দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ১৩ মার্চ, ২০২৪ at ৮:৩১ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

টেলিফোনের শব্দে ঘুম ভাঙলো। কয়টা বাজে দেখার আগেই ঘুম ঘুম চোখে ফোন রিসিভ করলাম। ম্যাসেঞ্জারে কল করেছে আমার স্কুল জীবনের বন্ধু স্বপন। স্বপন বহু বছর ধরে হংকং থাকে। পরিবার পরিজন নিয়ে বেশ ভালোই আছে। ঝটিকা হংকং সফরে আসার সময় স্বপনের কথা মনে পড়েছিল আমার। এখানে এসেও তার কথা খুব মনে পড়ছিল। তবে কি অবস্থায় আছে তাই ফোন করে বিব্রত করতে চাইনি। কারণ আমি জানি যে, বিদেশ মানেই ব্যস্ততা। আমাদের মতো অফুরন্ত সময় তাদের নেই। রাতে দিনে ছুটাছুটি করে তাদের প্রবাসের জীবন কাটাতে হয়। অনেক সময় ইচ্ছে থাকলেও কাউকে এক ঘন্টা সময় দিতে পারে না। দায়িত্বের তাড়ায় পেছনে ফেরার সময় পায়না। চাকরি বাকরি যারা করেন তাদের অবস্থা আরো শোচনীয়। ঠিকভাবে ছুটি ম্যানেজ করতে পারেন না। কাজপাগল জাতির চাকরি করলে সমস্যা আরো বেশি হয়। চীন জাপান কিংবা হংকংয়ে যারা চাকরি করেন তাদের অবস্থা কাছ থেকে না দেখলে প্রকৃত অবস্থা বিশ্বাস করা কঠিন।

ফেসবুকে আমার হংকং উপস্থিতি জানতে পেরে স্বপন নিজ থেকে ফোন করেছে। প্রথমে সে একচোট নিল। বেশ বকাঝকা। হংকং এসে তাকে ফোন না করায় ভীষণ ক্ষেপলো সে। বললো, তোকে ভিসা দিয়েছে কে? এসে কোথায় বসে আছিস? আমার বাসা থাকতে কোথায় থাকছিস? বন্ধুর আন্তরিকতায় আমার ভিতরটা গলে যাচ্ছিলো। আহা, কী বন্ধুভাগ্য নিয়েই না পৃথিবীতে এসেছিলাম। পৃথিবীর দেশে দেশে বন্ধুরা যা আমার জন্য করে তার ঋণ কি একজনমে শেষ করা যাবে! তার সব প্রশ্নের উত্তর দিলাম। সে কিছুটা শান্ত হয়ে বললো, মনে হয় ঘুমাচ্ছিস। উঠে রেডি হও। আমি আসছি। এক ঘন্টা লাগবে। আমি কিছু বলার আগেই সে ফোন রেখে দিল। অর্থাৎ তার কথাই ফাইন্যাল।

ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলাম। আমার বন্ধু সোফায় বসে টিভি দেখছেন। আমাকে দেখে হাসলেন। ঘুম হয়েছে কিনা জানতে চাইলেন। ভাবীকে নাস্তা লাগাতে বললেন। আমি বুঝতে পারলাম যে, ওনাদের ঘুম আগে ভেঙেছে। তবুও আমার জন্য নাস্তা না করে বসে আছেন। কিছুটা লজ্জিত হয়ে বললাম, আপনারা নাস্তা করে ফেলতে পারতেন!

তিনি হাসলেন। বললেন, আপনাকে রেখে নাস্তা করি কিভাবে!

নাস্তা করতে করতে বললেন, আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। অফিসে যাবো না। ড্রাইভারকে নিয়ে আপনি যেখানে যেখানে যেতে চান যেতে পারেন। সে আপনাকে সবকিছু দেখিয়ে আনবে। দুপুরে বাসায়ও খেতে পারেন, কোন হংকং রেস্টুরেন্টেও সারতে পারেন। ড্রাইভার সব চিনে। তাকে ডিটেইলস বলে দেয়া আছে।

আমি স্বপনের কথা বললাম। আমার এই বন্ধুও স্বপনকে চিনেন এবং খুবই ভালো সম্পর্ক। তিনি অমত করলেন না। তবুও বললেন, স্বপনকে গাড়ি আনতে না করে দিন। আমার গাড়ি নিয়ে যান। ড্রাইভারতো সারাদিনই বসে থাকবে। স্বপনের গাড়ি পরিবারের কাজে লাগবে। তার ছোট বাচ্চা রয়েছে। বউও চাকরি করে।

আমি স্বপনকে ফোন দিয়ে উবার নিয়ে চলে আসতে বললাম। আমার বন্ধু যা বলেছেন, তাই অনেকটা কপি করে স্বপনকে জানিয়ে দিলাম। স্বপন মাথা নাড়লো কিনা বুঝতে পারলাম না। বললো, আমি আসছি।

ঠিক এক ঘন্টার মাথায় এসে হাজির হলো স্বপন। কি করে যে এমন সময় ধরে চলা যায় কে জানে! হংকংয়ের রাস্তায় এতো গাড়ি। তবুও আপনি ঠিকই সময় ধরে চলতে পারবেন। আমাদের রাস্তার মতো অনাচার নেই বলেই হয়তো সম্ভব।

ঘরে ঢুকেই স্বপন আবারো একচোট নিলো আমাকে। বড়লোক বন্ধু পেয়ে তাকে ভুলে গেছি টাইপের কথাবার্তা বলতেও ছাড়লো না। ভাবী তাকে নাস্তা করতে বললেন। স্বপন শুধু এক কাপ চা খেতে চাইলো। আমাদের তিনজনকেই আবারো চা দেয়া হলো।

স্বপনের সাথে ঘর ছাড়লাম। সে বললো, গাড়ির খুব বেশি দরকার নেই। তোকে আমি জাহাজে চড়াবো। বিমানে চড়ে এসেছিস, গাড়ি নিয়ে ঘুরছিস, এবার জাহাজ দেখ। আমি যেনো আকাশ থেকে পড়তে লাগলাম। জাহাজে চড়ে আবার কোথায় যাবো!

গাড়ি ছুটছিল। আবারো সেই পথ ধরে। যে পথে গত কদিন ধরে আসা যাওয়া করছি। স্বপন ড্রাইভারকে কি একটা জায়গার নাম বলে দিল। গাড়ি ওপথ ধরলো। আমরা গল্পে গল্পে সময় কাটাতে লাগলাম। স্বপন আমার হাত তার হাতের মুঠোতে নিয়ে বলতে লাগলো, কতদিন পর তোর সাথে দেখা। স্কুল জীবনের নানা কাহিনীও সে মনে করিয়ে দিতে লাগলো। আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম যে, স্বপন দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে থাকলেও দেশের মায়া একেবারেই ছাড়তে পারেনি। বালকবেলার নানা স্মৃতি রোমন্থন করে সে অন্যরকমের তৃপ্তি পাচ্ছিলো।

গাড়ি থামলো। স্বপন ড্রাইভারকে বাসায় চলে যেতে বললো। আমরা সামনের দিকে হাঁটতে লাগলাম। আশপাশে প্রচুর ভবন, বহুতল। দোকানপাট। রকমারি পণ্যের পসরা দোকানগুলোতে। স্বপন আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে ‘এক মিনিট’ বলে কোথায় যেনো গেলো। একটু পরই সে ফিরে এলো দুইটি টিকেট নিয়ে। জাহাজের টিকেট। বললো, এখন আমরা জাহাজে চড়ে ওপাড়ে যাবো। তোকে ভিক্টোরিয়া পার্ক এবং সেন্ট্রাল দেখাবো। আলাদা দ্বীপ। তবে গাড়িতেও যাওয়া যায়। কিন্তু তোকে জাহাজে চড়ানোর জন্যই এই পথ ধরলাম।

আমি তার হাতে চাপ দিলাম, মানে ধন্যবাদ।

জেটিতে অনেকগুলো জাহাজ নোঙর করা। ইয়ট টাইপের। ডিজাইনে বেশ নজরকাড়া ভাব আছে। জাহাজগুলো বেশ চকচক করছে। বর্ণিল। জেটি এলাকাটিও বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। আমরা টিকেট দেখিয়ে একটি জাহাজে চড়ে বসলাম। জাহাজের ভিতরে সারিবদ্ধ চেয়ার। চেয়ারগুলোও বেশ আরামদায়ক। পর্যটন আসলে একটি চেইন। একটির সাথে অপরটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। একটিকে বাদ দিয়ে বা অবহেলা করে অন্যটিতে সফলতা আসেনা। ভিক্টোরিয়া পার্ক হংকংয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন স্পট। এখানে যাওয়ার ব্যবস্থাটা যদি সুন্দর বা গোছানো না হতো তাহলে পার্কটি এমন জনপ্রিয় হতো না। আমাদের পার্বত্যাঞ্চলে প্রচুর পর্যটন স্পট রয়েছে। এগুলোর সম্ভাবনাও অনেক। কিন্তু যাওয়ার কষ্টে মানুষ যেতে চায় না। আমাদের সবচেয়ে বড় পর্যটন স্পট কঙবাজারে যাওয়ার দুর্ভোগ কমানো গেলে আরো বেশি সফলতা আসতো।

জাহাজ চলতে শুরু করেছে। সাগরের ঢেউয়ের তালে তালে জাহাজটি এগুচ্ছে। বেশ দূরের পথ নয়। আধাঘন্টার মধ্যেই আমরা অপর পাড়ে নেমে পড়লাম। জাহাজ থেকে নামার পর আমার মন ভরে গেলো। কী যে শান্তি চারদিকে! ছায়াঢাকা পাখীডাকা পরিবেশ মনে হয় একেই বলে। চমৎকার রাস্তা। পিচ নয়, টাইলসের মতো। তকতকে ঝকঝকে। রাস্তার দুইপাশসহ পুরো পার্ক জুড়ে হাজার হাজার গাছ। রাস্তার পাশে কত ধরনের ফুল যে ফুটে আছে। আহা, ফুলের রঙও এমন সুন্দর হয়!

আমরা হাঁটছিলাম। হাঁটছেন আরো অনেকেই। অসংখ্য নারী পুরুষ হেথায় হোথায় বসে আছেন। রাস্তার পাশে গাছের ছায়ায় টেবিল পাতা। টেবিলের ডিজাইনেও বেশ নান্দনিকতা রয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে কাহিল হয়ে বসে আছেন অনেকেই। টেবিলের পাশে ফুলের গাছ। থোকায় থোকায় ফুল। ঘ্রাণও আসছে। একজনকে দেখলাম, চোখমুখ ঢেকে বসে বসে ঘুমুচ্ছে। কী যে শান্তি!

পার্কের ভিতরে শুধু হাঁটা নয়, খেলার মাঠও রয়েছে। টেনিশ কোর্ট। তবে কাউকে খেলতে দেখলাম না। বিকেলের দিকে খেলাধুলা জমে উঠে বলে জানালো স্বপন। ওমা এরা কারা? পুরো মাঠ জুড়ে শত শত তাবু। ছোট ছোট বর্ণিল তাবু মাঠে পাতা হয়েছে। তার ভিতরে শুয়ে আছেন অনেকেই। স্বপন আমার হাতে চাপ দিয়ে তাবুর দিকে বেশি না তাকানোর পরামর্শ দিলো। এরা কী হোমলেস? এত তাবু কেন? স্বপন বললো, হোমলেস নয়। এরা আউটিং করতে এসেছে। কেউ কেউ ডেটিং করছে। আমি বেশ বুঝতে পারলাম যে, হংকংয়ের একটি বিখ্যাত কোম্পানি আমাদের ইপিজেড এ এত তাবু কেন বানায়! কাউকে কাউকে দেখলাম বড় সাইজের রঙিন ছাতা টাঙ্গিয়ে তার নিচে বাচ্চাকাচ্চাসহ বসে আছেন। নিজেদের মতো করে খাওয়া দাওয়া এবং গল্পগুজব করে সময় কাটাচ্ছেন। কচি কচি বাচ্চারা তাঁবুর পাশ দিয়ে দৌঁড়াদৌঁড়িও করছে। অসংখ্য তাঁবু এবং ছাতায় পুরো মাঠটি বর্ণিল সাজে নান্দনিক হয়ে উঠেছে। কী যে আনন্দ চারদিকে! (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপরিবেশবাদী প্রধানমন্ত্রী! দেশ বাঁচাতে কর্ণফুলী রক্ষা করুন
পরবর্তী নিবন্ধজমি আছে ঘর নেই