উৎসবের ঘনঘটায় বৈশাখকে আমরা হত্যা করেছি অনেক দিন আগেই। শোকাবহ একুশকে টেনে নিয়ে এসেছি আনন্দ উৎসবের কাতারে। স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসকে পরিণত করেছি পোশাক–সর্বস্ব উন্মাদনায়। এবারে নাগরিক উন্মত্ততায় নিহত হয়েছে বসন্ত, তথা পহেলা ফাল্গুন। বর্ষপঞ্জী সংস্কারের কারণে দু’তিন বছর ধরে ভালোবাসা দিবসেই আসে পয়লা ফাল্গুন। উৎসবের এই কাটছাঁটে পুষ্প বিপণন কর্মকর্তাদের মাথায় হাত। এক ফুলে দুই উৎসব পালিত হলে তাদেরতো পথে বসতে হবে। নগরবাসী অবশ্য একদিনে উৎসব শেষ করে না। বিষাক্ত শহরে ভালোবাসার দৃশ্যমান বিজ্ঞাপনে প্রবৃত্ত হয় তারা। এবারে বিদ্যাদেবী সরস্বতীও মর্তে নেমে আসেন একই দিনে। যে কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষিত হয়। দেবীবন্দনা বা বসন্তবরণ– কোনটা রেখে কোনটা করি! সংকটে নগরবাসী। কিছু প্রতিষ্ঠান তাই চৈত্রের শেষ দিবসেই আয়োজন করে ফেলে বসন্ত বরণের উৎসব। পূর্ব পরিকল্পনা বা প্রস্তুতি ছাড়াই চলতি পথে সেরকম দু’একটি অনুষ্ঠান দেখা হয়ে যায়। তা নিয়ে দু’কথা বলব বলেই আজকের কলম ধরা।
নগরের স্বনামধন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে আয়োজিত বসন্ত বরণের উৎসবে লাল হলুদ ও বাসন্তী সাজে সুসজ্জিত হয়ে যোগ দেয় অগণিত নারী–পুরুষ–শিশু–কিশোর। সামিয়ানা, মঞ্চ ফুলে ফুলে সাজানো। অস্থায়ী দোকানে থরেথরে সাজানো মুখরোচক খাবার, আর মনোহারি দ্রব্যসামগ্রী। মূল্য তালিকা দেখে হাত দেয়া যায় না। তথাপিও দোকান খালি হতে সময় লাগে না। মঞ্চে অবিরাম উচ্চস্বরে চলছে সংগীতের মহড়া। সামনেই এক ঝাঁক নরনারী উন্মাতাল নৃত্য পরিবেশনায়।
স্বভাবতই মনে হতে পারে এ–এক নির্দোষ উৎসব। সাজসজ্জা, নাচ–গান, ভোজন ছাড়া উৎসব হয় কি করে? যে কথা বলতে এতো কথা, তা হলো এসবের কোনো কিছুতেই বাংলাদেশ নেই। গানগুলো বাংলা হলেও গায়ক গায়িকার অঙ্গভঙ্গি ও নৃত্যরত দর্শকদের আচরণ বাংলাদেশের কথা বলে না। খাবার দোকানে ফুচকা, চটপটি ছাড়া প্রচুর পরিমাণে ভিনদেশি খাবারের সমারোহ। স্মার্ট জাতি হিসেবে আমরা অবশ্য অনেক দিন আগেই এসব আত্মস্থ করে ফেলেছি। পশ্চিম আর বলিউডের মিশেলে এক অদ্ভুত সংস্কৃতি ধারণ করে চলেছি আমরা। আমাদের সন্তানেরা হয়তো এই উত্তরাধিকারই বয়ে নিয়ে যাবে পরের প্রজন্মের কাছে।
দানবের মতো বিশালাকৃতির শব্দযন্ত্রের তাণ্ডবে কানে তালা লেগে যাওয়ার উপক্রম। কারও কথা কেউ শোনে না। মঞ্চ আর মঞ্চের আশেপাশে নেচে গেয়ে যাওয়া আত্মস্বীকৃত শিল্পীরা ছাড়া আর কারও পক্ষে উৎসবের আয়োজনে সামিল হওয়ার জো নেই। যে কোন উৎসবের ক্ষেত্রেই অবশ্য এটা প্রযোজ্য। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বর্ষের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের পুনর্মিলন উৎসবে গিয়ে একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখী হতে হয়। সংগঠক, আয়োজকসহ নাচে গানে মঞ্চ মাতানোয় পারদর্শী কয়েকজন ছাড়া বাদবাকি সদস্যরা নিছক দর্শকে পরিণত হয়। মঞ্চ থেকে একটানা পরিবেশনার সঙ্গে ভেসে আসা গগন বিদারী শব্দের জন্য অনেককাল পর দেখা পাওয়া পাশের বন্ধুটির সঙ্গেও মন খুলে কথা বলা যায় না। এই ধারাটি এখন বেশ চলছে আমাদের সমাজে। আমরা শিক্ষিত নাগরিকরা পুনর্মিলনীর নামে প্রচুর অর্থব্যয়ে একের পর এক উৎসবের আয়োজন করি। প্রতি উৎসবের উপসংহারে ‘দেখা হবে বন্ধু’ বলে পরের উৎসবের জন্য শপথ গ্রহণ করি। কে বলবে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকার শীর্ষে থাকে আমাদের রাজধানী! নদীমাতৃক বাংলাদেশে প্রতিদিনের খবরে নদী মরার খবর আসে (মানুষের মৃত্যুর কথা আজ নাহয় না–ই বলি)। বনভূমি লোপাট হয়ে যায় রাতের আঁধারে। অতিকায় পাহাড় অদৃশ্য হয়ে যায় চোখের পলকে। আমাদের যুবকেরা বেঘোরে মারা পড়ে ভূমধ্যসাগরে, বসনিয়ার জঙ্গলে, সাহারা মরুভূমিতে। পোকামাকড়ের মতো জীবনযাপন করে কোটি কোটি শ্রমজীবী। উৎসব শেষে আমাদের উচ্ছিষ্ট কুড়িয়ে নিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করে তাদের অনেকে। অনেকে যত্রতত্র আমাদের ফেলে দেওয়া আবর্জনা পরিষ্কার করে পরিবারের অন্নের সংস্থান করে। এঁদোগলিতে পশুপাখির মতো বেড়ে উঠে তাদের সন্তানেরা। এসবের কোনো কিছুই আমাদের স্পর্শ করে না। উৎসবের আনন্দময় মুহূর্তেও আমরা তাই তাদের কাছে ভিড়তে দিই না। আমাদের সন্তানদের আমরা আমাদের মতো করেই বড় করছি। ওরাও আমাদের মতো করেই নিম্ন আয়ের মানুষদের দাবিয়ে রাখবে, আর সভাসমিতি ও কাগজে সমতা আর মানবাধিকারের খৈ ফোটাবে।
প্রকৃতপক্ষে দেশের সমাজের চলমান কোনো সংকট নিয়েই আমরা চিন্তিত নই, আমাদের সন্তানদের জন্য একটা বাসযোগ্য বিশুদ্ধ সমাজ গড়া নিয়েও আমাদের কোনো ভাবনা নেই। কারণ অনেকেই ইতোমধ্যে সন্তানদের উন্নত দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। অন্যরাও সে পথে হাঁটছে। আমার সন্তানকেও হয়তো ধরে রাখতে পারবো না। এদেশে থাকবে চাষাভূষোদের ছেলেমেয়েরা। ওদেরকে ওরাই দেখবে। আমরা কেবল উৎসব করে যাব, বিশেষ বিশেষ দিবসে বর্ণিল সাজে সজ্জিত হয়ে নেচে গেয়ে হাজার বছরের ঐতিহ্য বাঙালিয়ানার জয়গান করে যাবো।
পাঠক ভাবছেন, ধান ভানতে গিয়ে শীবের গীত গাইছি। এই উন্মাতাল উৎসবের অন্তরালের কথাটা হচ্ছে– চৈত্র শেষের সেই বসন্ত উৎসব উদযাপনের দিনে কাছ থেকে দেখা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মচারীরা কিন্তু বসন্তের পোশাকে সাজেন না। নাচে গানে সামিল হন না। নিত্যদিনের কাজই তাঁরা করে যান, বরং এদিন তাঁদের কাজের চাপ আরও বাড়ে। রঙিন পোশাকধারী সুবেশী নাগরিকদের হুকুম তামিল করার জন্য মধ্যযুগীয় কায়দায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তাঁদের, ছোটাছুটি করতে হয় তাঁদেরই নির্দেশে। আমরা যে কর্মক্ষেত্রে আর দশটা সাধারণ দিন হোক, আর উৎসবের দিনেই হোক, আমাদের অধঃস্তন মানুষগুলোর সঙ্গে ক্রমাগত অমানবিক আচরণ করি, তা কিন্তু আমরা বুঝতেই পারি না।
আমাদের জনপ্রতিনিধিগণ জাতীয় উৎসবের আগে ‘উৎসব সবার’ বলে বাণী দেন। সন্দেহ নেই উৎসবে সব ধর্মাবলম্বীর সম্পৃক্ততার কথা উচ্চারণ করেন তাঁরা। কিন্তু ‘সবার’ বলতে সব পেশা, সব শ্রেণীর মানুষকে নির্দেশ করা গেলেই উৎসব সার্বজনীন হয়ে উঠত। সেটা বোধহয় হবার নয়। অধীনস্থ কর্মচারী উৎসবস্থলে আমার পাশে এসে দাঁড়াবে, হাতে হাত রেখে গাইবে নাচবে, তা মেনে নেওয়ার মতো শিক্ষা আমাদেরকে দেওয়া হয় না।
বারো মাসে তেরো পার্বণ আমাদের সমাজে প্রাগৈতিহাসিক কাল হতেই বাঙালি সংস্কৃতির একটি প্রধান অনুষঙ্গ উৎসব। উৎসবই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। বাঙালি পৃথিবীর যে শহরেই বসত গড়ুক, প্রাণের উৎসবে সামিল হতে ভুল করে না। বাংলাদেশে যখন বসন্ত আসে উত্তরের অনেক দেশে তখন কনকনে ঠাণ্ডা। সব বাধা মাড়িয়ে প্রাণের উৎসবে মেতে ওঠে, বুকের গভীরে লুকিয়ে রাখা দেশটাকে অনুভব করে তারা। একইভাবে একুশ, স্বাধীনতা, বিজয়, বৈশাখ, ঈদ, পুজো কিছুই বাদ যায় না। কর্মব্যস্ত দিনপঞ্জী থেকে ঠিকই সময় বের করে মিলিত হয় ‘দেশী’ ভাই বোনদের সঙ্গে। দেশী পোশাকে, দেশী খাবার খেয়ে, দেশী নাচ গানে নেচেগেয়ে, কবিতা পড়ে তাক লাগিয়ে দেয় তারা অন্য দেশের মানুষদেরকে। সাদা কালো বাদামী নানা রঙের মানুষগুলো মনে করে– কতো না সুখি দেশের মানুষ ওরা! ওরা জানে না উৎসবের অন্তরালে লুকিয়ে আছে কতো না বীভৎস গল্পগাঁথা।
অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়