‘যে মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে লক্ষ মুক্তি সেনা দে না তোরা দে না সে মাটি আমার অঙ্গে মাখিয়ে দে না। রোজ এখানে সূর্য ওঠে আশার আলো নিয়ে হৃদয় আমার ধন্য যে হয় আলোর পরশ পেয়ে। সে মাটি ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে বলিস না’–গীতিকার নাসিমা খান ৭১–র শহিদ ও মুক্তি সেনাদের শ্রদ্ধা জানিয়ে কত আবেগ দিয়ে গানটি রচনা করেছেন গানটি শুনলে হৃদয় স্পর্শ করে। সত্যি একাত্তরের শহিদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে গানটি যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় স্বাধীন বাংলার বয়স আজ ৫২ পেরিয়ে ৫৩ চলছে। যাদের জন্য এই বাংলার মানচিত্র, লাল সবুজের পতাকা, মা মাটি মাতৃভূমি, মাতৃভাষা আমরা পেয়েছি, আমরা কি আজও পেরেছি তাঁদেরকে যথাযথভাবে সম্মান দিতে কিংবা তাঁদের স্মৃতি সংরক্ষণ করতে। দেশে আজও হাজার হাজার শহিদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধি, বধ্যভূমি অবহেলিত ও অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গোরস্থানে, কিংবা শ্মশানে খালে বিলে মাঠে রয়ে গেছে শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধি। এমনকি অনেকের সমাধি নিজ গ্রামে কিংবা নিজ থানায়, জেলায় নেই। যুদ্ধকালীন পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শাহাদত বরণ করার পর নিজ গ্রামে লাশটিও আনা হয়নি। যেখানে নিহত হয়েছে সেখানেই দাফন করা হয়েছে। পরিবার থেকেও খবরও রাখেনি কোথায় আছে যুদ্ধ শেষে বাড়ি না ফেরা যুবকটির কথা।
গত বছর দুয়েক ধরে ৭১–র মুক্তিযোদ্ধাদের কবর সংরক্ষণ করার মেয়াদ পূর্বে দুই দফায় বাড়ানো হলেও বিগত পাঁচ বছরে ৩ হাজার ৬০০ কবর সংরক্ষণ করা হয়েছে। চলমান আছে কিছু সমাধি। একটা পরিসংখ্যানে দেখা গেছে গত ২০২১ সালে ২০ হাজার সমাধি সংরক্ষণ করার কথা ছিল। নানা অজুহাতে নকশা সংশোধন এবং কবর চিহ্নিত করার নামে তালবাহানা করে প্রকল্পের কাজটি গড়িমসি করছে। সত্যি এটা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য বড়োই লজ্জার। ৩০ লক্ষ শহিদের রক্তের বিনিময়ে এই মহান স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি অথচ তাঁদের সমাধি সংরক্ষণের কথা আমরা ভুলতে বসেছি। অনেক শহিদ ও মুক্তিযোদ্ধা জাতীয়করণ হয়নি কেউবা কাগজপত্র না থাকার কারণে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের যে গেজেটেড তালিকা থেকেও বাদ পড়েছে। অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হয়েছে অথচ যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করেও সরকারি দলের প্রভাব খাটিয়ে এবং বড়ো অঙ্কের ঘুষ দিয়ে ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে মুক্তিযোদ্ধার সনদ সংগ্রহ করে রাতারাতি মুক্তিযোদ্ধা বনে গেছে। অনেক শহিদ ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবার আছে তাঁরা এখনো শহিদ ভাতা পান না। আমার জানামতে চট্টগ্রামে শহিদ–জায়া শহিদ–ভগ্নী বেগম মুশতারী শফির পরিবারটি শহিদ ভাতা পান না। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন বেগম মুশতারী শফির জীবনসঙ্গী ডা. মোহাম্মদ শফি ও মুশতারী শফির সহোদর খন্দকার এহসানুল হক আনসারী। একই পরিবারের দুজন সদস্য ৭১–র শহিদ। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই দুজন শহিদের একজনও শহিদ ভাতা পান না।
গত ২০১৮ সনে জুনের প্রথম দিকে একাত্তরের শহিদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যুর পর তাঁদের কবর সংরক্ষণ বাবদ ৪৬১ কোটি ব্যয় প্রকল্পটির সমাধি সংরক্ষণের কাজ শুরু হয়। প্রথম পর্যায়ে ২০ হাজার এবং পরবর্তীতে ৮৬ হাজার ৪০০ জন ৭১–র বীর মুক্তিযোদ্ধার কবর সংরক্ষণ করার কথা রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা ও শহিদদের কবরগুলো চিহ্নিত করে এপিটাফ জন্মমৃত্যু তারিখ, খেতাব এবং ঠিকানা ইত্যাদি উল্লেখ করা হবে। পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের সংক্ষিপ্ত পরিচিত বীরত্বপূর্ণ অবদানের কথা উল্লেখ থাকবে। কবরের নকশা কিংবা কবর চিহ্নিত করার বিভিন্ন ঝামেলার কারণে কাজে বিলম্বসহ অনেকে দায়িত্ব অবহেলা জনিত কারণেও কাজটি যথাযথাভবে হচ্ছে না। বজ্রপাতে নিহত হওয়া ব্যক্তির লাশ চুরি করার কথা শুনেছি। সমাধি সংরক্ষণের টাকা পকেটস্থ করার জন্য অনেক জায়গায় মুক্তিযোদ্ধাদের কবরে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করে সমাধির টাকা পকেটস্থ করেছে বলে জানা যায়। যার ফলে লালমনির হাট এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের কবরের সমাধি ফলক ভেঙে পড়ে গেছে।
পটিয়ায় সদর ৪নং ওয়ার্ডের একাত্তরের দুই শহিদের কবর আজও অরক্ষিত এবং অবহেলিত অবস্থায় আছে। শহিদ ছবুরের কবরটি কেলিশহরের ভট্টাচার্য হাট এলাকায় এবং শহিদ রফিকের কবরটি কাপ্তাই উপজেলার রাজস্থলী বাজার এলাকায়। এছাড়া ৪ নং ওয়ার্ডের বেশ কয়েকজন বীর মু্ক্িতযোদ্ধার কবর আজও সংরক্ষণ করা হয়নি। একাত্তরের শহিদ ও বীর মু্ক্তিযোদ্ধাদের সঠিক ইতিহাস, সমাধি এবং তাঁদের ব্যবহৃত আসবাবপত্র কিংবা যুদ্ধে ব্যবহৃত কোনো পোশাক কিংবা তাঁদের লেখা ডায়ারি ইত্যাদি সংরক্ষণসহ যেসকল এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা ও শহিদ রয়েছেন তাঁদের নামে সড়ক, পাঠাগার, কালভার্ট কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নতুন ভবন বা কক্ষের নামকরণ করা যেতে পারে। পাশাপশি যেসকল এলাকায় শহিদ রয়েছেন তাঁদের পোর্ট্রেট দিয়ে শহিদ এবং মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা জরুরি।
লেখক: প্রাবন্ধিক, গল্পকার, ব্যাংকার