জসীম উদ্দীন (১৯০৪–১৯৭৬)। কবি, গীতিকার, ঔপন্যাসিক ও লেখক। ‘পল্লীকবি‘ উপাধিতে ভূষিত, জসীম উদ্দীন আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে লালিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ আধুনিক কবি। ঐতিহ্যবাহী বাংলা কবিতার মূল ধারাটিকে নগরসভায় নিয়ে আসার কৃতিত্ব জসীম উদ্দীনের। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, স্মৃতিকথা, শিশুসাহিত্য, গাথাকাব্য, গান সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় কাজ করলেও কবি হিসেবেই তিনি খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। তাঁর কবিতার প্রায় পুরোটা জুড়েই বাংলার পল্লী প্রকৃতির আবহমান ঐতিহ্য ও লোকজীবন রূপময় ব্যঞ্জনা পেয়েছে। আর এ জন্যেই তাঁর স্বতন্ত্র পরিচয় ‘পল্লী কবি’ হিসেবে। জসীম উদ্দীনের জন্ম ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দের ১লা জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম.এ পাস করেন তিনি। কর্মজীবনের সূচনা ছাত্রাবস্থায়, পল্লী সাহিত্যের সংগ্রাহক হিসেবে। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। পরবর্তীকালে প্রথমে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সরকার এবং পরে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের দায়িত্ব পালন করার পর এখান থেকেই ডেপুটি ডাইরেক্টর হিসেবে অবসর নেন। কলেজে পড়াকালীন ‘কবর’ কবিতা রচনা করে তিনি বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন। জসীম উদ্দীন যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখনই কবর কবিতাটি প্রবেশিকা বাংলা সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়। এমন ঘটনা বিরল। কবির উল্লেখযোগ্য রচনাগুলোর মধ্যে রয়েছে: ‘নকশি কাঁথার মাঠ’, ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’, ‘রাখালী’, ‘বেদের মেয়ে’, ‘পদ্মাপার’, ‘সুচয়নী’, ‘মাটির কান্না’, ‘ভয়াবহ সেই দিনগুলোতে’, ‘ঠাকুর বাড়ির আঙিনায়’, ‘স্মরণের তরণী বাহি’, ‘জার্মানীর শহরে বন্দরে’, ‘চলে মুসাফির’, ‘বাঙালির হাসির গল্প’ প্রভৃতি। ‘হাসির গান’ ও ‘মুর্শিদা গান’ নামে লোক সংগীতের দু খানি গ্রন্থ সম্পাদনাও করেন তিনি। তাঁর ‘নকশি কাঁথার মাঠ’ ও ‘বাঙালির হাসির গল্প’ গ্রন্থ দুটি ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। কী কবিতা, কী গদ্য সবটাতেই জসীম উদ্দীনের সহজ, সরল, অনাড়ম্বর অথচ গভীর রূপময় এবং নিখুঁত শিল্পরীতি ও আন্তরিকতার পরিচয় মেলে। একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক মনন মানসেও এমন শৈল্পিক উপস্থাপনার গ্রহণযোগ্যতায় তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ‘তুজম্বর আলী’ ছদ্মনামে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতিকে কেন্দ্র করে কবিতা রচনা করেন তিনি, যা ‘ভয়াবহ সেই দিনগুলোতে’ কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত হয়। তিনি ছিলেন প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক কবি। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন।