মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগ যাদের জমি আছে ঘর নেই তাদের জন্য ঘর নির্মাণ: আরো বেশি মাত্রায় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে অনুসরণীয় হওয়া উচিত।
পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের আসমানী কবিতায় রসুলপুরের আসমানীদের ছোট্ট বাড়ি সম্পর্কে এভাবে বর্ণনা দেয়া হয়েছে–
“বাড়ি তো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছানি,
একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি।
একটুখানি হাওয়া দিলেই ঘর নড়বড় করে,
তারি তলে আসমানীরা থাকে বছর ভরে।
সে সময়ে হয়তো আসমানীদের স্বপ্ন ছিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্প হতে নির্মাণ করে দেয়া বর্তমান মডেলের একটি সেমিপাকা বাড়ি। গ্রামীণ ফোন কোম্পানীর ঈদের জনপ্রিয় একটি বিজ্ঞাপনে ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ গানটি আমাদের সবার পরিচিত। ঈদে বাড়ি ফেরার ক্ষেত্রে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের অনুভূতিগুলোকে চিত্রায়িত করা হয়েছে এই বিজ্ঞাপনে। একটি বাড়ি ঘিরে একটি পরিবারের সদস্যদের পুরো জীবনের স্বপ্নগুলো আবর্তিত হয়। বাসস্থান মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে একটি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনন্য সাধারণ একটি প্রকল্পের নাম আশ্রয়ণ প্রকল্প। যার মাধ্যমে দেশের ভূমিহীন ও গৃহহীন এবং যার জমি আছে ঘর নেই এমন পরিবারের জন্য বাসস্থান নির্মাণ করা হয়। প্রকল্পটি মূলত জসীম উদ্দীনের সে আসমানীদের জন্য।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরেই ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন নোয়াখালী বর্তমান লক্ষীপুর জেলার রামগতি উপজেলার চরপোড়াগাছা গ্রামে ভূমিহীন–গৃহহীন, অসহায় ছিন্নমূল মানুষের পুনর্বাসন কর্মকান্ড শুরু হয়। ১৯৯৭ খ্রি. হতে ১৫ জানুয়ারি ২০২৪ খ্রি. পর্যন্ত আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/ সংস্থা হতে গৃহ নির্মাণের মাধ্যমে পুনর্বাসিত পরিবারের সংখ্যা ৮,৫১,৭০১ টি। প্রতি পরিবারে ৫ জন সদস্য ধরলে মোট পুনর্বাসিত জনসংখ্যা ৪২,৫৮,৫০৫ জন।
২০১৭ সালের দিকে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলায় সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে কর্মরত থাকাকালে এপিএ অনুযায়ী ১ বছরে আমার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৮ টি ভূমিহীন পরিবারকে ভূমি বন্দোবস্ত প্রদানপূর্বক কবুলিয়ত সম্পাদন করে দেয়া। এটুকু অর্জন কোন সহকারী কমিশনার (ভূমি) করতে পারলে তিনি জেলার রাজস্ব সম্মেলনে প্রশংসা পেতেন। সেসময় চকরিয়া উপজেলায় ভূমিহীন পরিবারের সংখ্যা ছিল প্রায় ৮,৫০০ টি। এপিএ অনুযায়ী এ পরিবারগুলোকে পুনর্বাসন করতে সময় প্রয়োজন ছিল ১৭৭ বছর। আবার নতুন করে ভূমিহীন পরিবার সৃষ্টি হলে প্রয়োজনীয় সময় আরো বেড়ে যায় অর্থাৎ যেটি অনেকটা অসম্ভব। অথচ মুজিব বর্ষ উপলক্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন দেশের একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না। সে অনুযায়ী জুন ২০২০ তারিখ পর্যন্ত দেশে ভূমিহীন ও গৃহহীন এবং যার জমি আছে ঘর নেই/ জরাজীর্ণ পরিবারের সংখ্যা ৮,৮৫,৬২২ টি। তখন ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য গৃহ প্রদান নীতিমালা, ২০২০ প্রণয়ন করা হয়। সে অনুযায়ী ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের প্রত্যেককে (স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের নামে যৌথ দলিলে) ২ শতক সরকারি খাস জমি বন্দোবস্ত প্রদানপূর্বক দ্বি–কক্ষ বিশিষ্ট সেমি–পাকা গৃহ নির্মাণ করে গৃহের মালিকানা প্রদান করা হয় ২,৫৮,৫৬৫ টি পরিবারকে। বিনামূল্যে মালিকানাসহ এতগুলো পরিবারকে ঘর নির্মাণ করে দেয়ার রেকর্ড বিশ্বে দ্বিতীয়টি আর নেই। অসম্ভব একটি বিষয়কে সম্ভব করলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে কর্মরত থাকাকালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় হতে দুর্যোগ সহনীয় ঘর নির্মাণের সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। নোয়াখালীর যে উপজেলায় আমি উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে কাজ করছিলাম সেখানে মোট ২৪ টি ঘরের বরাদ্দ পেয়েছিলাম। মাননীয় সংসদ সদস্যসহ সকলের সাথে সমন্বয় করে ২৪ টি উপকারভোগী পরিবার বাছাইয়ের সুযোগ হয়েছিল । এদের মধ্যে ৩ সদস্যের একটি পরিবার ছিল। এই পরিবারের সবচেয়ে বড় সদস্য মেয়েটি আলিম ১ম বর্ষে পড়ত, মেজ মেয়ে ৯ম শ্রেণিতে এবং ছোট ছেলে ৭ম শ্রেণিতে একই মাদ্রাসায় পড়ত। তাদের মা–বাবা কেউ বেঁচে নেই। একজন ধর্ণাঢ্য ব্যক্তির আর্থিক সহায়তায় তাদের পড়ালেখা ও সংসারটি কোনমতে চলছিল। তাদের ভিটেটিই ছিল তাদের একমাত্র সম্বল। বছর দু এক ধরে এই ভিটেটিই দখলের অপচেষ্টায় ছিলেন তাদের চাচারা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই দুর্যোগ সহনীয় ঘরটি নির্মাণের সময় মনিটরিং এর অংশ হিসেবে বিভিন্ন পর্যায়ে আমি, সহকারী কমিশনার (ভূমি), উপজেলা প্রকৌশলী, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বারের যাওয়া–আসা হয়। তাছাড়া একবার জেলা প্রশাসক মহোদয়ের উপজেলা পরিদর্শনের কর্মসূচির মধ্যে এটিকে রাখা হয়। ঐ উপজেলার ২ জন মাননীয় সংসদ সদস্যকে এ ঘরটি ভিজিটে নিয়ে যাওয়া হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নামে একটি ফলক ঘরের সম্মুখে লাগানো হয়। এসব কিছুর পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে অপদখলের হাত থেকে এই এতিম পরিবারটি রক্ষা পায়। একটি সম্ভাব্য অপদখলের হাত থেকে কোন ধরনের সালিশ–বিচার অথবা আইন–আদালতের আশ্রয় নেয়া ব্যতীত ঐ এতিম পরিবারটি রক্ষা পেয়েছিল।
সরকারি পর্যায়ে ভূমিহীনদের ভূমিসহ ঘর নির্মাণ করে দেয়া যতটা সহজ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে তত সহজ নয়। সেক্ষেত্রে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের পক্ষ হতে গৃহহীনদের নিজের জায়গায় ঘর নির্মাণে ব্যর্থ পরিবারগুলোকে ঘর নির্মাণ করে দেয়ার উদ্যোগ নিতে পারে। আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে সাধারণ একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় যে, নিজ বসতি ছেড়ে না যাওয়ার এমনকি ঘূর্ণিঝড়ের সময়ও। মানুষের মধ্যে তার জন্মের এই আতুঁড় ঘরের প্রতি ভালবাসার কারণে পাশের পাড়া বা মহল্লায় পর্যন্ত নতুন করে বাড়ি করার ক্ষেত্রে অনীহা দেখা যায়। সাধারণভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন– কালবৈশাখী, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ইত্যাদি কারণে মানুষ গৃহহীন হতে দেখা যায়। আবার অগ্নিকাণ্ডের কারণেও গৃহহীন হতে দেখা যায়। দীর্ঘদিন অর্থাভাবে ঘর মেরামত করতে না পারার কারণে ঘরটি জরাজীর্ণ অবস্থায় চলে যায়, লোকসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে নতুন ঘর নির্মাণের আবশ্যকতা তৈরি হয়। দারিদ্রের দুষ্টচক্রের আঘাতে নতুন নতুন কিছু গৃহহীন পরিবার সৃষ্টি হচ্ছে।
দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় দেখেছি অনেক ব্যক্তির আর্থিক সামর্থ্য হয়তো নেই কিন্তু তিনি তার ব্যক্তিত্ব, সততা, পরিশ্রমের কারণে অনেক ব্যক্তির সাথে সমন্বয় করে গৃহহীন পরিবারকে ঘর নির্মাণ করে দিয়েছেন। এভাবেও দেখেছি কেউ ইট, কেউ সিমেন্ট, কেউ বালি, কেউ টিন, কেউ রড এমনকি কেউ কিছু আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে ঘর নির্মাণের জন্য। অর্থাৎ উদ্যোগ এবং সদিচ্ছার কারণেও এ ধরনের সমস্যা লাঘব করা যায়। মুজিব বর্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দেশকে গৃহহীনমুক্ত করার ঘোষণাটি অনুসরণ করে অনেক ব্যক্তি, দপ্তর, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, ফাউন্ডেশন এবং সংগঠন গৃহহীন পরিবারকে ঘর নির্মাণ করে দিয়েছেন।
মুজিব বর্ষ উপলক্ষে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদও নিজস্ব অর্থায়নে ১ম পর্যায়ে ৫০ টি ও ২য় পর্যায়ে ১০ টি অর্থাৎ দুটি পর্যায়ে মোট ৬০ টি ঘর নির্মাণ করে দিয়েছে। ১ম পর্যায়ের প্রতিটি ঘরের বরাদ্দ ৫,৯৮,৭৮৭ টাকা এবং ২য় পর্যায়ে নলকূপ বাদ দিয়ে প্রতিটি গৃহের নির্মাণ ব্যয় ৪,৭৫,১৬৬ টাকা। এ ঘরগুলো মোটামুটি মজবুত ঘর। চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের এ প্রকল্পের নাম দেয়া হয়েছিল ‘জমি আছে ঘর নেই’ প্রকল্প।
সিলেটের ইসলামপুর এলাকায় প্রায় আট একর জায়গাজুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে ‘কাজি ক্যাসল’ যার নির্মাণ ব্যয় প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। নানা বৈশিষ্ট্যে অনন্য এই আলোচিত বাড়িটি। পত্র পত্রিকায় এমনও সংবাদ চোখে পড়েছে সে বাড়িতে থাকার কেউ নেই, থাকেন শুধুমাত্র কেয়ারটেকার। এ বাড়িটি যদি ১০ কোটি টাকায় করা হতো এবং বাকী টাকা দিয়ে প্রতি পরিবারকে ৩ লক্ষ টাকার মূল্যের বাড়ি নির্মাণ করে দিলে ৯,৬৬৬ টি পরিবারকে বাড়ি নির্মাণ করে দেয়া সম্ভব হতো। বর্তমানে কিছু কিছু দৃষ্টিনন্দন বিলাস বহুল বাড়ি শহর ও গ্রাম এলাকায় দেখা যায়। আমার নিজের এলাকায় একটি বাড়ি শুনা যায় ১০–২০ কোটি টাকা দিয়ে নির্মাণ করা। থাকার জন্য একটি বাড়ি এত টাকায় নির্মাণ আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা? সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো গ্রামের এসব বাড়িগুলোতে বাড়ির মালিকরা স্থায়ীভাবে বসবাসও করেন না। জসীম উদদীনের আসমানীদের জন্য মুজিব বর্ষের মডেলে নতুন বাড়ি নির্মাণ করতে বর্তমানেও ৩ লক্ষ টাকায় যথেষ্ট। গ্রামের অভিজাত এ বাড়িগুলোতে ব্যয়িত প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা দিয়ে কতগুলো পরিবারকে বাড়ি নির্মাণ করে দেয়া সম্ভব তা ভেবে দেখা যেতে পারে। মাঝে মাঝে দেখা যায় কিছু কিছু শিল্পগ্রুপ অথবা বিত্তশালী ব্যক্তিরা তাদের এলাকার কিছু কিছু গরীব লোকজনকে হজ্জ করতে পাঠান। তবে এসব লোকেদের জন্য হজ্জ ফরজ হওয়ার কথা নয়। যদি এর স্থলে প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় গৃহহীন পরিবারকে ঘর নির্মাণ করে দেয়া যায়, তবে এটি ঐ পরিবারগুলোর জন্য বিশাল একটি প্রাপ্তি হতে পারে। আমার নিজ এলাকায় এমনও দেখেছি এক ব্যক্তি যাকাতের টাকা দিয়েই ১১ টি বাড়ি নির্মাণ করে দিয়েছেন। এ রমজানে যাকাত প্রদানের ক্ষেত্রে আমরা বিষয়টি ভেবে দেখতে পারি। এ ঘর পাওয়ার আনন্দ আসলে আসমানীরা ভাল বুঝতে পারে। ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন হতে গৃহহীন পরিবারগুলোর জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপহারের মত স্বপ্নের ঠিকানাগুলো নির্মাণ করে দিতে পারলে বাংলাদেশ অনন্য উচ্চতায় পৌঁছাবে বলে আমার বিশ্বাস।
লেখক : প্রাবন্ধিক; নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা পরিষদ, চট্টগ্রাম।











