আন্তর্জাতিক গণিত দিবসে আমাদের প্রত্যাশা

ড. উজ্জ্বল কুমার দেব | বৃহস্পতিবার , ১৪ মার্চ, ২০২৪ at ৮:৪০ পূর্বাহ্ণ

লেখাটি যখন শুরু করেছি তখন আমি চট্টগ্রাম হতে সিলেটগামী পাহাড়িকা এক্সপ্রেসে শ্রীমঙ্গলের পথে। যাচ্ছি শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক আয়োজিত গণিত উৎসব২০২৪এ যোগ দিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার আমন্ত্রণে। এসে দেখি এ এক মহাযোগ্য। চার ক্যাটাগরির প্রায় আড়াই হাজার গণিতপ্রেমী শিক্ষার্থীর বিশাল সমাবেশ। উপজেলার প্রায় দুইশত শিক্ষক ও বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির একাডেমিক টিমের আটজন সদস্যসহ উপজেলা পরিষদের বিশাল বাহিনী এ কর্মযজ্ঞ সামলাতে ব্যস্ত। ভালো লাগে গণিতের প্রতি এই ভালোবাসা দেখে। একসঙ্গে আড়াইহাজার শিক্ষার্থী বসে গণিত পরীক্ষা দিয়েছে এমন একটা ইতিহাসেরও প্রথম সাক্ষী হলাম।

ছোটবেলা থেকেই আমরা যখন গণিতের কথা শুনি তখন এক ধরনের ভয় আমাদের মনে কাজ করে। কারণ অন্যান্য পড়াগুলো পড়তে যত না বেশি চিন্তা করতে হয়, গণিত পড়তে বসলে তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি চিন্তা করতে হয়। অঙ্ক স্যার এবং হোমওয়ার্কের কথা মনে পড়লে কোন কিছু অনুধাবন করার চিন্তাই মনে আসতো না। কেমন জানি ভয়ংকর একজন মানুষের চেহারা ভেসে ওঠে যিনি বেত হাতে এগিয়ে আসছেন। কিভাবে কোন রকমে সেই হোমওয়ার্ক শেষ করে, অঙ্ক স্যারকে দেখাবো সেই চিন্তাতেই দিন অতিবাহিত হতো।

অঙ্ক বাদে অন্য যেকোনো বিষয়ে পড়লে সেটাতে অবশ্যই কোন তথ্য মুখস্ত করতে হতো বা কোন তথ্য পাওয়া যেত। কিন্তু অংক করলে কোন তথ্য পাওয়ার ব্যাপার ছিল না। এক হতে বিশ পর্যন্ত নামতা মুখস্ত করতে গিয়ে এবং তা শিক্ষকের কাছে মুখস্ত দিতে গিয়ে বেতের বাড়ি খায়নি এমন ছাত্র কম পাওয়া যাবে। এথেকেই মূলত অঙ্কের প্রতি অনীহা শুরু হয় শিক্ষার্থীদের। ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি অঙ্ক মানে শুধু অনুশীলনের সমস্যাগুলো সমাধান করা। সাধারণত সমস্যাগুলো সমাধান শুরুর আগে অধ্যায়ের শুরুতে বিষয় সম্পর্কিত কিছু বর্ণনা ও সমাধানের নিয়মাবলী দেওয়া থাকে। এ বর্ণনাগুলো পড়ে দেখার যে একটা সংস্কৃতি সেটা আমাদের দেশের বাচ্চাদের নেই বা শিক্ষকরা সেটা কখনো পড়তে বলেন না। শিক্ষকরা বললেও শিক্ষার্থীরা সেটা পড়ে না। এটা একটি বড় সমস্যা গণিত না বোঝার ক্ষেত্রে। অন্য সমস্যাটি হলো কিছু কিছু শিক্ষার্থী না বুঝে অঙ্ক মুখস্থ করার চেষ্টা করে। একবার আমি এমন এক শিক্ষার্থীকে পেয়েছিলাম, যে সমাধানের অঙ্ক গুলো বড় বড় করে রিডিং পড়ছে আর মুখস্থ করছে। অনেকটা বাংলা বা সমাজ পড়ার মতো। বোঝার বা অনুধাবন করার কোন চেষ্টাই করছে না। ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে মুখস্থ করার ব্যাপারটি আমাদের শিক্ষার্থীদের মনোজগতে একটি স্থায়ী আসন করে নিয়েছে। কলেজ পর্যায়ে আমাদের দেশের গণিতের পাঠ্য বইগুলো দেখলে দেখা যায়, অঙ্কগুলোর পাশে কোনটি কোন বোর্ডে কতবার পূর্বে বিভিন্ন বোর্ডে আসছে তা সুন্দর করে উল্লেখ করা থাকে। ৯০ এর দশকে একটা প্রচলিত নিয়ম ছিল কিছু অঙ্ক এক বছর বাদে আরেক বছর আসবেই। এগুলোকে আমরা জোড় সাল ও বিজোড় সাল অঙ্ক বলতাম। এই ব্যাপারগুলিই সাধারণত মুখস্তকে এবং নকলকে উৎসাহিত করে থাকে। এ ধারা থেকে আমাদের বের হতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। এমনকি কারিকুলাম পর্যন্ত পরিবর্তন করতে হয়েছে। আর একটা ব্যাপার লক্ষ্যণীয় যে, স্কুলে এখনো অনেক শিক্ষক রয়েছেন যাঁরা তাঁদের নিয়মে অঙ্কটা সমাধান না করলে শিক্ষার্থীদের নম্বর দেবেন না। কিন্তু মূল ব্যাপার হল একটা অঙ্কের সমাধানটা বিভিন্নভাবে করা যায়। বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাথে যুক্ত থাকার কারণে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে কোন কোন শিক্ষার্থী আমরা যে নিয়মগুলো জানি তার বাইরেও অন্য সৃজনশীল নিয়মে সমস্যাটি সমাধান করেছে।

আজ আন্তর্জাতিক গণিত দিবস। বিশ্বের অনেক দেশে এখন এই দিবসটি বিভিন্ন গণিত বিষয়ক আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালন করা হয়। আসলে আন্তর্জাতিক গণিত সংস্থা বেশকিছু উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই দিবস উদযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রতিবছর এক একটি নতুন থিম নিয়ে উদযাপন করা হয়। এবারের থিম হচ্ছে ‘প্লেয়িং উইথ ম্যাথমেটিঙ’। ইউনেস্কো ‘প্লেইং উইথ ম্যাথমেটিক্স ফর সোসাইটি’ নামে একটি ওয়েবিনারের আয়োজন করেছে আজকের দিনে। বিশ্বের নানা প্রান্তিকের মানুষ অনলাইনে যুক্ত হবেন এটিতে। সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জায়গায় এটি উদযাপনের হার দিন দিন বেড়ে চলেছে। আন্তর্জাতিক গণিত সংস্থার ম্যাপ হতে দেখতে পাই বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের বিভিন্ন কার্যক্রম এ দিবসকে উদযাপনের জন্য। আন্তর্জাতিক এ সংস্থাটি বেশ কিছু উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এই দিবসটিকে উদযাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর কয়েকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে। যেমন: প্রান্তিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণিতভীতি দূরীকরণ; শিক্ষায় গণিতের গুরুত্ব সম্পর্কে সাধারণ জনগণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের অবহিতকরণ; বিজ্ঞানভিত্তিক একটি জাতি গঠনে গাণিতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা রাখা; লিঙ্গ বৈষম্য দূর করার জন্য মেয়েদেরও গাণিতিক সক্ষমতা বাড়ানো; একটি দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন ব্যবস্থা, টেলিযোগাযোগ এবং সর্বোপরি মানুষের মঙ্গলের জন্য একটি আধুনিক সমাজ গঠনে গণিতের যে ভূমিকা আছে তা মানুষকে অবহিত করা।

বর্তমান সরকার বাংলাদেশকে ডিজিটাল হতে যে স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে, তার মূল হাতিয়ার হল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ভালোভাবে জানার ও বোঝার জন্য গণিতের বিকল্প নেই। বর্তমান সরকার নতুন যে প্রায়োগিক কারিকুলাম গণিতের জন্য করেছে তা দেখে আশাবাদী হই। কিন্তু তারপরও গণিতের জন্য প্রেম এবং গণিত সচেতনতা তৈরি করার জন্য এই দিবসটিকে বিভিন্ন স্কুল, কলেজে ব্যাপকভাবে উদযাপনের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। অবশ্য একটি দিন উদযাপন করেই তো গণিত শেখা হয়ে যাবে না, বরং সারা বছরব্যাপী কিছু না কিছু কার্যক্রম আমাদের রাখতে হবে। গণিতের প্রতি সবার ভালোবাসা তৈরি হোক।

লেখক : অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সদস্য, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমন জানালা
পরবর্তী নিবন্ধরাজনীতিবিদ আব্দুল্লাহ আল হারুন