বাটালি হিলে চসিকের প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিশ্চয়তা

পরিবেশ ও সামাজিক সুরক্ষা বিবেচনায় ঝুঁকি আছে বলে মনে করছে অর্থায়নকারী সংস্থা বিশ্বব্যাংক

মোরশেদ তালুকদার | সোমবার , ১৩ নভেম্বর, ২০২৩ at ৬:১৩ পূর্বাহ্ণ

নগরের বাটালি হিলে ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণসহ পাহাড়টির শোভাবর্ধনে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) গৃহীত প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। পরিবেশ ও সামাজিক সুরক্ষা বিবেচনায় এ প্রকল্প বাস্তবায়নে যথেষ্ট মাত্রায় ঝুঁকি রয়েছে বলে মনে করে প্রকল্পটির অর্থায়নকারী সংস্থা বিশ্বব্যাংক। পরিবেশ ও সামাজিক কাঠামো (ইএসএফ) অনুসারে যথেষ্ট বা উচ্চ মাত্রার ঝুঁকি থাকলে এ প্রকল্পে অর্থায়ন করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।

চসিক সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের বাস্তবায়নাধীন ‘লোকাল গভর্নমেন্ট কোভিড১৯ রেসপন্স অ্যান্ড রিকভারি প্রজেক্ট’ (এলজিসিআরআরপি) শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় চসিকের জন্য বরাদ্দ আছে ২৬৭ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। বরাদ্দকৃত অর্থের বিপরীতে বেশ কিছু উপপ্রকল্প হাতে নেয় চসিক। এর মধ্যে বাটালি হিল পার্ক নির্মাণ প্রকল্পও রয়েছে। এলজিসিআরআরপির সর্বশেষ প্রস্তাবনায় বাটালি হিল প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৫ কোটি টাকা। এদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানও নিয়োগ দিয়েছে চসিক।

জানা গেছে, বাটালি হিল পার্ক নির্মাণ প্রকল্পটির আওতায় সেখানে একটি ‘বীর চট্টলা ওয়াচ টাওয়ার’ নির্মাণসহ পর্যটকদের সুবিধা বৃদ্ধির পরিকল্পনা আছে চসিকের। এক্ষেত্রে মুক্তমঞ্চ নির্মাণ, ঝুলন্ত টানেল নির্মাণ, বাটালি হিলের সাথে সিআরবির ইকোব্রিজ বা ক্যাবল কার নির্মাণের পরিকল্পনা আছে।

বর্তমানে ফিনল্যান্ড আছেন চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। দেশে থাকা অবস্থায় তিনি আজাদীকে বলেছিলেন, নদী, সমুদ্রে ঘেরা প্রকৃতির লীলাভূমি চট্টগ্রামের নান্দনিকতাকে উপভোগ করতে বাটালি হিলে ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ টাওয়ারকে শহরের প্রধান পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তোলা হবে।

বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষণ : ৫ নভেম্বর বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে চসিকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং বাটালি হিলের শোভাবর্ধনে গৃহীত প্রকল্পের স্থাপত্য ও ডিজাইন পরামর্শকদের সঙ্গে একটি সভা হয়। এতে বাটালি হিল প্রকল্পটির বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। পরদিন বিশ্বব্যাংকের জ্যেষ্ঠ পরিবেশ ও সামাজিক সুরক্ষা কর্মকর্তাগণ এ প্রকল্প নিয়ে বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে চিঠি দেন প্রকল্প পরিচালককে।

বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ১৯৬১ সালের মাস্টার প্ল্যানে বাটালি হিলকে বোটানিক্যাল গার্ডেন হিসেবে সংরক্ষণের জন্য বিশেষ জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ২০২৩ (ইসিআর ২০২৩) অনুসারে, এখানে ঝুঁিকর মাত্রা ‘কমলা’। বিশ্বব্যাংকের পরিবেশ ও সামাজিক কাঠামো অনুসারে যথেষ্ট বা উচ্চ মাত্রার ঝুঁকি থাকলে এ প্রকল্পে এলজিসিআরআরপির অধীনে অর্থায়ন করা যাবে না। এছাড়া প্রকল্প এলাকায় রয়েছে গণপূর্ত বিভাগের আওতায় সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসন ব্যবস্থা। তাই গণপূর্ত বিভাগও পাহাড়টির অংশীদার হতে পারে। একইসঙ্গে চট্টগ্রামের জন্য বোটানিক্যাল গার্ডেন করা নিয়ে বন বিভাগ, পর্যটন স্পট করতে জেলা প্রশাসন ও বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন, হেরিটেজ প্রসঙ্গে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ইতোপূর্বে পাহাড়টিতে বনায়ন করায় পুলিশ বিভাগ ছাড়াও পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় লোকজনও বাটালি হিলের অংশীজন হিসেবে বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষণে উঠে আসে।

এ বিষয়ে চসিকের প্রধান প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, কিছু পর্যবেক্ষণ এসেছে, কিন্তু প্রকল্পে অর্থায়ন না করা নিয়ে চূড়ান্ত কিছু হয়নি। তারা পরিবেশগত রিপোর্ট ও কিছু সাপোর্টিং ডকুমেন্ট চেয়েছে। আমরা সেগুলো দেব। আশা করছি প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে।

বাটলি হিল পার্ক নির্মাণ প্রকল্পটি নিয়ে ইতোমধ্যে অনুষ্ঠিত চসিকের কয়েকটি সভায় উপস্থিত ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট চট্টগ্রামের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার। তিনি আজাদীকে বলেন, বাটালি হিল অপদখল হয়ে যাচ্ছে। এটার ঐতিহাসিক গুরুত্বও আছে। তাই মেয়রের পরিকল্পনা হচ্ছে, পাহাড়াটি এমনভাবে ব্যবহার করা, যাতে এটি দখলমুক্ত হয় এবং কাটাকাটি বন্ধ হয়। একইসঙ্গে পাহাড়টিকে যেন মানুষ বিনোদনের জায়গা হিসেবে বেছে নেয়। এখানে ওয়াচ টাওয়ার, মাঝামাঝি কোথাও একটি রেস্টুরেন্ট, নিচের দিকে কোথাও শিশুদের খেলাধুলার ব্যবস্থা, একদিকে কার পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা এবং একটি জাদুঘর করারসহ এমন কিছু চিন্তাভাবনা থেকে মেয়র বাটালি হিলকে ঘিরে পরিকল্পনা নিয়েছেন। একইসঙ্গে বাটালি হিলের সঙ্গে অন্য কোনো পাহাড়ের ক্যাবল কার যুক্ত করারও চিন্তা রয়েছে মেয়রের।

বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষণ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগটাকে আমি সমর্থন করি। আবার সতর্কতার সঙ্গে এটাও বলছি, এখানে যেন অতি বাণিজ্যিকীকরণ করা না হয়। অতিরিক্ত রেস্টুরেন্ট যেন না হয়। আমার প্রস্তাব হচ্ছে, এখানে দৈনিক কতজন ভিজিটর যেতে পারবেন তা আগেভাগে নির্ধারণ করতে হবে। অতিরিক্ত ভিজিটর নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। একসঙ্গে অতিরিক্ত লোকের সমাগম যেন না ঘটে সেটা দেখতে হবে। এজন্য প্রতি ঘণ্টায় কত লোক যেতে পারবে তা ঠিক করা যেতে পারে। এগুলো করলে মনে হয় কোনো সমস্যা হবে না। যদি পুরোটা রেস্টুরেন্ট করে ফেলে, রেস্টুরেন্টে আড্ডার জায়গা বানিয়ে ফেলে, তাহলে পরিবেশ ঠিক থাকবে না।

উল্লেখ্য, নগরের টাইগারপাস এলাকায় অবস্থিত বাটালি হিল ‘জিলাপি পাহাড়’ নামেও পরিচিত। এটি শহরের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, পাহাড়টির উচ্চতা ২৮০ ফুট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পাহাড়টির চূড়ায় বিমান বিধ্বংসী কামান স্থাপন করা হয়েছিল। এই পাহাড় শীর্ষ থেকে কর্ণফুলীর মোহনা ও বঙ্গোপসাগর স্পষ্ট দেখা যায়। বর্তমানে ওই পাহাড়ের দক্ষিণাংশ কেটে ফেলা হয়েছে। কথিত আছে, দূর সমুদ্রে চলাচলকারী জাহাজের দিকনির্দেশনার জন্য বাটালি হিলের উপর একটি বাতিঘর ছিল। পুলিশের সৌজন্যে ২০০৩ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বাটালি হিলে বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় সাড়ে ১২ হাজার গাছ রোপণ করা হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধখাগড়াছড়িতে কাল বড় দুই প্রকল্পের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধহাজার কোটি টাকা চায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী