আমার আপা বেগম ফাহমিদা আমিন

জিনাত আজম | রবিবার , ১৪ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৯:২৩ পূর্বাহ্ণ

আপা নেই আমাদের মাঝে, চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়েছেন সাত বছর পূর্ণ হলো ১১ জানুয়ারিতে। ১৬ জানুয়ারিতে সুরভি বিলাতে ধরায় এসেছিলেন তিনি। আমরাও সুবাসিত হয়ে ছিলাম তাঁর সেই সুরভিতে। তাঁকে হারালাম ২০১৭তে। আমাদেরকে সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে তিনি বিদায় নিলেন সুদূর আমেরিকায়। আজ মনে হয় কত দিন তাঁর সেই স্নেহ ভালোবাসায় ভরা ডাক শুনি না। আর শুনতে পাবোনা কোনদিন। তবে যতদিন বাঁচবো তাঁর সেই মধুর স্মৃতি, মায়া ভরা মুখের ডাক স্মরণে থাকবে।

আপা ছিলেন চিরদিন মাথার উপর ছায়া ও মায়া হয়ে।একেবারে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। আমার অনুভবে তিনি আছেন প্রতিটি মুহূর্তে। ১৯৮০ থেকে ২০১৭ অনেক লম্বা সময়। সাঁইত্রিশ বছর! ২০১৬তে ঢাকায় যাবার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলেন ছেলেদের জন্য। আসলে চট্টগ্রামে সেই বয়সে একা থাকাটা ও দুঃসাহস বৈকি। অতএব তাঁকে চট্টগ্রাম ছাড়তে হলো শতভাগ অনিচ্ছায়। চট্টগ্রামের মোহমায়া তাঁর শরীর ও হ্রদয়ের প্রতিটি অনুপরমাণুতে লেপ্টে ছিলো পরতে পরতে। তাই চট্টগ্রাম ত্যাগের পরেই তার জীবনীশক্তি ও যেন ক্রমশ হারাতে লাগলেন। আমার সাথে কথা হলেই বুঝতে পারতাম। কথা হতো প্রায় ফোনে। বুঝতাম, ঢাকায় মন বসাতে পারছেন না। তাই ওখানে নিজেই খুঁজে বের করলেন মোরশেদা নাসির, ফাতেমা আলী, শিরিন আলমদের।ওরা আসলো। আপা চট্টগ্রামের সেই আমেজ খুঁজে ফিরছেন ওদের মাঝে।

একদিন অভিমান করে বললেন, তোমরা না এলে আমি আবার চলে যাবো। অবশেষে সেই যাওয়াই স্থির হলো ছেলের সাথে, সুদুর আমেরিকায়। কে জানতো এটাই তাঁর শেষ যাত্রা হবে।

তিনি যাভেবে গিয়েছিলেন তা হলো না। ওখানে গিয়ে আরো মুষড়ে পড়লেন। আমার সাথে ফোনে কথা হতো প্রায়ই।

বুঝতাম কথা বলাতেও তিনি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। কথা বললেই বুঝতাম আপা বাঁচার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।

ফলে শেষের দিকে আমিও তাঁকে বিরক্ত করতে চাইতাম না। তবে একদিন একটি দুস্থ মেয়ের জন্য সেলাই মেশিন

দেবার কথা বলাতে, তিনি পুরো টাকাই পাঠালেন, বড় ছেলে ডা: শাহিনের মাধ্যমে। ওটাই ছিলো তাঁর সাথে আমার শেষ

কথা।এরপরের কথা! আপার শেষ দিনগুলো। হাসপাতালের কথা, চিকিৎসায় রাখা বিভিন্ন অবস্থার বর্ণনা এবং শেষ যাত্রার বিস্তারিত বয়ান রেফায়েত আজাদীর পাতায় লিখেছিল। আমিই প্রাণে ধরে পড়তে পারিনি; শেষ দেখাটাও হলো না। আপা আমেরিকাতেই থেকে গেলেন। তাঁকে বিদায় জানানোর সৌভাগ্য আমাদের হলোনা।

মনে পড়ে আমদের বাসায় আসলে অনেক সময় আমার বিছানায় বিশ্রাম নিতেন। একবার দেখলেন আমরা জুমানার জন্য (গায়ে হলুদের) হলুদ শাড়ী খুঁজছি। দুদিন পর তিনি রবিনের (ছেলে)মারফত ছোটদের সেই চমৎকার একটি শাড়ী এবং ছোট্ট একটি প্লাস্টিকের মোড়া আনিয়ে দিয়ে ছিলেন। যা এখনও তাঁর সোনালী স্মৃতির স্বাক্ষর হয়ে আছে আমাদের কাছে। আপার সাথে ঢাকা, সিলেটের লেখিকা সংঘের সম্মেলনে গিয়েছিলাম। হোটেলে এক সাথে ছিলাম। অনেক কাছে থেকে তাঁকে দেখেছি। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পর দিন রবিনের মৃত্যুসংবাদ তিনি না পাওয়া পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে থেকেছি। আদরের পুত্রের মৃত্যুর খবর জানার পর এবং জানার পূর্বে, অবশেষে ঢাকায় যাওয়া অবধি ও পাশে ছিলাম। নীচু স্বরে বলেছিলেন, কি দেখতে যাব? সেই দিন এক মায়ের নীরব কান্না সন্তানের জন্য ব্যাকুলতা আমি দেখেছি। ঢাকা থেকে ফেরত আসার আগে পর্যন্ত আমাদের মনে ভয় ছিলো কেমন থাকবেন? কিন্তু ধৈর্যের প্রতিমূর্তি তিনি। সময় লেগেছিলো কিন্তু লিখার জগতে আবারও ফিরেছিলেন। আমাদেরকে অবাক করেই। এই রত্নগর্ভা মা, সুগৃহিণী, বিশিষ্ট রম্য সাহিত্যিক, সমাজসেবী সংগঠক, বিশেষ করে চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘের প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী ছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালে শ্রদ্ধেয় মুশতারী শফি, সালমা চৌধুরী, রওশন আরা আসজাদ প্রমুখকে নিয়ে লেখিকা সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর সেই প্রিয় প্রতিষ্ঠানে আজো আমরা আছি। প্রতি মাসে সংঘের সভা হয়। পার্থক্য হলো শুধু আপা নেই। আজ আপা নেই, কিন্তু তাঁর স্নেহভাজন সদস্য বোনেরা আছেন। আমরা সবাই মিলেই চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘেকে সংঘকে নিয়ে যাবো সুন্দর আগামীর দিকে। ইনশাআল্লাহ। ফাহমিদা আপা চিরদিন বেঁচে থাকবেন আমাদের সবার এবং লেখিকা সঘের মাঝেই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপারস্পরিক সহযোগিতা প্রয়োজন
পরবর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে