ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওজন স্কেল ব্যবসার জন্য ‘বিষফোঁড়া’– সে কথাটি অনেক আগে থেকে দাবি করে আসছেন ব্যবসায়ী নেতারা। এমনকি মন্ত্রী নেতারাও বলেছেন, ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কে ওজন স্কেল নিয়ে ভিন্ন নিয়ম থাকা উচিত নয়। তাঁরা বলেন, ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের এক্সেল লোড নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের আপত্তি শুনছি। ওজন স্কেল নিয়ে সারাদেশের জন্য এক নিয়ম আর ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের জন্য ভিন্ন নিয়ম, এটা আসলে থাকা উচিত নয়। কারণ আমাদের পরিশেষে ভোক্তাদের বিষয়টি দেখতে হবে। ট্রাকে পণ্য পরিবহনে যদি এভাবে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, তাহলে পণ্যের দামের ওপর প্রভাব পড়বে। এতে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। যা সাধারণ মানুষের জন্যে হবে কষ্টকর। আবারো সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রীকে কথাটা বলবো, এই সিস্টেমটা পরিবর্তন করতে। সারাদেশে যেভাবে আছে, সেভাবেই ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কে করা হোক। এখন অনেক বড় এক্সেলের গাড়ি হচ্ছে। এতে লোড ডিস্ট্রিবিউট হয়ে যাচ্ছে। সায়েন্টিফিকভাবে দেখে শুনে একটা চিন্তা করা উচিত বলে আমরা মনে করি।
এবার বসানো হচ্ছে শাহ আমানত সেতুর পাশে ওজন স্কেল। ১৮ জানুয়ারি দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, ব্যবসায়ীদের তীব্র আপত্তি থাকা সত্ত্বেও চট্টগ্রামে আরো একটি ওজন স্কেল স্থাপন করা হয়েছে। চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কে শাহ আমানত সেতুর পাশে স্থাপিত এই ওজন স্কেলটি নিয়ে ইতোমধ্যে ব্যবসায়ীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তবে সড়ক ও জনপথ বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে দেশের সড়ক মহাসড়ক রক্ষা করতেই মূলত এই ওজন স্কেল স্থাপন করা হয়েছে। সারা দেশে ২১টি পয়েন্টে নতুন ২৮টা ওজন স্কেল স্থাপনের সরকারি উদ্যোগের অংশ এটা। চট্টগ্রাম কক্সবাজার মহাসড়কে উভয়মুখী যানবাহনের ওজন পরিমাপ করা হবে এই মুভিং ওজন স্কেলে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, কোটি কোটি টাকা খরচ করে যানবাহনের ওজন নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয়া হলেও মূলত তা কার্যকর হয় না। বরং এর মাধ্যমে গুটিকয়েক মানুষের টাকা কামানোর মেশিন স্থাপন করে দেয়া হয়। ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডের বড়দারোগার হাটে স্থাপিত ওজন স্কেল নিয়ে রয়েছে ব্যবসায়ীদের অভিযোগের পাহাড়। এই স্কেল দিয়ে ওজন নিয়ন্ত্রণের চেয়ে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা হাতানো বেশি হয় বলেও তারা বহুবার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ব্যবসায়ীরা জানান, সারাদেশে ইচ্ছেমতো পণ্য নিয়ে ট্রাক কাভার্ডভ্যান বা কন্টেনার মুভার চলাচল করলেও চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্যবাহী গাড়ি নিয়ন্ত্রণের জন্য ওজন স্কেল বসানো হয়েছে। এতে ব্যবসায়ীদের হয়রানির পাশাপাশি বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। তারা অনেকদিন ধরে এই ওজন স্কেল সরিয়ে নেয়ারও দাবি জানিয়ে আসছেন।
ইতোপূর্বে চট্টগ্রাম চেম্বার চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের অসম প্রতিযোগিতা থেকে মুক্তি দিতে ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কে ওজন নিয়ন্ত্রণ স্কেল বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। চেম্বার সভাপতি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কাছে প্রেরিত এক পত্রে বলেছিলেন, চট্টগ্রাম থেকে সারাদেশে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে সীতাকুণ্ড ও মীরসরাই এলাকায় মহাসড়কে ২০১৮ সালে ১৩ টন ওজনের বাধ্য–বাধকতা নির্ধারণ করে নিয়ন্ত্রণ স্কেল চালু করা হয়। এই নিয়ন্ত্রণের ফলে চট্টগ্রাম থেকে পণ্য পরিবহন ব্যয় অনেক বৃদ্ধি পায়। ফলে চট্টগ্রামের মাধ্যমে আমদানি বাণিজ্য দিন দিন হ্রাস পেতে থাকে।
দেশের অন্য কোন অঞ্চলে ওজন স্কেল না থাকায় চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হওয়ার কারণে সরকারের কাছে এই ওজন নিয়ন্ত্রণ স্কেল বাতিল করার জন্য আবেদন জানানো হয়। সেই আবেদনের প্রেক্ষিতে তখন সারাদেশের মহাসড়কে একই ধরনের ওজন স্কেল স্থাপন করা হবে মর্মে সরকারিভাবে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের জানানো হয়। কিন্তু এতো বছর পার হলেও দেশের আর কোন মহাসড়কে ওজন নিয়ন্ত্রণ স্কেল স্থাপন করা হয়নি। অথচ চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের অসম প্রতিযোগিতা ও আর্থিক ক্ষতির অন্যতম কারণ এই নিয়ন্ত্রণ স্কেল চট্টগ্রাম–ঢাকা মহাসড়কেই কেবল বিদ্যমান রয়েছে। ফলে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা সক্ষমতা হারাচ্ছে এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না।
চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আড়ত সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, চট্টগ্রামের চাক্তাই খাতুনগঞ্জে বিশেষ করে ছোলা, মশুর ডাল, সাদা মটর এবং গম জাতীয় পণ্যগুলো আনলোড হয়ে গুদামজাত করা হতো। এরপর সরবরাহ হতো সারাদেশে। কিন্তু এখন ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কে ওজন স্কেলের কারণে চাক্তাই খাতুনগঞ্জের ব্যবসা চলে যাচ্ছে নারায়ণগঞ্জে। আমদানিকারকরা এখন আর চট্টগ্রামে পণ্য আনলোড করতে চান না। সরকারের সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মহাসড়কের সুরক্ষার জন্য ওজন নিয়ন্ত্রণ আইন করা হয়েছে। তাহলে শুধুমাত্র ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের জন্য কেন এই আইন? দেশে তো মহাসড়ক আরো আছে। মহাসড়ক যদি ওজনের চাপে নষ্ট হয়ে যায় তাহলে সরকারের উচিত আধুনিক নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করে সড়কের উন্নয়ন করা। ওজন নিয়ন্ত্রণের কারণে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
ওজন স্কেলে কাউকে হয়রানি করা না হলেও এ ধরনের উদ্যোগ স্বাভাবিক গতিপথ বাধাগ্রস্ত করে। বিষয়টি নিয়ে ভাববার জন্য আমরা কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা যায় কিনা দেখতে হবে।