বেশ অনেকদূর এগিয়ে এসেছি, একটু আগে দেখতে পাওয়া লাল চায়নার মূর্তিমান লজ্জাকে পিছু ফেলে। একবার ভেবেছিলাম ছবি তুলে রাখবো এই তীব্র বেইজিং হিমে উদোম শরীরে ভিক্ষা করতে থাকা সেই বিকলাঙ্গ লোকটির। ছবি তুলে রাখবো কারন দেশে ফিরে তা দেখাতে হবে ঐসব বামাতি বন্ধুদের যারা একসময় চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান শ্লোগান দিত। চীনের প্রতি সেই তাদের মোহ এখনো কাটেনি। অবলীলায় তারা ভুলে থাকে ১৯৭১ এবং তার পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশকে অস্বীকার করার চীনা ভূমিকার কথা। এছাড়া তারা এও মনে করে যে খাঁটি সমাজতন্ত্র থাকলে ছিল তা চীনেই একদা, এবং যদি থাকে সেই সমাজতন্ত্রের অবশিষ্ট কিছু এ গ্রহে এখনো আছে তা এই চীনেই।
কিন্তু ঝামেলা এড়ানোর জন্য ছবি তোলার ঝুঁকি নেইনি। প্রথমত ভেবেছিলাম এই দৃশ্যের ছবি তুলতে গেলে ফুটপাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আশেপাশের হকারেরা বা হাঁটুরেরা কি না কি যে বলে! কোন বিদেশী, বেইজিং এর ফুটপাতে থাকা এরকম একটা লজ্জাকর দৃশ্যের ছবি তুলছে, তা নিশ্চয় কোনও চায়নিজের পছন্দ হবার কথা নয়। তদুপরি আরো বড় ভয় ছিল মনে, ছবি তুলতে গিয়ে যদি না পড়ি আবার সাদা পোশাকে ঘুরে বেড়ানো কোনও লাল গোয়েন্দার খপ্পরে। বহিরঙ্গে যতোই চায়না আর্থসামাজিক ভাবে বেরিয়ে আসুক না কেন তথাকথিত দমবদ্ধ কমিউনের ঘোরটোপ থেকে তুমুলভাবে প্রচারিত ভোগাবাদি পুঁজিবাদের অবারিত খোলামেলা প্রান্তরে, ভেতরে ভেতরে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য এখানকার প্রাক্তন কমিউনিস্টরা, এখনো এ ব্যাপারে সেই লালপন্থাকেই গুরুত্বপূর্ণ মানে। অতএব বেইজিঙয়ের দৃশ্যমান খোলামেলা পুঁজিবাদের বাজারে যে চামে চুমে ঘুরছে সর্বক্ষণ সাদা পোশাকে সমাজতন্ত্রের লাল পুলিশেরা এ ধারণা আমার প্রবল। তাই ফালতু ঝঞ্ঝাটে পড়তে চাইনি আর কী!
‘আহা, আমি তো কোনও টাকা দিলাম না লোকটাকে।’ হাহাকার করে পাশে আসা লাজুর এই হাহাকার কানে যেতেই বুঝলাম, আমার মতোই তারও মনে এখনো ঘুরছে সেই দৃশ্য! ওকে সান্ত্বনা দেবার জন্য সাথে সাথেই বললাম, অসুবিধা নেই, ফিরবো যখন তখন দিও। এ কথা বলার সাথে সাথে নিজেও সিদ্ধান্ত নিলাম মনে মনে যে, হোক যতোই ঝামেলা হবে! ফেরার পথে যেকোনওভাবেই হোক তুলে নেব ঐ দৃশ্যের ছবি একটা।
‘বাবা, বাবা ঐ যে দেখো আওডি সিটি! আচ্ছা এটা কি আওডি গাড়ির ফ্যাক্টরি?’
