা কিছু সেদিন তোমরা জমা করেছিলে তার স্বাদ গ্রহণ কর’। যে সম্পদের যাকাত দেওয়া হয় না, তা অবশ্যই গচ্ছিত মাল, যা দ্বারা তার মালিককে কেয়ামতের দিন শাস্তি দেওয়া হবে। রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘সোনা রূপার মালিক যদি এর যাকাত আদায় না করে তবে কেয়ামতের দিন এই ধন–সম্পদকে আগুনের পাত বানানো হবে এবং জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে এর পরে এগুলো দ্বারা তার পার্শ্ব, ললাট ও পিঠে দাগ দেওয়া হবে। যখনই ঠান্ডা হবে পুনরায় তা উত্তপ্ত করা হবে এমন দিন যার পরিমাণ দুনিয়ার ৫০ হাজার বছরের সমান। এভাবে বান্দার পরিণতি জান্নাত বা জাহান্নাম নির্ধারিত না হওয়া পর্যন্ত শাস্তি চলতে থাকবে। যাবতীয় পাপের শাস্তি জাহান্নামে হবে, শুধুমাত্র যাকাত অনাদায়ে শাস্তি ছাড়া। যারা যাকাত আদায় করে না, তাদের শাস্তি কেয়ামতের মাঠেই দেওয়া হবে। হাজার হাজার কোটি মানুষের সামনে যাকাত অনাদায়কারীকে অপদস্থ করা হবে। তখন সেই ব্যক্তির জিন্দেগীর সমস্ত আমলগুলো কোন কাজে আসবে না। যাকাত কিংবা দানকারী ব্যক্তিকে আল্লাহতায়ালা বালা–মুসিবত থেকে রক্ষা করেন। আর এই দান আল্লাহতায়ালা ফুলিয়ে–ফাঁপিয়ে তার আমলনামায় ঢুকিয়ে দিবেন। আর গোপনে দানকারীরা আল্লাহর আরশের ছায়ায় স্থান পাবেন–যেদিন আল্লাহর আরশের ছায়া ছাড়া অন্য কোন ছায়া থাকবে না।
আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘সোনা ও চাঁদির (মালিকের) জন্য ধ্বংস অনিবার্য–এই কথা তিনি ৩ বার বলেন’। এটা সাহাবীদের জন্য খুবই কঠিন ঠেকে। তাই তারা প্রশ্ন করেন, ‘তাহলে আমরা কোন মাল ব্যবহার করব’? তখন ওমর (রাঃ) তাদেরকে বলেন, ‘আচ্ছা আমি তোমাদের জন্য জেনে নিব’। অতঃপর তিনি বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ), আপনার এই কথাটি সাহাবীগণের কাছে খুবই কঠিন বোধ হয়েছে। এবং তারা কি মাল ব্যবহার করবেন তা জানতে চেয়েছেন’। রাসূল (সাঃ) তখন বললেন–জিকরকারী জিহবা, শোকরকারীর অন্তর এবং দ্বীনের কাজে সাহায্যকারীনি স্ত্রী’। হযরত তাউস (রাঃ) বলেন যে, ‘কেয়ামতের দিন সঞ্চিত সম্পদ একটা বিরাট অজগর হয়ে সম্পদের মালিকের পেছনে ধাবিত হবে। ঐ সময়ে সাপটি তার পেছনে ছুটবে ও বলতে থাকবে, ‘আমি তোমার সঞ্চিত ধন’। অতঃপর সাপটি তার যে অঙ্গকেই পাবে ঐটাকেই কামড়ে ধরবে’।
রাসূল (সাঃ) থেকে বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত, ‘তিনি বলেন, যাকে আল্লাহতায়ালা সম্পদ দান করেছেন কিন্তু সে যাকাত আদায় করেনি, কেয়ামতের দিন তার সম্পদকে টেকো মাথা বিশিষ্ট বিষধর সাপের আকৃতি দান করে তার গলায় মালা পড়িয়ে দেওয়া হবে। সাপটি তার মুখের দু’পাশে কামড় দিয়ে বলতে থাকবে, আমি তোমার জমাকৃত সম্পদ। এরপর রাসূল (সাঃ) আল্লাহর কোরআনের এই আয়াতটি তেলওয়াত করেন, ‘আল্লাহতায়ালা নিজের অনুগ্রহ দিয়ে তাদের যে প্রাচুর্য দিয়েছেন, যারা তা আল্লাহর পথে ব্যয় করতে কার্পণ্য করে, তারা যেন এটা কখনো মনে না করে এটা তাদের জন্য কোন কল্যাণকর কিছু হবে; না, এ ‘কৃপণতা (আসলে) তাদের জন্য খুবই অকল্যাণকর, কার্পণ্য করে তারা যা জমা করেছে কেয়ামতের দিন অচিরেই তা দিয়ে তাদের গলায় বেড়ি পড়িয়ে দেওয়া হবে’। যাকাত অনাদায়কারীদের উদ্দেশ্যে সূরা দোখানের ৪৮ ও ৪৯ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলছেন, ‘অতপর তার মাথার উপর ফুটন্ত পানি ঢেলে দিয়ে শাস্তি দাও এবং আস্বাদন কর, তুমি তো ছিলে সম্মানিত, অভিজাত’। অর্থাৎ এটা দ্বারা প্রমাণিত হল যে, ব্যক্তি যে জিনিসকে ভালবেসে আল্লাহর আনুগত্যের উপর একে প্রাধান্য দিবে ওর দ্বারা তাকে শাস্তি দেওয়া হবে। ঐ মালদারেরা মালের মহব্বতে আল্লাহর ফরমান ভুলে গিয়েছিল। তাই আজ ঐ মাল দ্বারাই তাদেরকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। এই মাল, যা দুনিয়ায় সব থেকে বেশি প্রিয় এটা কেয়ামতের দিন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর প্রমাণিত হবে। ওটাকে গরম করে ওর দ্বারা কপালে, পিঠে ও পাশে দাগ দেওয়া হবে। রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি পেছনে সঞ্চিত ধন ছেড়ে যাবে, কেয়ামতের দিন তার ঐ ধন বিষাক্ত অজগর সাপের রূপ ধারণ করবে, যার চক্ষুদ্বয়ের উপর দুটি বিন্দু থাকবে। সাপটি মালদারের পেছনে ছুটবে, লোকটি তখন পালাতে পালাতে বলবে, তোমার অমঙ্গল হোক, তুমি কে? সাপটি উত্তরে বলবে, আমি তোমার জমাকৃত সম্পদ যা তুমি তোমার পেছনে ছেড়ে এসেছিলে’। শেষ পর্যন্ত সাপটি তাকে ধরে ফেলবে এবং তার হাত চিবাতে থাকবে, এরপর তার সারা দেহকে চিবাতে থাকবে (সহীহ বুখারী ৪৬৫৯, ইবনে হিব্বান, তাবারী)। আল্লাহতায়ালা যাকাত ফরজ হওয়ার পর আমাদেরকে যেন যাকাত আদায়ে মানসিকতা তৈরি করে দেন। আমিন।
লেখক: সভাপতি–রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল