চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) ২০১৬–২০১৭ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন প্রতিবেদনে বলা হয়, নগরের মোট আয়তনের ৬ দশমিক ৮ শতাংশ এলাকায় জলাবদ্ধতা হচ্ছে। অথচ চলতি মৌসুমে ভারী বর্ষণ ও জোয়ারের প্রভাবে নগরের ৪০ শতাংশ এলাকায় জলাবদ্ধতা হয়েছে। অর্থাৎ সাত বছরে জলাবদ্ধতার তীব্রতা বেড়েছে শহরে। প্লাবিত হয়েছে নতুন নতুন এলাকা। এতে বেড়েছে মানুষের দুর্ভোগও।
অথচ এ সাত বছরে জলাবদ্ধতা নিরসনে পৃথক তিন সংস্থা ১১ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকায় চারটি প্রকল্প নেয়, যেগুলোর কাজ চলমান। প্রকল্পগুলোর বিপরীতে সরকার ইতোমধ্যে ছাড় করেছে ৬ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। একইসময়ে প্রকল্পের বাইরে রাজস্ব তহবিল থেকে জলাবদ্ধতা দূরীকরণে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন খরচ করে ৫১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এ অবস্থায় স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠে সাত বছরে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচের পরও জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ থেকে মুক্তি মিলছে না কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে বিশেষজ্ঞ থেকে স্থানীয় লোকজনের বেশিরভাগই মোদ্দাকথায় বলেছেন, বৃষ্টির পানিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা পেতে হলে পানি প্রবাহ স্বাভাবিক রাখার জন্য বিদ্যমান খাল নিয়মিত খনন করে পরিষ্কার রাখতে হবে। জোয়ারের পানির জন্য সৃষ্ট জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষায় প্রয়োজন খালের মুখে পাম্প হাউজসহ স্লুইস গেইট নির্মাণ করে চালু করা। যার কোনোটার বাস্তবায়ন পুরোপুরি হয়নি।
তাছাড়া দীর্ঘমেয়াদি জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী করা হয় অপরিকল্পিত নগরায়নকে। এক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, একসময় শহরে যে পরিমাণ জলাধার ছিল তা আবাসনসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নের কারণে কমে গেছে। এছাড়া শহরের দুই প্রান্তে যে উঁচু সড়কগুলো হয়েছে পানি প্রবাহে সেগুলো বাধাগ্রস্ত করছে। এক্ষেত্রে সেখানে পানি প্রবাহে পর্যাপ্ত জায়গা রাখলে সমস্য হতো না।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মনিরুল হুদা আজাদীকে বলেন, জলাবদ্ধতার মূল কারণ অপরিকল্পিত নগরায়ন। বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করার সময় জলপ্রবাহের যে রাস্তা ছিল তা বন্ধ করে দেয়া হয়। সে কারণেই জলাবদ্ধতার সমস্যা হচ্ছে। এর বাইরে এলাকা ভিত্তিকও নানা কারণ থাকতে পারে।
অপরিকল্পিত নগরায়নের উদাহারণ দিতে গিয়ে এ প্রকৌশলী বলেন, বাকলিয়া এলাকায় অনেক বড় বড় সড়ক হয়েছে। সেজন্য মানুষের উপকার হয়েছে। আবার এসব সড়কের জন্য জলাবদ্ধতাও হচ্ছে। বহাদ্দারহাট থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত সড়কটি হওয়ার আগে জলাবদ্ধতা তেমন হত না। ওই সড়কটি যখন প্রথম করা হয় তখন আশেপাশের জমি থেকে তার উচ্চতা ছিল প্রায় ১৪ ফুট। আগে পানি সহজেই চলে যেত পারত। নতুন হওয়া সড়কটির জন্য তখন বাধাগ্রস্ত হয়। মূলত ওই বছর থেকেই শহরের মূল এলাকায় পানি উঠতে থাকে। যদি সড়কের সঙ্গে পানি যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা রাখত তাহলে সমস্যা হত না। একইভাবে পিসি রোড হওয়ার পর থেকে আগ্রাবাদে পানি উঠতে থাকে। এর আগে তেমন পানি হত না সেখানে। যখন ওই সড়কটি করা হয় তা আশেপাশের জায়গা থেকে ৮–১০ ফুট উঁচু ছিল।
অল্প বৃষ্টি হলেই ডুবে যায় বাকলিয়ার বেশির ভাগ এলাকা। চসিকের ২০১৭ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী দক্ষিণ বাকলিয়ার ১৯৩ দশমিক ২ হেক্টর এবং পূর্ব বাকলিয়ার ৭২ দশমিক ৯ হেক্টর আয়তন এলাকায় জলাবদ্ধতা হয়। যা বর্তমানে বেড়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি না পাওয়া প্রসঙ্গে পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ শহিদুল আলম আজাদীকে বলেন, জলাধার এবং লো ল্যান্ড কমে গেছে। অনেকগুলো আবাসিক এলাকা হয়েছে যেখানে আগে নিচু জমি ছিল। শহরের পানি ওইসব জলাধার হয়ে কর্ণফুলীতে গিড়ে পড়ত। রিং রোড হওয়ার পরও পানি কর্ণফুলীতে যেতে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। কারণ পানি নামার পথ কমে গেছে।
সমাধান কোথায়?
১৯৯৫ সালে প্রণীত ২০ বছর মেয়াদী মাস্টার বেশ কিছু সুপারিশ রয়েছে। যা বাস্তবায়ন করা গেলে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি মিলত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। মাস্টার প্লানের সুপারিশ অনুযায়ী, বিদ্যমান খালগুলোর বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করে তা দূর করার পাশাপাশি নতুন তিনটি খাল খনন, পুরাতন খালের গভীরতা বৃৃদ্ধি ও প্রশস্তকরণসহ সংস্কার করা, পাহাড়ের পলিমাটি ধারণের জন্য সিল্টট্রাপ নির্মাণ, নগরের অতিরিক্ত পানি ধারণের জন্য জলাধার নির্মাণ, জোয়ারের সময় নদীর পানি শহরে ব্যাক ফ্লু না করার জন্য জোয়ার নিয়ন্ত্রক (টাইডাল রেগুলেটর) নির্মাণ করা। যার বেশিরভাগই পূরণ হয়নি।
যেমন নতুন তিনটির পরিবর্তে একটি খাল খনন করা হচ্ছে। খালের প্রশস্তা বৃদ্ধি করলেও গভীরতা নিয়ে আছে নানা প্রশ্ন। এছাড়া ৫৭টি খাল থাকলেও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে ৩৬ খালে। জোয়ার নিয়ন্ত্রক বা স্লুইচ গেইট নির্মাণ কাজ শুরু করলেও শেষ হয়নি এখনো। ভূমি জটিলতায় থমকে আছে জলাধার নির্মাণও। এমনকি অর্থাভাবে মেগা প্রকল্পের কাজও বন্ধ হওয়ার পথে।
অতঃপর প্রকল্প :
জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান চার প্রকল্পের মধ্যে তিনটির আওতায় ৪০টি স্লুইচ গেইট নির্মাণ করার কথা। এর মধ্যে মাত্র ৫টির কাজ শেষ হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পভুক্ত ৩৬ খালের মধ্যে শতভাগ কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ১৬টির। ফলে পুরো সুফল মিলছেন না প্রকল্পগুলোর। প্রকল্পগুলোর মধ্যে ২০১৭ সালের আগস্টে একনেকে অনুমোদন পায় পাঁচ হাজার ৬১৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ব্যয়ে সিডিএ’র ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সমপ্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক মেগা প্রকল্প। প্রকল্পটির এ পর্যন্ত অগ্রগতি হয়েছে ৮৬ শতাংশ। এ প্রকল্পের ৩ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকা ছাড় করেছে মন্ত্রণালয়। প্রকল্পের আওতায় ৩৬ খালের মধ্যে ১৬টির কাজ শেষ হয়েছে।
সিডিএ’র দুই হাজার ৭৭৯ কোটি ৩৯ লাখ টাকার ‘কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ’ শীর্ষক অপর প্রকল্পের প্রকল্পের অগ্রগতি হয় ৬৯ শতাংশ। এ প্রকল্পে অর্থ ছাড়া হয় ১ হাজার ২৯১ কোটি টাকা। প্রকল্পের আওতায় জোয়ারজনিত জলাবদ্ধতা নিরসনে কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে যুক্ত ১২টি খালের মুখে ১২টি রেগুলেটর নির্মাণ করার কথা। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাজ চলছে ১০টির। এর মধ্যে চাক্তাই ও রাজাখালী খালে দুটি বড় রেগুলেটর রয়েছে। বাকি দুটি খালে কাজ শুরু হয়নি। এ ছাড়া ৯ কিলোমিটার সড়ক কাম বাঁধের মধ্যে সাত কিলোমিটারের মাটি ভরাটের কাজ শেষ হয়েছে।
নতুন খাল খননে একটি প্রকল্প আছে চসিকের। ২০১৪ সালে গৃহীত ‘বহাদ্দারহাট বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল নতুন খাল খনন’ শীর্ষক এ প্রকল্পের অগ্রগতি হয় ৫৮ শতাংশ। এক হাজার ৩৬২ কোটি ৬২ লাখ টাকার প্রকল্পটির বিপরীতে প্রায় ১১শ’ কোটি টাকা ছাড় করে মন্ত্রণালয়। ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় এ প্রকল্পের ধীরগতির কারণ।
