মুক্তমনা, প্রগতিশীল রাজনৈতিক পরিবারে আজ থেকে ৯৩ বছর আগে ১৪ই মার্চ জন্মগ্রহণ করেন প্রগতির মশাল জ্বালিয়ে দেওয়া ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর আব্দুল্লাহ আল হারুন। ছাত্রাবস্থা থেকে তিনি ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। তিনি চট্টগ্রাম জেলা রাষ্ট্রভাষা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ছিলেন। ১৯৬৩ সালের শেষের দিকে বঙ্গবন্ধু আওয়ামীলীগকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নিলে অনেক আওয়ামীলীগ নেতা তার বিরোধিতা করতে থাকেন এমনকি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে বঙ্গবন্ধু আওয়ামীলীগকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়োজনীয়তা বুঝালে তিনি রাজি হননি। অন্যদিকে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামীলীগের নেতা এমএআজিজ ও আব্দুল্লাহ আল হারুন সবসময় আওয়ামীলীগের পুনরুজ্জীবনের পক্ষে ছিলেন। শত বিরোধিতা সত্ত্বেও চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামীলীগের সহযোগিতায় বঙ্গবন্ধু আওয়ামীলীগকে পুনরুজ্জীবিত করেন।
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা ঘোষণা করলে পাকিস্তানের দোসরদের পাশাপাশি অনেক আওয়ামী লীগ নেতা যখন ছয় দফার বিরোধিতা করতে লাগলো, ভয়ে অনেক আওয়ামী লীগ নেতা যখন চুপ হয়ে যায় তখন ছয় দফাকে সমর্থন করে পত্রিকায় বিবৃতি দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেন আব্দুল্লাহ আল হারুন। বঙ্গবন্ধুর সাথে পরামর্শ করে ১৯৬৬ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক জননেতা এম এ আজিজ সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল্লাহ আল হারুন, দপ্তর সম্পাদক এম এ হান্নান ও কোষাধ্যক্ষ জানে আলম দোভাষ এক যুক্তবিবৃতি দেন। এই বিবৃতিই ছিল ছয় দফার পক্ষে প্রথম সমর্থন। বাঙালির মুক্তির সনদ বঙ্গবন্ধুর ছয় দফাকে জননেতা আব্দুল্লাহ আল হারুনরা প্রথম সমর্থন এবং বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য তিনি যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সম্পাদিত ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্যা ন্যাশন শেখ মুজিবুর রহমান’ নামক সিরিজ পুস্তকের ৯ম খণ্ডের পৃষ্ঠা নং ২২০ ১০ম খণ্ডের পৃষ্ঠা নং ২০৪, ৩৬৯, ৩৭০, ৫৩৪ ও ১১তম খণ্ডের পৃষ্ঠা নং ৭৮ এ উল্লেখ আছে। ‘৭০ সালে আব্দুল্লাহ হারুন বিপুল ভোটে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৭১ সালে জহুর আহমদ চৌধুরী, এম আর সিদ্দিকী সহ তিনি মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারকে সহযোগিতা করার জন্য আগরতলার মুখ্যমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি উদয়পুর শরণার্থী শিবিরের এবং ১ নং সেক্টরের সমন্বয়কারী ছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করলে তিনি মাতৃভূমিতে ফিরে দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করলে তিনি চট্টগ্রাম জেলার বাকশালের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এর কালো রাত্রের পর বাংলাদেশের রাজনীতি চলে যায় খুনিদের নিয়ন্ত্রণে। চলে রাজনীতি কেনাবেচার প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে খেলা। সেই নষ্টের দলে অনেকে পা দিয়েছেন। ভয়–ভীতি লোভ লালসা উপেক্ষা করে যে কজন নেতা পা দেননি তাদের মধ্যে অন্যতম আব্দুল্লাহ আল হারুন।
বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিশোধ নিতে তিনি চট্টগ্রামের দ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দেন। সিদ্ধান্ত নেন ভারতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধের প্রস্তুতি নিয়ে বাংলাদেশ অপারেশন চালাবেন। এজন্য ১৯৭৫ সালের অক্টোবর মাসে ভারতীয় দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি মিস্টার দের বাসায় আবদুল্লাহ আল হারুন ও অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত গোপনে বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় আব্দুল্লাহ আল হারুনের নেতৃত্বে অন্যূন ৫০ জনের একটি দল ভারতে যাবে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে। তার সাথে এ কাজে যুক্ত হন তৎকালীন জাতীয় শ্রমিক লীগ নেতা এস এম জামাল উদ্দিন। গোপন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভারতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আব্দুল্লাহ আল হারুন। এমনই সময় স্বৈরশাসকের পুলিশবাহিনী তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিয়ে যায়। মুক্তিলাভের পর বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদে তিনি নিজ হাতে পোস্টার লিখেছেন। আওয়ামীলীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের কে অর্থ সহায়তার পাশাপাশি ন্যাপ এবং কমিউনিস্ট পার্টিকেও বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করার জন্য তিনি অর্থ সহায়তা করতেন।
আব্দুল্লাহ হারুন জানতেন বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে হলে আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করতে হবে। তাই তিনি আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করার জন্য চট্টগ্রাম জেলা ও শহর আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার চেষ্টা করেন। আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার জন্য তিনি গোপনে, ঘরোয়াভাবে এবং প্রকাশ্যে কাজ করতে থাকেন। ৭৫ পরবর্তী সময়ে জোহোরা তাজউদ্দীন চট্টগ্রামের যে জনসভাটি করেন তার মূল উদ্যোক্তা ছিলেন আব্দুল্লাহ আল হারুন।
কবি সাহিত্যিকদের সাথে ছিল তার নিয়মিত যোগাযোগ। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর কবি সাহিত্যিকদের বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ করার জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক মিনার মনসুর পঁচাত্তর ট্র্যাজিডি: সত্যের পথ এখনো কণ্টকাকীর্ণ কলামে লিখেছেন– ‘বঙ্গবন্ধুর তৃতীয় শাহাদাত বার্ষিকী স্মরণিকা হিসেবে ১৯৭৮ সালের ১৫ আগস্ট প্রথম প্রকাশ করি এপিটাফ। এ নামকরণের মূলেও ছিল বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিষাদময় পটভূমি। প্রচ্ছদে তুলে ধরা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর স্মরণীয় কিছু বাণী। পত্রিকাটির কাজ হচ্ছিল চট্টগ্রামের ঘাটফরহাদা বাদের কাকুলি প্রেসে। পুলিশ সেখানে হানা দেয় বন্ধ হয়ে যায় পত্রিকার কাজ। আমাদের হতাশা যখন চরমে তখনই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন আব্দুল্লাহ আল হারুন। সেই দুঃসময়ে হাতে–গোনা যে কজন আওয়ামী লীগ নেতা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বঙ্গবন্ধু ভক্ত নেতাকর্মীদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন নিজের বাস গৃহের দরজা হারুন ভাই তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। তিনি বৌদ্ধধর্মলম্বীদের একটি প্রেসে এপিটাফ মুদ্রণের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। নাম ছিল অগ্রসর প্রিন্টিং প্রেস। প্রকাশিত হয় এপিটাফ। এপিটাফ আমাদের সাহস বাড়িয়ে দেয়’। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করা ও আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করতে অবদান রাখার কারণে আব্দুল্লাহ আল হারুন ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মনোনীত হন। ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন।
৭৫ পরবর্তী সময়ে যখন বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব কর্মসূচি সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় শুধু নেতিবাচক নিউজ প্রচার করা হতো, আওয়ামী লীগের নিউজ বলতে তেমন কিছু ছাপানো হতো না ঠিক তখনই আব্দুল্লাহ হারুন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ তুলে ধরার জন্য চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক স্বাধীনতা পুনরায় চালু করেন।
১৯৯৪ সালে ১৫ই আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বিএনপির দুঃশাসনের কালে দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের ইতিহাস সম্বলিত লেখা নিয়ে ২০ পাতার ক্রোড়পত্র আকারে প্রথম সংখ্যা প্রকাশ করেন। এই ক্রোড়পত্রে হেডলাইন ছিল আজ জাতীয় শোক দিবস। দুর্ভাগ্যবশত সেই কপি ও অন্যান্য বহু প্রয়োজনীয় দলিল আগুনে বিনষ্ট হয়ে যায়।
১৯৯৪ সালে তিনি তার পুত্র ও কন্যা শামীমা হারুণ লুবনাসহ টুঙ্গিপাড়া জাতির জনকের মাজার জেয়ারতের উদ্দেশ্যে রওনা হন। কিন্তু মীরসরাইতে আসলে হাফিজ জুট মিলের সামনে রহস্যজনক ভাবে একটি ট্রাক তাদের পিছু নেয়। ট্রাকটি তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ধাক্কা দিলে ছেলে মেয়ে সহ আবদুল্লাহ আল হারুনকে বহনকারী ব্যক্তিগত গাড়িটি দুমড়ে মুচড়ে যায়। মারাত্মক ভাবে আহত হন তিনি ও তার কন্যা শামীমা হারুণ লুবনা। স্থানীয় হেলথ সেন্টারে নিয়ে পরে চট্টগ্রাম নিয়ে যাওয়া হয়। স্থানীয় বেতারের খবরে তাঁকে মৃত বলে খবর পর্যন্ত প্রচারিত হয়। আব্দুল্লাহ আল হারুন ১৯৭৯ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে রাউজান থেকে নির্বাচন করেন। তার প্রতি জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে ব্যালেট পেপার ছিনতাই, আওয়ামী লীগের এজেন্টদেরকে ভোট সেন্টার থেকে বের করে দেওয়া, আওয়ামী লীগ ও সংখ্যালঘু ভোটারদের নির্বাচন কেন্দ্রে যেতে না দেওয়ার মাধ্যমে তার বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে।
সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আব্দুল্লাহ আল হারুন। বনেদী পরিবারের এই সন্তান কোনও জমিদারী রক্ষার সংগঠন না করে করেছেন গরীব দুঃখী মেহনতী মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। ভাষাসৈনিক, স্বাধীনতার প্রথম দিকের মোহাজের, ছয় দফার প্রথম সমর্থনকারী, একাত্তরের যুব শিবিরের রাজনৈতিক প্রশিক্ষক ও ০১ নং সেক্টরের সমন্বয়কারী বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম রচয়িতা এবং ৭৫ পরবর্তী বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে দ্রোহের আগুন জ্বালানো এই মহান নেতা আমাদের মাঝে নেই তার স্মৃতি রক্ষার কোনও উদ্যোগও আমাদের মাঝে নেই। অনেকে স্বাধীনতার জন্য তেমন অবদান না রাখা সত্ত্বেও স্বাধীনতার পদক পেয়েছেন। কিন্তু খুবই দুঃখের বিষয় স্বাধীনতার পক্ষে অনন্য ভূমিকা পালনকারী আওয়ামীলীগের পুনরুজ্জীবনের অন্যতম উদ্দোক্তা ও ৬ দফার প্রথম সমর্থনকারী স্বাধীনতা সংগ্রামী আব্দুল্লাহ আল হারুন এখনো পাননি। তাই দ্রুততম সময়ে হলেও স্বাধীনতার সংগ্রামী আব্দুল্লাহ আল হারুনকে মরণোত্তর স্বাধীনতার পদক দিয়ে জাতির প্রতি তিনি যে অবদান রেখেছেন তার স্বীকৃতি দান করা সময়ের দাবি।
লেখক : সিনিয়র অফিসার, সোনালী ব্যাংক পিএলসি।