ভারী বর্ষণে প্রতিরাতেই কাটা হচ্ছে পাহাড়

এই অপতৎপরতায় জড়িত চিহ্নিত ভূমিদস্যুরা মাটি রাস্তায় গড়িয়ে ভরাট হচ্ছে নালা ও খাল

হাসান আকবর | বুধবার , ৯ আগস্ট, ২০২৩ at ৫:২২ পূর্বাহ্ণ

ভারী বর্ষণের সুযোগে নগরীতে পাহাড় সাবাড়ের কার্যক্রম বেড়েছে। বৃষ্টির সময় প্রতিরাতেই কাটা হচ্ছে পাহাড়। কৌশলে এক একটি পাহাড় সাবাড় করার কার্যক্রম চলছে। নগরীর জিইসি মোড়, ফৌজদারহাটবায়েজিদ লিংক রোড, জালালাবাদসহ, আরেফিন নগর, রউফাবাদ, শেরশাহসহ বিভিন্ন এলাকায় কৌশলী কার্যক্রমে পাহাড় সাবাড় হচ্ছে। সুকৌশলে কাটা এসব পাহাড়ের মাটি রাস্তায় গড়িয়ে নালা খালসহ পানি নিষ্কাশনের পথ পুরোপুরি বন্ধ করে দিচ্ছে। নগরীর জলাবদ্ধতা উস্কে দেয়ার ক্ষেত্রে কৌশলী পাহাড় কাটা মারাত্মক রকমের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলেও বিশেষজ্ঞ সূত্রগুলো জানিয়েছে।

সূত্র জানায়, নগরীর প্রায় সব পাহাড়ই কেটে ফেলা হয়েছে। যে দুয়েকটি পাহাড় আছে সেগুলোও নানা কৌশলে সাবাড় করে দেয়ার তোড়জোড় চলছে। বর্ষার ভরা মৌসুমের ভারী বর্ষণকে পুঁজি করে প্রভাবশালী চক্র সুকৌশলে একটির পর একটি পাহাড় সাবাড় করছে। প্রতি রাতেই নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় কাটার কার্যক্রম চলছে গত কয়েকদিন ধরে। একেবারে স্বল্প খরচে কৌশলে এসব পাহাড় নিশ্চিহ্ন করার অপতৎপরতার সাথে চিহ্নিত ভূমিদস্যুদের অনেকেই জড়িত। পুলিশ এবং স্থানীয় মাস্তানদের ম্যানেজ করে পাহাড় কাটা চলছে। সিডিএ এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের যথাযথ নজরদারির অভাব পরিস্থিতি ভয়াবহ করে তুলছে বলে মন্তব্য করে একাধিক বিশেষজ্ঞ সূত্র বলেছে, কৌশলী এই পাহাড় কাটার দরুন শুধু পাহাড়ই নিশ্চিহ্ন হচ্ছে না, একই সাথে শহরের জলাবদ্ধতাকেও ভয়ংকর করে তুলছে। তুমুল বর্ষণের সময় পাহাড় থেকে ধসে পড়া মাটি ও বালি বৃষ্টির পানির সাথে নিকটস্থ সড়ক ও নালায় গিয়ে পড়ছে। দিনশেষে যা পানি নিষ্কাশনের পথই পুরোপুরি রুদ্ধ করে দিচ্ছে।

নগরীর জিইসি মোড় সংলগ্ন গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের অফিসের সামনের পাহাড়টিই বিলীন হওয়ার পথে। সবার চোখের সামনে তিল তিল করে এই পাহাড়টি সাবাড় করে ফেলা হচ্ছে। প্রতিদিনই বৃষ্টির সময় এই পাহাড় থেকে বানের পানির মতো বালি নামে সড়কে, রাস্তায়। গাড়ির চাকার সাথে তা জাকির হোসেন রোডসহ সন্নিহিত এলাকার পুরো রাস্তায় কয়েক ইঞ্চি পুরু আস্তরের সৃষ্টি হয়। এসব বালি ও মাটি এলাকার সব নালা ভরাট করে ফেলেছে। বৃষ্টির পানির সাথে গড়িয়ে যা ক্রমে নিকটস্থ অন্যান্য নালা ও খালের বারোটা বাজাচ্ছে।