‘আরে দূর বোকা এটা ফ্যাক্টরি হবে কেন? এটা শো রুম বা অফিস হতে পারে।’
গাড়ি বিষয়ে তুমুল উৎসাহী দুপুত্রের এহেন বাক্যালাপের ফলে নজরে এলো চওড়া এই ফুটপাত থেকে বেশ কিছুটা দূরত্ব রেখে ডানে দাঁড়িয়ে থাকা দালানটিকে। ব্যতিক্রম দেখছি এই যে, দালানটির সদর দরজার কপালে সাথে বেশ বড় করে শুধুই ইংরেজিতে লেখা আছে ‘আওডি সিটি বেইজিং’। বহুতল বিশিষ্ট এই দালানটির উপর নীচে চোখ বোলাতেই, দালানটির টানা কাচের জানালাগুলো ভেদ করে এটির দোতলার যতোটা নজরে পড়লো, তাতে মনে হল ঐ তলায় ওখানে রাখা সারিসারি গাড়ি।
‘না না এটা শো রুমও না। অফিস হতে পারে আওডির।’ একটু আগে দেয়া নিজের মতামত শুধরে বলল ফের দীপ্র।
হ্যাঁ দোতালায় রাখা গাড়িগুলো দেখে আর যেভাবে ওগুলোকে রাখা হয়েছে তা দেখে আমার কাছেও এটি পরিষ্কার যে ওটা আসলে এই দালানের পার্কিং লট। দশ কী বারো তলা হবে উচ্চতা এই দালানের। ভাবে ভঙ্গিতে মনে হচ্ছে এটা কোনও অফিস বিল্ডিংই হবে। তবে এ নিশ্চিত যে এটা জার্মান আওডি গাড়ির শো রুম তো নয়ই এমন কী ঐ কোম্পানির কোনও অফিসও যে এখানে আছে মনে হচ্ছে না তাও। এ দালানে নানান ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অফিস থাকলেও আওডির সাথে এর কোনও যোগসাজশ নেই। দালানের মালিক এমনিতেই এটিকে নাম দিয়েছে আওডি সেন্টার। যেমন দেখা যায় ঢাকায়, চাইনিজ রেস্টুরেন্টের নাম ম্যাকডোনাল্ডস, এ ঐরকমই চায়নার কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন আর কী! মনে মনে এসব কথা ভাবতে ভাবতে বললাম সবাইকে দালানটিকে পিছনের রেখে ছবি তোলার জন্য দাঁড়াতে।
হঠাৎ করেই আমার এই ছবি তোলার প্রস্তাবে সবাই কিছুটা বিভ্রান্ত হলোই বলে মন হল। কারণ মোটামুটি ধরনের এ দালানের এর কোনও বিশেষত্বই নেই। এর চেয়ে ঢের বেশি জমকালো দালান আছে এদিকটায় যা পেরিয়ে এসেছি এরই মধ্যে, সেগুলোর কিন্তু কোনও ছবি তুলিনি আমি। বিভ্রান্ত হলেও চুপচাপ সবাই ছবি তোলার জন্য পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তেই ছবি তুলতে তুলতে বললাম যে, খোদ বেইজিং এই দালানের ইংরেজিতে লেখা জার্মান নাম দেখেই তুলছি ছবি। ছবি তুলতে গিয়ে মোবাইলের পর্দায় নজরে এলো দালানের সামনের অংশ চৌকো ডিজাইনের কাচঘেরা হলেও তার মধ্যে বেশ কটা চৌকো অংশের কাচভাঙা। তাতে বোঝা গেল যতোই ইংরেজিতে এর জার্মান নাম লিখে রাখুক না কেন এই দালান কর্তৃপক্ষ, এর রক্ষণাবেক্ষণের অবস্থা জার্মান বা ব্রিটিশ জাতের না। রক্ষণাবেক্ষণের এমন অবস্থা ঢাকাই অবস্থা তাহলে আছে এই বেইজিঙয়েও।
‘আচ্ছা তুমি কী টের পাচ্ছো না যে বাতাস বেড়েছে? সাথে বেড়েছে ঠাণ্ডাও? এরই মধ্যে অনেক দূরই তো চলে এসেছি খালি খালি। কী দরকার আর সামনে যাবার। চল ফিরি এখন।’
কথা সত্য লাজুর, বাতাস ও ঠাণ্ডা দুটোই বেড়েছে। তদুপরি এসেছিও অনেকটাই হেঁটে। তবে ও যেটিকে বলে খালি খালি হাঁটা বলছে, তা কিন্তু আমার মোটেও মনোপুত হচ্ছে না। আমার তো বরং মনে হচ্ছে এ হাঁটাটুকু না হাঁটলে বেইজিং দেখা পরিপূর্ণ হতো না আমার। কিন্তু এ কথা বলতে গেলে পড়ি আবার কোন যন্ত্রণায়, তার তো কোনও ঠিক ঠিকানা নেই! এদিকে আমি চাইছি ঐ যে সামনে দেখতে পাচ্ছি বিশালকায় কাচমোড়া দালানটি, যেটি সম্ভবত কোনও ল্যান্ডমার্ক জাতীয় দালান টালান হবে ঐ পর্যন্ত গিয়ে তবেই ফিরতি হাঁটা ধরতে। এমতাবস্থায় অহেতুক দ্বিমত প্রকাশ করার ঝুঁকি না নিয়ে বললাম তাই
হ্যাঁ ঠিক বলেছ, বাতাস আর ঠাণ্ডা দুটোই বেড়েছে। তবে চলো না ঐ পর্যন্ত যাই। মনে হচ্ছে ওটা কোনও গুরুত্বপূর্ণ দালান টালান হতে পারে। ঐ পর্যন্ত গিয়ে আর এগুব না। ওখানটা দেখেই ফিরবো না হয়।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ মা চল, চল। ওইখান পর্যন্ত যাই।’
এইমাত্র অনুনয়ের স্বরে দেয়া আমার প্রস্তাবের পিঠাপিঠি দীপ্রর এই আব্দার আসার পর ঐপক্ষ থেকে ভিন্ন কোনও সিদ্ধান্ত না আশায়, হাঁফ ছাড়লাম। মনে হচ্ছে এই পাশ থেকে ঐ দালানটির যতোটা অংশ দেখা যাচ্ছে, তাতে কিঞ্চিৎ হলেও কৌতূহলী হয়ে উঠেছে সেটির ব্যাপারে লাজুও। অতএব কালবিলম্ব না করে দ্রুত হাঁটতে শুরু করলাম দুশ কি তিনশ মিটার দূরের ঐ দালানের দিকে।
‘ওয়াও! বিউটিফুল!’
আশেপাশের কোনও দিকে তাকিয়ে সময় নষ্ট না করায় বেশ দ্রুতই এসে পৌঁছেছি সবাই এখানটায়। বিশলাকায় এক অর্ধবৃত্ত তৈরি করে ফুটপাত থেকে বেশ দূরে দাঁড়িয়ে আছে রুপালি কাচঘেরা কমপক্ষে বিশ কী পচিশ কিম্বা তারও বেশি তলা উচ্চতার আলিশান এই দালান! অর্ধবৃত্তাকার এই দালানের সামনের অংশে সরল রেখা টানলে জ্যামিতির ভাষায় ব্যাস নামের যে সরল রেখা তৈরি হয় মিশেছে সেটি এসে এই ফুটপাতের সাথে। সেই ব্যাসের মাঝামাঝি অংশ থেকে সারি সারি দীর্ঘ সিঁড়ি, ঢেউ তুলে তুলে উপরের দিকে উঠে এগিয়ে গেছে তা অর্ধ বৃত্তাকার ঐ দালানের পেটের দিকে মানে পরিধির দিকে। উপরের দিকে উঠতে উঠতে সিঁড়িগুলোর পাশের দৈর্ঘ ক্রমশ ছোট হতে থাকা সিঁড়িগুলোর ঢেউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে, প্রতিটি সিঁড়ির ডানে বাঁয়ে বিস্তারিত হয়ে আছে ফ্লাওয়ার বেড। ঐ ফ্লাওয়ার বেডগুলোর পুরোটাই ছেয়ে আছে অসংখ্য রক্ত লাল ফুল! কী নাম যে ঐ ফুলগুলোর জানি না। তবে এরকম হিমেও ঐ রকম তরতাজা এতো এতো লাল ফুলের সমারোহে বড়ই মনোহর হয়ে আছে গোটা এলাকাটি। চোখের সামনে এরকম একটি মনোহর দৃশ্য দেখতেই আমাদের সবার মনে যে অনুভূতি তৈরি হয়েছিল সেটিই যেন বা প্রকাশ করলো একটু আগে অভ্র তার ঐ দুটি শব্দে।
এরই মধ্যে সেই উত্তেজনায় দেখছি –ছবি তোলাতুলি চলছে এখন ওদের যে রকম তুমুল উত্তেজনায়, বিশাল এই অর্ধবৃত্তাকার কাচঘেরা দালানের সামনের লাল ফুলময় উঠান জুড়ে দৌড়ে দৌড়ে, তাতে এখান পর্যন্ত হেঁটে আসা তাহলে বৃথা মনে না হচ্ছে আর কারোই নিশ্চয়ই। আচ্ছা এই দালানটিতে আছে কী? প্রশ্ন জাগল মনে। কিন্তু উত্তর জিগাই কারে? আগুন্তুক না হয়ে খোদ বেইজিংবাসি হলেও যে তার কাছ থেকে জেনে নিতে পারতাম মনে জেগে উঠা প্রশ্নের উত্তর, তাও তো নিশ্চিত নয় কিছুতেই।
নিজেই তাই নিজ মনের উত্তর খোঁজার জন্য লাল ফুলের বেডগুলোর পাশ ঘেঁসে উঠছি সিঁড়ি ভেঙে উপরের দিকে ফুল আর ফুলের গাছগুলো ভালো করে দেখতে দেখতে। নাহ গাছ বলতে যেমন বুঝি আমরা তেমন কোনও গাছ নেই। আছে যা তা হল রজনী গন্ধা ফুলের ডাঁটার মতো একেকটা ডাটা, যেগুলো বেরিয়ে এসেছে মাটি ফুঁড়ে, যার একদম মাথায় বসে আছে ঐ চমৎকার লালরঙের একটা করে ফুল। প্রায় একই উচ্চতার প্রতিটি পত্রপল্লবহীন ডাঁটার উপর একটা করে ফুটন্ত লাল ফুল দেখতে দেখতে ভ্রম হল হঠাৎ, এ কি তবে প্লাস্টিকের ফুল নাকি?
বেশ কাছে গিয়ে ভাল করে দেখেও এ মীমাংসা করতে পারলাম না যে ফুলগুলো আসল নাকি প্লাস্টিকের। কারণ এসব ব্যাপারে আসলেই চায়নিজের বিশ্বাস নেই। তারা যে আসল নকলের মধ্যে বিভ্রম তৈরি করার ব্যাপারে পারঙ্গম এ তো বহুল প্রচারিত একটি কথা। তবে এ কথাও ঠিক যে এখন চায়না আর সব বিষয়ের মতো জীব বিদ্যার গবেষণায় যতোটা এগিয়ে গেছে, তাতে তাদের দ্বারা এরকম ফরমায়েসি ভাবে প্রাকৃতিক গাছও জন্মানো সম্ভব। ফলে এগুলো নিশ্চয়ই আসল ফুলই হবে। কিন্তু কী যে নাম এই ফুলের জানি না তো। লেখক: কলামিস্ট. ভ্রমণ সাহিত্যিক।