ইদানীং নতুন স্কুল কারিকুলাম নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। পক্ষে বিপক্ষে। স্কুল কারিকুলাম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর প্রভাব সুদুর প্রসারি ও দৃশ্যমান হবে অনেক বছর পর। সব সভ্য দেশে কারিকুলাম প্রণয়ন করা হয় সযতনে তত্ত্ব থেকে তথ্য বিন্যাস করে। বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক, গবেষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকগণের সম্মিলিত প্রয়াসে কারিকুলাম তৈরী করা হয়। কারিকুলাম চালু করার আগে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হয়। এবং চালুর পরও প্রায়োগিক গবেষণা চলতে থাকে। কতটুকু অনুপযুক্ত আর কতটুকু যথাযথ তা পরিবীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের জন্য। যার উপরে ভিত্তি করে পরবর্তী আধুনিকায়ন করা হয়। তড়িগড়ি করে একাজ করা আত্মহননের সামিল। শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও মূল্যায়ন আধা–আপাত বিচারিক কার্যক্রম। শাসনতন্ত্র অনুযায়ী রাষ্ট্রের বিচার ও নির্বাহী বিভাগ আলাদা। সেই অনুযায়ী কারিকুলাম নির্বাহী বিভাগের করা ঠিক না। কারিকুলাম করবে শাসনতান্ত্রিক ভাবে গঠিত স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। কথিত কারিকুলাম প্রণয়নে এসব কিছু খেয়াল করা হয়নি মনে হচ্ছে। ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম‘ মতবাদ অনুযায়ী আমলাদের নিয়ন্ত্রণের শিক্ষকসহ আরো কিছু সহযোগীরা কারিকুলাম তৈরী করেছেন। যথাযথভাবে ষ্টেকহোল্ডারদের মতামত, পর্যালোচনা, পরীক্ষা, নিরীক্ষা ও পরীবিক্ষণ কতটুকু করা হয়েছে তা অজানা। ষ্টেকহোল্ডার যাদের উপেক্ষা করা হয়েছে তারা হলেন প্রান্তিক মাঠ পর্যায়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকগণ। আর্থিক, সময়, সুযোগ, মাইন্ভসেট, কম্যুনিট সেটআপ সমূহ ইত্যাদি বিবেচনায় সঠিকভাবে আনা হয়নি। যা হয়েছে তা মনে হচ্ছে ইচ্ছাপূরণের উপাখ্যান। তিন ধাপ বিশিষ্ট শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি ধাপের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং পন্থা থাকতে হবে।
প্রথম ধাপ হলো প্রাথমিক শিক্ষা : শিক্ষা ছাড়া মানুষ দ্বিপদী প্রাণী। অক্ষর ও সংখ্যা বিদ্যা লব্ধ করে দৈনন্দিন জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সব জ্ঞান, দক্ষতা ও আচরণ এবং মানসিকতা ঠিক করা। পারিবারিক, সামাজিক, কাজ কর্মের, চলাচলের, পারস্পরিক সৌজন্য পালন করা। অর্থাৎ একজন দ্বিপদী প্রাণীকে সুনাগরিকে রিমেক করা। প্রাথমিক শিক্ষা সর্বজনীন হতে হবে। আমাদের চারিদিকে দেখলেই দেখা যাবে আমার শিক্ষা ব্যবস্থা কত ব্যর্থ। কর্ম ও সৌজন্যে।
দ্বিতীয় ধাপ হলো মাধ্যমিক : যা আমাদের দেশে দুভাগ। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক। মাধ্যমিক স্থরের কাজ হলো একজন রিমেক করা সুনাগরিককে কর্মক্ষম করা। যাতে মাধ্যমিক শিক্ষা অর্জনের পর যে কেউ উপার্জন করে নিজকে প্রতিপালন করতে পারে। সাধারনত এই ধাপের পর উন্নত দেশের তরুণ তরুণীরা অভিভাবকগনের আশ্রয় থেকে বেরিয়ে স্বাবলম্বী হয়। তাদের তখন লক্ষ্য থাকে পর্যাপ্ত উপার্জন জীবন যাপনের জন্য, সখ মেটানোর জন্য, ডেটিং এর জন্য। সাধারণত সংখ্যা গরিষ্টরা এ ধাপেই শেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা।
তৃতীয় ধাপ হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর : পন্ডিত ও বিশেষজ্ঞ হওয়ার জন্য এই ধাপ। কম সংখ্যকরা কঠিন নির্বাচনী পার হয়ে এ ধাপে যায়। এবং এটি সর্বজনীন নয়। ব্যয়বহুল। যে জন্য শিক্ষার্থীদের সেখানে ঋণ নিতে হয়। আমাদের উল্টো। এখানে তৃতীয় ধাপের চেয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক অনেক বেশী ব্যয়বহুল।
একবার কারিকুলাম প্রণয়নের এক ফোকাস গ্রুপ ডিসকাসনে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের হয়ে গিয়ে ছিলাম। নন স্পেশিফিক অনেক বক্তৃতা হলো। উচিৎ, করা দরকার, করতে হবে ইত্যাদি। আমি ধাপ অনুযায়ী উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এবং পন্থা জানতে চেয়েছিলাম। যথাযথ উত্তর পাইনি। কারিকুলাম কিছুটা দেখে মনে হয়েছে কর্মকাণ্ডের জন্য যতটা ভালো কিন্তু সুনাগরিক ও জ্ঞান এবং মেধা বিকাশের জন্য ততটা নয়। এতে ভবিষ্যতে মেধাভিত্তিক কর্মক্ষম জনবলের অভাব হবে। মনে হলো কয়েকটি দেশের কারিকুলাম অনুসরণ করা হয়েছে কিন্ত তা দেশ ও জনগন এবং অবস্থা অনুযায়ী যথাযথ কাস্টমাইজ করা হয়নি। বর্তমান সময়ে শিক্ষাকে বলা হয় টিচিং লার্নিং টেকনোলজী। তত্ত্ব ও তথ্য ভিত্তিক কাষ্টমাইজ করে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সাথে এলাইন করতে পারলে সাথে সাথে ষ্টেকহোল্ডারদের মুক্ত যৌক্তিক গ্রহণযোগ্য মতামত নিয়ে আপডেট করলে এই কারিকুলাম অত্যন্ত ভালো হবে।