স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের চ্যালেঞ্জ নিয়ে টানা চতুর্থবার দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি জননেত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর সাথে শপথ গ্রহণ করলেন ৩৬ জন মন্ত্রী–প্রতিমন্ত্রী। ১৯৯৬–২০০১ সময়কালসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধান হিসেবে পঞ্চমবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে ইতিহাস গড়লেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা। বিশ্বে শেখ হাসিনাই প্রথম সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ক্ষমতাসীন নারী সরকারপ্রধান। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বকে হার্ড পাওয়ার হিসেবে বর্ণনা করেছে টাইম ম্যাগাজিন, বিবিসির ভাষায় সেটা ‘ওয়ান উইমেন শো’।
১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে সর্বস্তরের জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহবান জানান বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রবাদপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতা ঘোষণার অব্যবহিত পর পাকিস্তানের সামরিক সরকারের নির্দেশে তাঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে। পাকিস্তান সৈন্যদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হলেও ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে জাতি বিজয়ের পূর্ণ স্বাদ গ্রহণ করে।
স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও পরিবারের সদস্যরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট ঘাতকদের তপ্ত বুলেটের আঘাতে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। সেসময় ইউরোপে অবস্থানের কারণে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক শেখ হাসিনা ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৭৫ সালের বেদনাবিধুর হত্যাকাণ্ডের পর দিল্লিতে নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে শেখ হাসিনা দেশে ফেরেন ১৯৮১ সালে। ওই বছরই তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। সামরিক শাসক এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৬ সালে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনসহ মোট আট বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
১৯৯৬ সালের ১২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। সেই সরকারের অন্যতম সাফল্য ছিল পার্বত্য শান্তি চুক্তি ও প্রতিবেশী ভারতের সাথে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে হারিয়ে বিএনপি–জামাত জোট সরকার গঠন করলে তৃতীয় বারের মত বিরোধী দলীয় নেত্রী হন শেখ হাসিনা। ওই সরকারের সময় ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে গেলেও তাঁর শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮, ও সর্বশেষ এবছর ২০২৪ এ অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে পঞ্চমবারের মত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছেন শেখ হাসিনা। গত দেড় দশকে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন শেখ হাসিনা।
১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে আয়োজিত মহাসমাবেশে সভাপতির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার দল আবার ক্ষমতায় আসার কারণে বাংলাদেশের সমৃদ্ধির পথে অগ্রগতিতে কেউ বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না। তিনি এসময় নির্বাচন কমিশনকে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে সার্বিক সহযোগিতার জন্য সশস্ত্র বাহিনী, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ জানান। তিনি গণমাধ্যমের সাংবাদিকদেরও ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, আমাদের দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলবো। যে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ শিক্ষা–দীক্ষা এবং প্রযুক্তি ব্যবহারে স্মার্ট হবে। আমরা ধারাবাহিকভাবে গণতান্ত্রিক ধারায় রাষ্ট্রপরিচালনা করে দেশের যে উন্নতি করতে পেরেছি সেই উন্নয়নের ফলে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। ২০২০ সালে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী আমরা উদযাপন করেছি এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনকালে জাতির পিতা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলে যে স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদা এনে দিয়েছিলেন সেখান থেকে আমরা এই উত্তরণ ঘটাই। ২০২৬ সাল থেকে এই উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা কার্যকর শুরু হবে।
আওয়ামী লীগ সভাপতি আরও বলেন, দীর্ঘদিন গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে বলেই আজকে বাংলাদেশের আর্থ–সামাজিক উন্নতি হয়েছে। আজকের বাংলাদেশ বদলে যাওয়া বাংলাদেশ। দারিদ্রের হার কমেছে। মানুষের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছি। মানুষের পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করছি। চিকিৎসা সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছি, সাক্ষরতার হার বেড়েছে। মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে আমরা যে কাজ করেছি তার শুভফল মানুষ পাচ্ছে।
সব দিক থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিকূলতা কাটিয়ে অবিরাম গতিতে ছুটছেন শেখ হাসিনা। তাইতো বাংলাদেশ সারাবিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। ২০২০ সালে মহামারি করোনা ভাইরাসে যখন সারা বিশ্বের অর্থনীতি বিপর্যস্ত তখন শক্ত হাতে বৈশ্বিক এই ধাক্কা কাটিয়ে অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে সক্ষম হয়েছিল বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। এরপর রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বের মত বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ফলে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে মানুষের প্রাত্যাহিক জীবনে সংকট দেখা দেয়।
এ সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যেই অনুষ্ঠিত হয়েছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। যেখানে আবারও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা চতুর্থ বারের মত সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচন উপলক্ষে দেশি– বিদেশি পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এ জয় আমার নয়, এ জয় জনগণের’। এবারের নির্বাচনি ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ গ্রহণের কথা বলেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে গুরুত্ব দিয়ে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত– সমৃদ্ধ স্মার্ট সোনার বাংলা গড়ার কথা বলেছে দলটি। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উচ্চ–মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করবেন।
বিশ্বনেতৃবৃন্দ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয়ের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে তাঁর সরকারের সাথে অব্যাহতভাবে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এক বার্তায় ডব্লিউইএফ– এর নির্বাহী চেয়ারম্যান ক্লাউস শোয়াব বলেন, ‘দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ঐতিহাসিক বিজয়ে আপনার দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য অনুগ্রহ করে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের পক্ষ থেকে আমার অভিনন্দন গ্রহণ করুন। আমি নতুন মেয়াদে আপনার এবং আপনার সহকর্মীদের সাফল্য কামনা করি।’ তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার পূর্ণ লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করতে শেখ হাসিনা ও তার সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার জন্য ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম মুখিয়ে আছে। তিনি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ৫৪তম বার্ষিক বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানান। যা সুইজারল্যান্ডের দাভোস–ক্লিস্টারে ১৫–১৯ জানুয়ারি ২০২৪ অনুষ্ঠিত হবে।
বাংলাদেশের মানুষ সকল ষড়যন্ত্র, হিংসা নাশকতাকে পরাভূত করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিকে ভোটের মাধ্যমে আবারও নির্বাচিত করেছে। দেশের কল্যাণে গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার জন্য এ নির্বাচন ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তাই বলা যায় এই জয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জয়, স্বাধীনতার আদর্শের জয়, সর্বোপরী গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং সুখী– সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জয়। যে বাংলাদেশ আজ বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে। শুভ হোক নতুন সরকারের শুভযাত্রা। দেশের মানুষ সবসময়ই উন্নয়ন আর শান্তির পক্ষে। তারা চায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা, সারা দেশে নির্বিঘ্নে উন্নয়ন, ব্যবসা–বাণিজ্য, আমদানি– রপ্তানি প্রত্যেকটি খাত ঘুষ–দুর্নীতিমুক্ত করা। শিক্ষাকে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য বিশ্বমানের শিক্ষা, শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করে শিক্ষাকে সময়োপযোগী করা। সর্বোপরি শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি করে জাতীয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করা।
বাংলাদেশ এখন অন্য সব দেশের জন্য উন্নয়নের ‘গ্লোবাল রোল মডেল’। ডিজিটাল বাংলাদেশের পর এবারের স্লোগান ‘স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা’। স্বাধীন বাংলাদেশ যেসব অবকাঠামো দেশকে এগিয়ে নিচ্ছে প্রতিনিয়ত, বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রা তার মধ্যে ‘বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু’, ‘পদ্মা সেতু’, ‘দ্রুতগতির উড়াল সড়ক’, ‘মেট্রোরেল’, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ অন্যতম। বাংলাদেশ আজ অর্থনীতি, কৃষি, শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর একটি জাতি হিসেবে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে নতুন বছরে নতুন সূর্যের সোনালি আলোয় ভরে উঠুক সুখী–শান্তিপুর্ণ ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী আদর্শে মানবিক সমাজ গড়ে উঠুক। জয় হোক গণতন্ত্রের।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলেজ শিক্ষক (অর্থনীতি),
বোয়ালখালী হাজী মো. নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ।