ভাষা দিবস চলে গেলো। প্রতি বছর এ দিবস আসে, চলে যায়। ভাষা নিয়ে চলে আলোচনা, তর্ক–বিতর্ক। উন্মুক্ত সংস্কৃতি, বিশ্বগ্রাম ধারণা, সীমানাবিহীন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখার এই বেলায় ভাষা এবং সংস্কৃতির টিকে থাকার যুদ্ধটা যদিও কঠিন কিন্তু সুন্দর। মানুষের প্রয়োজনে হাজারও ভাষার জন্ম নিয়েছে বিশ্বজুড়ে আবার হারিয়েও গেছে অন্য ভাষার আধিপত্যে টিকতে না পেরে।
প্রতিটি ভাষার রয়েছে গভীর রসবোধ এবং সৌন্দর্য, আছে নিজস্বতার অহংকার। সকল জাতির কাছে নিজ নিজ ভাষার মাধুর্য অন্যরকম। ‘বিনা স্বদেশী ভাষা, মিটে কী আশা’– সত্য সত্যই এক প্রবল অনুভূতি। সকল ভাষার তা কোন বৃহৎ জাতির হোক কিংবা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিস্তৃত হোক কিংবা সীমিত আঞ্চলিক পরিমণ্ডলে ব্যপ্ত নিজ নিজ ভাষার রস, মাধুর্য সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং সুন্দর।
পারসি বা খাড়িয়া এমনি এক ভাষা, বাংলাদেশে যে ভাষায় কথা বলে মাত্র দুইজন ব্যক্তি। ভেরোনিকা কেরকেট্টা এবং ক্রিস্টিনা কেরকেট্টা, দুই বোন, যাদের সাথে সাথে হারিয়ে যাবে আস্ত একটা ভাষা। খাড়িয়া জনগোষ্ঠীর আদি ভাষা খাড়িয়া ভাষা যা পারসি নামে পরিচিত সেই ভাষা জানা শেষ দুই নারী, যাদের মৃত্যুতে হয়তো হারিয়ে যাবে এই ভাষা। কারণ এই ভাষায় উনারা দুই বোন ব্যতীত আর কেউ কথা বলেন না। দু’জনই খাড়িয়া ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারেন। ভারতের রাঁচি থেকে আগত বাবা–মায়ের কাছ থেকে শেখা এই ভাষা পরবর্তী প্রজন্মকে শেখানোর উপায় ছিল না। এ ভাষায় বর্ণমালা না থাকায়, বইপত্র না পাওয়ায়, স্কুলে পঠিত না হওয়ায় এবং অন্য ভাষার চর্চা বেশি হওয়াতে খাড়িয়া বা পারসি ভাষায় কথা বলার চর্চা হারিয়ে যায়, শেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে পরের প্রজন্ম।
ব্রিটিশ শাসনামলে সিলেটের চা বাগানগুলোয় ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে নানান নৃ–গোষ্ঠীর মানুষ আসে কায়িক শ্রমের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহের নিমিত্তে। সাথে করে নিয়ে আসে নিজস্ব ভাষা এবং সংস্কৃতি। এইসব জনগোষ্ঠীর মাধ্যমে একটা মিশ্র সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে চা–বাগান এলাকায়। শুধুমাত্র মৌখিক ব্যবহার থাকায় ক্রমশ দুর্বল হতে হতে হারিয়ে যায় অনেক ভাষার চর্চা। খাড়িয়া ভাষাও এভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে। খাড়িয়া জাতিগোষ্ঠীর মূল বাসভূমি ভারতের নাগপুর, ঝাড়খন্ড, রোহতাসগড়, অযোধ্যার পাহাড়ি অঞ্চল। ছত্রিশগড়, উড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ড রাজ্যে খাড়িয়া ভাষা এখনো ভালোভাবেই প্রচলিত। রোমান হরফেই তাদের বর্ণমালা রচিত। ভেরোনিকা কেরকেট্টা এবং ক্রিস্টিনা কেরকেট্টার পরিবার ঝাড়খণ্ড রাজ্যের রাঁচি থেকে এসেছিলেন। বাবা–মায়ের কাছ থেকেই ভাষাটি রপ্ত করেছিলেন ভেরোনিকা এবং ক্রিস্টিনা কিন্তু নিজেদের সন্তানদের চেষ্টা করেও শেখাতে পারেননি কারণ এই ভাষার ব্যবহার বা চর্চা বাইরে কোথাও করার সুযোগ ছিল না।
এক সমীক্ষায় বাংলাদেশে ছড়িয়েছিটিয়ে পাঁচ হাজার ৭০০ জন খাড়িয়া জনগোষ্ঠীর মানুষের বাস হলেও ভাষাটি ভালোভাবে জানেন ভেরোনিকা এবং ক্রিস্টিনা ভগ্নিদ্বয়। তবে আরেকজন ব্যক্তির কথা জানা যায় যিনি এই ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারেন। কথা বলার সঙ্গীর অভাবে তিনিও এই ভাষা ভুলতে বসেছেন।
কেরকেট্টা ভগ্নীদ্বয় শ্রীমঙ্গলের রাজঘাট চা বাগান এলাকায় বসবাস করেন।
রাজবংশী, মোদি, মোদক, ওঁরাও, মুণ্ডা, সাঁওতাল, মাহালি, সবর, পাসি, রবিদাস, হাজরা, নায়েক, বাউরি, তেলেগু, তাঁতি, কৈরী, দেশওয়ারা, অলমিক, তেলি, বর্মা, কানু, পানিকা, খাড়িয়া, কুর্মী, চাষা, পাত্র, মাঝি, বাড়াইক, ভূমিজসহ ৯৪ ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস সিলেটের চা বাগান অঞ্চলে। এদের অনেকের নিজস্ব ভাষা প্রচলিত ছিল। যা হারাতে হারাতে শেষ পর্যায়ে রয়েছে। কোনো মতে টিকে আছে ১৫টির মতো। খাড়িয়া আর মুণ্ডা একই আদি নৃগোষ্ঠী। কোনমতে যুদ্ধ করে টিকে থাকা এই জনগোষ্ঠীর মানুষগুলো নিজস্ব ভাষা এবং সংস্কৃতি নিয়ে ততটা চিন্তিত নন যতটা চিন্তিত দু’বেলা খাবার যোগাতে। যে ভাষায় যোগাযোগ সহজ, উপার্জনের পথ সহজ সে পথেই বিলীন হয়ে যায় নিজস্ব ভালোবাসা আর ঐতিহ্যের ভাষা, সংস্কৃতি। এমন পরিস্থিতিতে এগিয়ে আসা প্রয়োজন শক্ত পৃষ্ঠপোষকতার।
বাংলাদেশে খাড়িয়া ভাষাকে টেকাতে প্রয়োজন বর্ণমালা এবং বই তৈরি, সাথে খাড়িয়া জনগোষ্ঠীকে এই ভাষা শিক্ষায় আগ্রহী করে তোলা। ভেরোনিকা এবং ক্রিস্টিনা কেরকেট্টা ভগ্নিদ্বয়ের মৃত্যুর সাথে সাথে যে ভাষার মৃত্যু আশংকা করা হচ্ছে তা উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতার মধ্য দিয়ে টিকে থাকুক দীর্ঘদিন।