বাংলাদেশের জাতীয় কবি, যিনি দ্রোহ ও সাম্যের কবি হিসেবেও পরিচিত, কাজী নজরুল ইসলামের অনবদ্য সৃষ্টি ‘অগ্নিবীণা’। এটি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ১৯২২ সালে কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে মোট বারোটি কবিতা আছে। কবিতাগুলো হচ্ছে : শাতইল আরব, খেয়াপারের তরণী, কোরবাণী, মোহররম, আগমনী, রণ–ভেরী, কামাল পাশা, আনোয়ার, বিদ্রোহী, প্রলয়োল্লাস, ধূমকেতু ও রক্তাম্বরধারিণী মা। এছাড়া গ্রন্থটির প্রথমে বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে উৎসর্গ করে লেখা একটি উৎসর্গ কবিতাও আছে। ‘অগ্নিবীণা’ প্রচ্ছদপটের পরিকল্পনা ছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এবং এঁকেছিলেন তরুণ চিত্রশিল্পী বীরেশ্বর সেন। ৭ নং প্রতাপ চ্যাটার্জি লেন থেকে গ্রন্থকার কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। প্রাপ্তিস্থান হিসেবে গ্রন্থে লেখা ছিল : আর্য পাবলিশিং হাউস, কলেজ স্ট্রিট, মার্কেট। ছাপা হয় মেটকাফ প্রেস, ৭৯ নং বলরাম দে স্ট্রিট, কলিকাতা থেকে। গ্রন্থটির উৎসর্গ হচ্ছে– “বাঙলার অগ্নিযুগের আদি পুরোহিত সাগ্নিক বীর শ্রীবারীন্দ্রকুমার ঘোষ শ্রীশ্রীচরণারবিন্দেষু”। নিচে লেখা আছে “তোমার অগ্নি–পূজারী –হে– মহিমাম্বিত শিষ্য–কাজী নজরুল ইসলাম”। অরবিন্দ ঘোষের ভ্রাতা বারীন্দ্রকুমার ঘোষ বিপ্লববাদী আন্দোলনের অন্যতম নায়ক ছিলেন।
‘অগ্নিবীণা’ প্রকাশের শতবর্ষ পেরিয়ে গেছে। সাহিত্যের সাথে সাথে নজরুল রাজনীতি ও সাংবাদিকতার সাথেও প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হন। উদ্দেশ্য ছিল ব্যাপক গণজাগরণ, যে জাগরণের মধ্য দিয়ে উপনিবেশ ও সামন্ত শাসন–শোষণ থেকে মানুষের মুক্তি। এ মুক্তি আকাঙ্ক্ষার পটভূমিতে রচিত হয়েছে নজরুলের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’র কবিতা সমষ্টি। বিষয় ভাবনা ও শিল্পের নৈপুণ্যে এবং স্বাতন্ত্র্যে ও মৌলিকত্বে সর্বশ্রেষ্ঠ। প্রথমবার দুই হাজার ২শ’ কপি ছাপা হয়, তা এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায়। কাজেই বছর না যেতেই এর দ্বিতীয় সংস্করণ বের হয়। এ সংস্করণেও সমপরিমাণ কপি ছাপা হয়। পরবর্তীকালে নজরুল ডি এম লাইব্রেরির কাছে অগ্নিবীণার স্বত্ব বিক্রি করে দেন। ‘অগ্নিবীণা’ প্রকাশের পরপরই ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় প্রথম প্রচ্ছদে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়, ‘ধূমকেতু’ সারথি ‘বিদ্রোহী’র সৈনিক কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার বই ‘অগ্নিবীণা’ বের হলো।
নজরুল ছাত্রজীবনে বিপ্লবের দীক্ষা পান স্কুলে তাঁর শিক্ষক নিবারণচন্দ্র ঘটকের কাছে। ১৯২১ সালে ‘ধূমকেতু’র মাধ্যমে তিনি বিপ্লবী ভাবধারা প্রকাশ করেন।
কবিতাগুলো গ্রন্থভুক্ত করার সময় নজরুল খুব মনোযোগী ও সতর্ক ছিলেন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার কিছু পঙক্তি ও স্তবক বর্জন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব পরিবর্তন, সংশোধন ও বর্জনের পরও আজো আমাদের উজ্জীবিত করে। ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থের কেন্দ্রীয় বিষয় বিদ্রোহ, বিপ্লব এবং এর মাধ্যমে ঔপনিবেশিক দুঃশাসন ও দেশীয় সামন্ত শোষণ থেকে মুক্তির উদগ্রস্বপ্নাকাঙ্ক্ষা। যুদ্ধোত্তরকালে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী নানা কালাকানুন জারি করে।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থের কাবিতাগুলো লেখা হয়। নানা উপমা–রূপকে, চিত্রে–চিত্রকল্পের, মিথ পুরাণ–ঐতিহ্য ও ইতিহাসের প্রসঙ্গে চরিত্রে নজরুল পরাধীনতা শোষণ বঞ্ছনা দুঃশাসনের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠে অথচ শিল্পিত সুরে স্বরে উচ্চারণ করেছেন জনগণ মুক্তির অমিয় বাণী। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটিকে যদি ‘অগ্নিবীণা’র মূল ভাবের কবিতা বলি, তাহলে কবিতাগুলো ‘বিদ্রোহী’ কবিতার সম্পূরক ভাবের কবিতা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এখনো বিশ্ব দুইভাগে বিভক্ত। শোষিত ও শাসক। মুক্তিকামী মানুষের লড়াই চলছে। এখনো বিশ্বে উৎপীড়িতের ক্রন্দন ধ্বনি শোনা যায়। এ কাব্যগ্রন্থেই তো কবি নজরুল অঙ্গীকার করেছেন দৃঢ় কণ্ঠে, ‘আমি সেই দিন হব শান্ত/ যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না/ অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ–ভূমে রনিবে না।’ (বিদ্রোহী)। শতবর্ষ পেরিয়ে ‘অগ্নিবীণা’ এখনো প্রাসঙ্গিক। একইসাথে কালোত্তীর্ণ। নজরুলের এই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতার মর্মবাণী আমাদের অনুপ্রেরণা ও সাহস যোগায়। তাঁর রচনা কাল ছাপিয়ে গেছে। যুগ যুগ ধরে তাঁর রচনার মধ্যে জাগরুক থাকবেন।