চার মাস আগে রাজধানী ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাস্টম হাউজের গুদামের সিসিটিভি ক্যামেরা বিকল হয়ে যায়। ওই বিকল সিসিটিভি ক্যামেরা মেরামত বা নতুন করে আর প্রতিস্থাপন করা হয়নি।
সেই সুযোগে পরিকল্পিতভাবে গুদামের লকার থেকে পর্যায়ক্রমে লুট করা হয় ৫৫ কেজি ৫১ গ্রাম সোনা। সোনা লুটের সঙ্গে ঢাকা কাস্টম হাউজের একাধিক কর্মকর্তা জড়িত রয়েছেন বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কাস্টম হাউজের গুদামের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও চার সিপাহীকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে বিমানবন্দর থানা পুলিশ। তবে জিজ্ঞাসাবাদে সন্দেহভাজন আটজনই ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দিচ্ছে।
এতে মামলার এজাহারে থাকা তথ্যের সঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদে সন্দেহভাজনদের তথ্যের মিল পাওয়া যাচ্ছে না। সোনা লুটের ঘটনাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে মামলার এজাহারে গুদামের লকার ভেঙে সোনা চুরি যাওয়ার মিথ্যা তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।
তারা বলছেন, ঢাকা কাস্টম হাউজের নিজস্ব গুদামে সাধারণত কোনো ব্যক্তির প্রবেশ করার সুযোগ নেই।
এছাড়া গুদামে থাকা এসির হাওয়া বের হওয়ার স্থানে টিন কেটে কোনো চোরের পক্ষে এক রাতে এত সোনা চুরি করে কেপিআই-এর মতো নিরাপদ জায়গা থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়। কয়েক মাস ধরে পরিকল্পিতভাবে গুদামের লকার থেকে এসব সোনা লুট করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর এই লুটের ঘটনাটি ও প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করে চুরির নাটক সাজিয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিমানবন্দর থানায় একটি মামলা দায়ের করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ, অডিটে যাতে কাস্টমস হাউজের কোনো কর্মকর্তা ফেঁসে না যায়।
পুলিশ হেফাজতে থাকা চার সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও চার সিপাহী জিজ্ঞাসাবাদে গরমিল তথ্য দিয়েছে।
গুদামের ভেতরে সিসিটিভি ক্যামেরা না থাকা এবং দীর্ঘদিন ধরে বাইরের সিসিটিভি ক্যামেরা বিকল থাকার বিষয়ে গরমিল তথ্য পাওয়া গেছে।
এছাড়াও সোনা চুরির সম্ভাব্য সময় ও চুরির গতিপথ, সেখানে চুরির আলামত না থাকা এবং মামলার এজাহারের তথ্য, সবকিছুতেই গরমিল পাওয়া গেছে। তবে তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় সার্বিক বিষয়ে তদন্ত চলছে।
পুলিশ হেফাজতে থাকা আটজনকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যে নিশ্চিত হওয়া গেছে বিমানবন্দরে ঢাকা কাস্টম হাউসের গুদামে থাকা লকার থেকে ৫৫ কেজি ৫১ গ্রাম সোনা লুটে জড়িত রয়েছে কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি চক্র।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, কাস্টম হাউজের গুদামের নিরাপত্তার দায়িত্বে কর্মরত ছিলেন ‘এ’, ‘বি’, ‘সি’ ও ‘ডি’ শিফটের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মাসুম রানা, সাইদুল ইসলাম শাহেদ, শহিদুল ইসলাম ও আকরাম শেখ। এছাড়াও ছিলেন রেজাউল করিম, মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক, আফজাল হোসেন ও নিয়ামত হাওলাদার নামে চার সিপাহী।
মামলা দায়েরর পর প্রথমে চার সিপাহীকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। এরপর গুদামের দায়িত্বে থাকা চার সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নেওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদে সোনা লুটের ঘটনায় সিপাহীদের মধ্যে একজনের সংশ্লিষ্টতার তথ্য পাওয়া গেছে। তার দেওয়া তথ্যের মধ্যে দুই সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তার নাম উঠে এসেছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে এক সিপাহীসহ দুই সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হবে বলে জানিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) উত্তরা বিভাগের তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, গায়েব হওয়া সোনা ২০২০ থেকে ২০২৩ সালে বিভিন্ন সময় জব্দকৃত। কিন্তু মামলার এজাহারে ডিএম নম্বর পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, গায়েব হওয়া সোনাগুলো গুদামে এসেছিল চলতি ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যকার সময়ে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) বিমানবন্দর জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) তৌহিদুল ইসলাম বলেন, “এ ঘটনায় তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সন্দেহভাজন হিসেবে পুলিশ গুদামের চার সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও চার সিপাহীকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে।”
তিনি বলেন, “ইতোমধ্যে এ ঘটনায় এক সিপাহী ও দুই সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তার কাছে চুরি সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে।”
বিমানবন্দর রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা (কেপিআই) উল্লেখ করে ডিএমপির উত্তরা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোর্শেদ আলম বলেন, “বিমানবন্দরের ভেতরের সব জায়গা সিসিটিভি ক্যামেরায় নজরদারিসহ সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার মধ্যে রাখা হয় অথচ ঢাকা কাস্টম হাউজের গুদামে সিসিটিভি না থাকাটা উদ্বেগজনক।”
তিনি বলেন, “ঘটনাস্থলে সোনা চুরির কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। একটি বিষয় পরিষ্কার, কাস্টম হাউসের নিজস্ব গুদামে যার-তার প্রবেশের সুযোগ নেই। সেখানে এক রাতে বাইরের কেউ এসে গুদাম থেকে সোনা চুরি করে যেতে পারবে না। এ ঘটনায় তদন্ত চলছে, তদন্ত শেষে বিস্তারিত জানানো হবে।”