মৃত্যু যখন অতর্কিতে আঘাত করিল তখন কি দেখলাম? দেখিলাম, পৃথিবী যেমন চলিতেছিল, তেমনভাবেই চলিতেছে। মানুষের চলাফেরা, কাজকারবার, কোলাহল–সংঘর্ষ সকলই চলিতেছে। শুধু এক জায়গায় জাগাইয়া তুলিল অশান্ত ক্রন্দনের বিপুল বেদনা। শুধু এক জায়গায় জ্বালিয়া তুলিল বিয়োগ দুঃখের তীব্র হুতাশন। ভরা সংসারের মধ্যে এক মুহূর্তে উছলিয়া উঠিল মহাশূন্যতার আর্তনাদ। ’
নিজ ডায়েরিতে মৃত্যুর মাস খানেক আগে (সম্ভবত) নিজ হাতে লিখে গিয়েছিলেন অধ্যক্ষ যোগেশ চন্দ্র সিংহ। ১৯৭৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর রহমতগঞ্জস্থ নিজ বাসভবনে তিনি দেহত্যাগ করেন। অথচ তিনি তাঁর দেহত্যাগের আগেই এমন অনুভূতির কথা অকপটে লিখে গেছেন। আমরা মৃত ব্যক্তির শোকে আচ্ছন্ন থাকলেও, পরবর্তীতে এই শোক কি স্থায়ী থাকে? এমন প্রশ্ন তিনি নিজেই করে লিখেছেন: ‘কিন্তু তাহাও কি চিরন্তন? জাগতিক কিছুই চিরন্তন নহে। জগতে সবই চলিতেছে, চলিতেছে, চলিতেছে। এই চলার শেষ নাই। এই চলার পথে কত কিছুই ফুটিয়া উঠিতেছে। কোথাও কোন অবস্থাকে বলিতেছি সুখ, কোথাও দুঃখ, কোথাও হাসি, কোথাও ক্রন্দন, কোথাও জীবন মরণ। কিন্তু সত্য দৃষ্টিতে দেখিতে পারিলে বুঝিতে পারিতাম, এই যে নানা রঙের, নানা ভঙিমায় নানা কিছুর উদ্ভব হইতেছে – ইহারা সকলেই এক পরম মহান সত্তার মধ্যে বিধৃত রহিয়াছে’।……. আজ এত দীর্ঘ বছর পর ভাবতে অবাক লাগে নিজ মৃত্যু চিন্তা কিংবা এই বিষয়ে তাঁর নিজ দর্শন নিয়ে মতামত লিখে গেছেন।
যোগেশ চন্দ্র সিংহ আমার প্রমাতামহ। আমার মা মিনতি বিশ্বাস ( দাশগুপ্ত) তাঁর নাতনি। সেই সূত্রে আমি শৈশব থেকেই বড়বাবা যোগেশ চন্দ্র সিংহকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ যেমন পেয়েছি, তেমনি সান্নিধ্যে থাকতে পেরেছি। ঘুম ও বিশ্রাম ছাড়া তাঁর সময় কাটতো নিজের পাঠাগারে। সারি সারি বই। অবাক হতাম এই ভেবে যে, একজন মানুষ কিভাবে সারাক্ষণ বইয়ের মধ্যে থাকতে পারে। বিনোদন ছিল – রেডিওতে খবর শোনা, রবীন্দ্র সংগীত শোনা। বড়বাবার সাথে চট্টগ্রামের বিভিন্ন সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গিয়েছি। তখন আমার বড়মা স্বর্ণলতা সিংহ ( যোগেশ চন্দ্র সিংহের স্ত্রী) আমায় সাথে নিয়ে যেতেন। তখন দেখেছি, বড়বাবার প্রতি সর্বস্তরের মানুষের অসীম ভক্তি ও শ্রদ্ধা।
যোগেশ চন্দ্র সিংহ তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে ব্যস্ত ছিলেন অধ্যাপনা আর সাহিত্য রচনায়। ফলে, অধ্যাপনা থেকে অবসরের পর নিয়মিত সাহিত্য রচনা করে গেছেন। বই প্রকাশ করেছেন। যখন আর বই প্রকাশ থেকে বিরত থাকলেন, নিজ ধ্যানে ও মনে ডায়রি লিখেছেন এবং পড়েছেন। শেষ বয়সে এসেও এমনকি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি লেখা ও পড়ার মধ্যেই ছিলেন। অসীম পাণ্ডিত্যের অধিকারী জ্ঞানতাপস যোগেশ চন্দ্র সিংহ জন্মেছিলেন চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার সাধনপুর গ্রামে, ১২৯৭ বঙ্গাব্দের ১৫ জৈষ্ঠ্য তারিখে। তাঁর পিতা সাধনপুর গ্রামের জমিদার প্যারীমোহন সিংহের পূর্বপুরুষগণ কুমিল্লা জেলার কালিকচ্ছ হতে এসে সাধনপুর গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। বড়বাবা ছিলেন এই সিংহ বংশের অষ্টম উত্তরাধিকার।
শিক্ষা জীবন: যোগেশ চন্দ্র সিংহ বর্তমানের সাধনপুর – বাণীগ্রাম মাইনর স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ১৯১০ সালে পটিয়া স্কুল হতে নতুন চালু হওয়া মেট্রিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে পাশ করেন। ১৯১২ সালে কলিকাতা সিটি কলেজ হতে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন প্রথম বিভাগে এবং ‘বঙ্কিম মেডেল’ অর্জন করেন। কলিকাতা সিটি কলেজ হতে প্রথম শ্রেণিতে ইংরেজি বিভাগে অনার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইংরেজি বিভাগে প্রথম শ্রেণিতে এম.এ পাশ করেন।
কর্মজীবন: কলিকাতা থেকে ফিরে যোগেশ চন্দ্র সিংহ ১৯১৮ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৪৮ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত টানা ত্রিশ বছর বৎসর অধ্যাপনা করার পর চট্টগ্রাম কলেজ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। (এখানে উল্লেখ্য যে, ভারত ও পাকিস্তান নামে দুই রাষ্ট্রের উদ্ভব হয় তাঁর কর্মজীবনের সময়ের মধ্যে। চট্টগ্রাম কলেজের অন্যান্য সহকর্মী ভারতে চলে গেলেও মাতৃভূমির টানে যোগেশ চন্দ্র সিংহ চট্টগ্রামে থেকে যান। এমনকি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়েও তিনি সপরিবারে চট্টগ্রামে রহমতগঞ্জস্থ নিজ বাসভবনে কাটিয়েছিলেন।)
১৯৪৯ সালে চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম কমার্স কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে, যোগেশ চন্দ্র সিংহ ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত দুই বছর কমার্স কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রামে প্রথম নৈশ কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে, তিনি এই কলেজে প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে এই নৈশ কলেজ বর্তমানে চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজে রূপান্তরিত হয়। ১৯৫৭ সালে চট্টগ্রামে প্রথম মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি এই কলেজেরও প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, নৈশ কলেজ ও মহিলা কলেজ ছিল বর্তমানের নজির আহমদ চৌধুরী সড়কস্থ এম.ই.এস স্কুল ভবনে। ১৯৬০ সালের ৩১ ডিসেম্বর যোগেশ চন্দ্র সিংহ চাকুরি বিধিমালা মোতাবেক মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
যোগেশ চন্দ্র সিংহ লিখিত গ্রন্থাবলি: অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি নানাবিধ বই লিখেছেন। পরে অবসর গ্রহণ করার পরেও বই লিখেছেন। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তাঁর এই বই লেখা অব্যাহত ছিল। তাঁর লিখিত গ্রন্থাবলির মধ্যে আছে:
১. মাতৃবন্দনা (১৯৪৪) ২. মাতৃ প্রশস্তি (১৯৪৪) ৩. পিতৃ তরপন (১৯৫৩) ৪. পিতৃ পূজা (১৯৪৭) ৫. আমার ধর্ম, প্রথম ভাগ ৬. আমার ধর্ম দ্বিতীয় ভাগ ( ১৯৪৭) ৭. দুর্গাপূজায় নবপত্রিকা তত্ত্ব (১৯৬৩) ৮. পরমহংস অদ্বৈতানন্দ (১৩৭৩ বঙ্গাব্দ) ৯. রাসলীলা (১৯৬৪) ১০. সরস্বতী তত্ত্ব (১৯৬৭) ১১. সীতাকালী (১৯৬৮) ১২. ধ্যানী রবীন্দ্রনাথ (১৯৬৪, ১ম সংস্করণ। ১৯৭২, ২য় সংস্করণ। ১৯৮০, ৩য় সংস্করণ) ১৩. গীতা বোধিনী –৪ খণ্ড ( ১৩৭২, ১৩৭৩,১৩৭৪ বঙ্গাব্দ এবং ১৯৬৯ খৃষ্টাব্দ)।
যোগেশ চন্দ্র সিংহ স্বর্ণপদক: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগেশ চন্দ্র সিংহ স্বর্ণপদক চালু করার উদ্যোগ নেন তাঁর স্ত্রী স্বর্ণলতা সিংহ। ১৯৮১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তারিখে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. আবদুল আজিজ খানের কাছে পঁচিশ হাজার টাকার চেক প্রদান করেন বড়মা স্বর্ণলতা সিংহ। বাংলা বিভাগে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া কৃতী শিক্ষার্থীই এই স্বর্ণপদক পাবেন। ১৯৮৩ সালে যোগেশ চন্দ্র সিংহ স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন ড. মহীবুল আজিজ। ১৯৮৪ সালে পেয়েছিলেন ড. তাসলিমা বেগম। এই পদক আজও চালু আছে। ইতিমধ্যে আরও কয়েকজন পেয়েছেন।
যোগেশ চন্দ্র সিংহ ছিলেন তাঁর সময়ে বৃহত্তর চট্টগ্রামে এবং কলিকাতায় সর্বজন শ্রদ্ধেয়। তিনি ছিলেন সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার বাইরের এক উজ্জ্বল মানুষ। মাতৃভূমির টানে তিনি প্রিয় চট্টগ্রামেই সারাজীবন কাটিয়ে গেলেন। বোধ করি, সেই কারণেই যোগেশ চন্দ্র সিংহ হতে পেরেছিলেন অজাতশত্রু, জাতি–ধর্ম–বণ–সম্প্রদায় নির্বিশেষে সবার প্রিয় আপনজন।
১৯৭৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তারিখে সন্ধ্যায় তিনি দেহত্যাগ করেন। যেমনটি তিনি লিখেছিলেন, ঠিক তেমনটিই ঘটেছে। তিনি মানব জীবনের ঘূর্ণায়মান চক্র নিয়ে গবেষণা করেছেন। চিন্তা করেছেন সৃষ্টির দর্শন নিয়ে। মৃত্যু তত্ত্ব নিয়ে। এমনতর লেখা আমরা পাই তাঁর লিখিত ‘ধ্যানী রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে। তিনি এখানে লিখেছেন: ‘মৃত্যু, প্রত্যেকের অন্তরের অন্ত:স্থলে, দেহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুপ্রবিষ্ট থাকিয়া জন্ম–স্থিতি–বৃদ্ধি–পরিণাম–অপক্ষয়–বিনাশ প্রভৃতি এই ষড়বিধ বিকারের মধ্য দিয়া অলঙ্ঘ গতিতে ক্রীড়াশীল। যাহাতে স্থুল দৃষ্টিতে বলা হয় জীবন লীলা’।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংস্কৃতিকর্মী