জলাবদ্ধতা নিরসনে আরেকটি প্রকল্প আছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের। এক হাজার ৬২০ কোটি ৭৩ লাখ টাকার ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলমগ্নতা বা জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন’ প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে ২৫ দশমিক ১৫ শতাংশ। এ প্রকল্পে ইতোমধ্যে ছাড় হয়েছে মাত্র ২৩৬ কোটি টাকা।
তবু জলাবদ্ধতা :
চলতি মাসে ২ আগস্ট, ৪ থেকে ৭ আগস্ট এবং ২৭ আগস্ট অর্থাৎ মোট ৬দিন ভয়াবহ জলাবদ্ধতা হয় নগরে। মূলত এ পাঁচদিনই ভারী বৃষ্টি হয়েছে। এর আগে জুলাই মাসে তেমন বৃষ্টিপাত হয়নি। জুন মাসের অল্প বৃষ্টিতেই দুই দিন (৯ ও ১০ জুন) জলাবদ্ধতা হয়েছে। জলাবদ্ধতায় মানুষের দুর্ভোগের সঙ্গে ছিল আর্থিক ক্ষতিও। চলতি মাসের প্রথম পাঁচদিনের জলাবদ্ধতায় দোকান মালিক সমিতির হিসাবে ১৫০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়। একইসময় রেয়াজুদ্দিন বাজারেও কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। গত পরশুও প্রায় কোটি টাকার ক্ষতি হয়। এবার চাক্তাই–খাতুনগঞ্জে তেমন ক্ষতি হয়নি।
জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল শাহ আলী আজাদীকে বলেন, প্রকল্পের কাজ সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত সুফল মিলবে না। তিনি বলেন, সবগুলো খাল–নালা পরিস্কার থাকলেও পানি নামার জন্য ১ থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লাগবে। গত ২৭ আগস্ট বৃষ্টির সময় জোয়ারও এসেছে। যেহেতু স্লুইচ গেইট চালু হয়নি তাই পানি ঢুকে গেছে। এ জন্য জলাবদ্ধাতা হয়েছে।
চসিকের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোবরক আলী আজাদীকে বলেন, বিভিন্ন খালের মুখে যে ৪০টি স্লুইচ গেইট নির্মাণ করার কথা সেগুলো পাম্প হাউজসহ চালু করতে হবে। নিয়মিত খালের মাটি উত্তোলন করতে হবে। এ দুটি কাজ বাস্তবায়ন না করা পর্যন্ত জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি মিলবে না। তিনি বলেন, ছোট ছোট যে ড্রেনের অজুহাত দেয়া হয় সেগুলো সিটি কর্পোরেশন পরিষ্কার করছে।
পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ শহিদুল আলম, বর্তমানে যে খাল আছে সেগুলো প্রতিনিয়ত পরিষ্কার করতে হবে। শহরের পাহাড়গুলো বালিমিশ্রিত। অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটায় অল্প বৃষ্টি হলে বালি এসে ভরে যায় খাল। তাই সবসময় সর্তক থাকতে হবে। গত কয়েক বছরে তো চাক্তাই খাল পারিপূর্ণভাবে খননও করা হয়নি। ফুলতলায় ১৯৮৮ সালে একটি রির্জাভার করা হয়, সেটাও পরিষ্কার হচ্ছে না ঠিকভাবে। পানির প্রাকৃতিক যে স্লোব আছে সেগুলোকে বাধাগ্রস্ত করা যাবে না।
চসিকের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোবরক আলী আজাদীকে বলেন, বিভিন্ন খালের মুখে যে ৪০টি স্লুইচ গেইট নির্মাণ করার কথা সেগুলো পাম্প হাউজসহ চালু করতে হবে। নিয়মিত খালের মাটি উত্তোলন করতে হবে। এ দুটি কাজ বাস্তবায়ন না করা পর্যন্ত জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি মিলবে না। তিনি বলেন, ছোট ছোট যে ড্রেনের অজুহাত দেয়া হয় সেগুলো সিটি কর্পোরেশন পরিষ্কার করছে।