মাধ্যমিকে পড়ার সময়ে একবার ক্লাসের মাঝখানেই দিদিমণি বিশেষ কোনো কারণে ক্লাস থেকে বের হয়েছিলেন হয়তো। তখন ক্লাসের শৃঙ্খলা রক্ষার তাগিদেই ক্লাস লিডারকে বলে গেলেন বিশৃঙ্খলাকারীদের নাম তালিকাভুক্ত করতে। দিদিমণি খানিক পরেই এলেন। লিডার নামের তালিকা পেশ করলেন।
প্রথম নামেই আমি! দিদিমণি চোখ পাকিয়ে তাকালেন,‘কী করেছে সে?” ‘হেসেছিলো’! দিদিমণি হুট করেই একগাল হেসে দিলেন। আমিও। পাশাপাশি লিডার। দিদিমণি ভারী কাচের চশমা ঠিক করতে করতে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘হাসি তেমন গুরুতর কোনো অপরাধ নয়, যদি সেটা কারোর ক্ষতির কারণ না হয়। সে আশা করি কারোর কোনো ক্ষতি করেনি। তাই তার কোনো শাস্তি হবে না।’ সেই তরুণী দিদিমণি এখন বয়োবৃদ্ধ। স্কুল পেরোনোর পরেও তার সাথে খুব যোগাযোগ ছিলো। যতবার দেখা হয়েছে, আমি এখনও একগাল হেসেই কথা বলি। হাসিটা চলে আসে আপনা–আপনি। পুকুরে স্নানের সময় বোনেরা একসাথে হলে হাসির ফোয়ারা ওঠে যেনো। মা কাকিমাদের কঠোর শাসন উপেক্ষা করে কত কত হেসেছি খলখলিয়ে। আকর্ণপ্রসারিত সেই হাসি দু‘চোখে সহ্য হতো না যেনো তাঁদের। ‘এত বড় মেয়েরা এত শব্দ করে হাসে না, কথা বলে না’
লম্বা চুলগুলোতে তেল দিয়ে বেণী করে দেবার সময় মা কতো বুঝিয়েছেন।
ধুর, মনেই থাকতো না কক্ষণো! রাস্তা লাগোয়া পুকুরে আসা যাওয়ার পথে উৎসুক পথচারীর কত নিন্দেমন্দ! তাও কি হাসি থামতো? থেমেছে, কালস্রোতে। এখন খাঁ খাঁ বাড়ির সেই শানবাঁধানো পুকুরঘাট ভরে গেছে শ্যাওলাতে। সেখানে খলখলিয়ে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়া মেয়েগুলো নেই শুধু। তারা পরিণত! সংসারী! তবে হাসিটা থামেনি এখনও। একসাথে হবার প্রতিটা ক্ষণ এখনও সেই পুকুরঘাট হয়ে ওঠে নিমিষেই।
কলেজ পেরিয়ে অনার্স ফার্স্ট ইয়ার! ভীষণ ভীষণ সুন্দর একটা সময়। একদিন রিকশাওয়ালা নামিয়ে দিয়েছিলো রিকশা থেকে মেয়েগুলোকে। অপরাধ ছিলো সেই ‘হাসিই’! কত বড় স্পর্ধা! রিকশাওয়ালার নাকি খুব সমস্যা হচ্ছিলো মেয়েগুলোর হাসিতে।
মেয়েমানুষের এত হাসি তার পছন্দ নয়, বেরসিক রিকশাওয়ালা! তাই মাঝপথে রিকশা থামিয়ে ভীষণ বকাঝকা করে নামিয়ে দিলো। তাতেও তো হাসি থামলো না, রিকশাওয়ালার এমন চমকপ্রদ আচরণে হাসি বেড়ে গেলো দ্বিগুণ! আর এত এত বছর পর যখনই মনে পড়ে অজান্তেই আবার সেই হাসিই ফুটে ওঠে ঠোঁটের কোণে! একটা বিশেষ অনুষ্ঠানে এক বিশিষ্ট ব্যক্তিকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়েই অথবা হঠাৎ চেনা একটা চেহারা দেখেই হয়তো তাঁর নামের দ্বিতীয় অংশটা ভুল বলে ফেলেছিলাম হাসতে হাসতেই। তিনি তাঁর সঙ্গীর সাথে আলাপচারিতা থামিয়েই তাঁর চোখজোড়া তুলে তাকালেন, নামটা শুধরে দিলেন। তাঁর সেই তাকানোতে কী ভীষণ রাগ, আমি দমে গেলাম। কিন্তু হাসিটা কোনোভাবেই থামানো গেলো না। তবে এখনো যখনই তাঁকে দেখি, অথবা মনে পড়ে ঠিক হেসে দিই। হাসিটা রয়েই গেলো। হাসি নিয়ে বিশিষ্টজনেরা নানাভাবে তাঁদের মতামত দিয়েছেন। বেশিরভাগই ইতিবাচক। যদি অন্যের অশান্তির কারণ না হয়, তবে হাসিই পৃথিবীর সবচেয়ে শুদ্ধতম বিষয়। এটা আমার ধারণা!
একজন মানুষকে তার চরম হতাশায়, চরম দুঃখের দিনগুলোতে সামান্য প্রশান্তি দিতে যদি আপনি মন ভালো করা আনন্দ অনুভূতি দিতে পারেন, তবে নিঃসন্দেহে তা খুব ভালো একটি কাজ। আমি অন্যের প্রশান্তির কারণ হচ্ছি, অথবা আমায় দেখে কেউ তার যাপিত জীবনের সমস্ত গ্লানি ভুলে হাসছে। এটাই সবচে সুখকর অনুভূতি। মন খুলে হাসতে পারাটাও বিশেষ সৌভাগ্য। হাসিতে মানুষের শরীর সুস্থ থাকে, মন ভালো থাকে, অন্যের মনটাও হয়তো আপনার হাসিমুখ দেখে ভালো হয়ে গেলো। ক্ষতি কী, যদি এমনটা হয়। এতো কঠিন কোনো অনুশীলন নয়।
কবিগুরুই হয়তো বলেছিলেন, মানুষের বয়স বাড়লে সবটাই পরিবর্তিত হয়, শুধু হাসি ছাড়া। দৈনিক আজাদীতে কবি হেলাল চৌধুরী লিখেছিলেন হাসি নিয়ে। মাদার তেরেসা বলেছিলেন, ‘শান্তির শুরু হয় হাসি থেকে ’! সত্যিই তাই। হাসির কোনো বিকল্প নেই হয়তো। কিশোর মজুমদার খুব সুন্দর করে বলেছেন, ‘হাসির চেয়ে ছোঁয়াচে পজিটিভ কিছু নেই’! হাসি সংক্রামক! মারাত্মকভাবে সংক্রমিত হয় ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে। কাউকে হাসতে দেখে অবচেতনে অন্যজন হাসেনি, তা হতে পারে না। শুধু হাসি দিয়েই মানুষ অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে, অনেক জটিল পরিস্থিতি সহজ করতে পারে। আসুন, মন খুলে হাসি।