গত কয়েক বছর ধরে পাহাড়টি সাবাড় করা হচ্ছে। বর্ষা শুরু হলেই এই পাহাড়টি সাবাড়ের কৌশলী কার্যক্রম শুরু হয়। যার ধকল সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সকলকে। এবারের তুমুল বর্ষায়ও যথারীতি জাকির হোসেন রোডের বিসতৃত এলাকা কয়েক ইঞ্চি পুরো মাটিতে ঢাকা পড়ে। এলাকার সব নালা নর্দমা একাকার হয়ে যায় পাহাড়ের বালিতে।

এলাকাবাসী জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে পাহাড়টির একটি বড় অংশ সাবাড় করে দেয়া হয়েছে। চলমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আগামী কিছুদিনের মধ্যেই পাহাড়টি পুরোপুরি বিলীন করে দেয়া হবে। সরজমিনে পরিদর্শনে দেখা গেছে, সুউচ্চ ঘেরা দিয়ে রাখা পাহাড়টির পাদদেশে বিভিন্ন ধরনের গাড়ি ও ইকুইপমেন্ট রাখা হয়েছে। এলাকাটিতে যে কোনো ধরনের লোক প্রবেশ এবং চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। ঘেরার ভিতরে প্রতিদিনই পাহাড়টির গোড়ায় একটু একটু করে মাটি কাটা হয়। বৃষ্টির সময় পাহাড়ের গোড়ার দিকে কৌশলে কেটে দেয়া হয়। তুমুল বৃষ্টিতে পাহাড়ের বিশাল অংশ উপর থেকে ধ্বসে পড়ে। আর বৃষ্টিতে ধুয়ে আসা পাহাড়ি বালিতে পুরো এলাকাটি ঢেকে যায়। বর্ষার সময় দুচারদিন পর পরই স্থানীয় নালা ও রাস্তাঘাট সবই এই পাহাড়ের বালিতে একাকার হয়ে যায়। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা নালা থেকে বালি তুলে নেয়ার দিন কয়েকের মধ্যে আবারো বালি নেমে আসে। আবারো ভরাট হয়ে যায় সবকিছু। গত তিন চার বছর ধরে এই পাহাড়টি সাবাড়ের কার্যক্রম চলছে। এই পাহাড়ের মাটি জিইসি মোড়সহ সন্নিহিত অঞ্চলের জন্য বড় ধরণের ‘কাল’ হয়ে উঠেছে।

নগরীর ফৌজদারহাটবায়েজিদ লিংক রোড, জালালাবাদ, রউফাবাদ, আরেফিন নগর এবং শেরশাহ এলাকায়ও একই স্টাইলে পাহাড় সাবাড় করার দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়েছে। বৃষ্টিকে পুঁজি করে কেটে দেয়া হচ্ছে পাহাড়ের একটি অংশ। পরবর্তীতে বর্ষণের তোড়ে পাহাড় ধসে পড়ছে। ধসে পড়া পাহাড়ের বালি ও মাটি চারদিকের নালা নর্দমা ভরাট করে ফেলছে। এভাবে পাহাড় সাবাড় করার কারণে গত সোমবার রাত এবং গতকাল সকালে ফৌজদারবায়েজিদ লিংক রোডে একাধিক ধসের ঘটনা ঘটেছে।

একটির পর একটি পাহাড় সাবাড়ের ঘটনার জের ধরে নগরীর জলাবদ্ধতা প্রকট হচ্ছে বলে উল্লেখ করে একজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, নালা এবং খালই শুধু নয়, ক্রমে এই মাটি ও বালি গিয়ে পড়ছে কর্ণফুলী নদীতে। নদীও ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এই অপতৎপরতা কঠোরভাবে দমন করা না গেলে কর্ণফুলী নদীও মরে যাবে। নগরীর খালগুলোর মতো নদীও যদি মরে তাহলে চট্টগ্রামকে অনেক বেশি মূল্য দিতে হবে।

নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি আশিক ইমরান গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, জলাবদ্ধতার ভয়াভয়তা থেকে নিস্তার পেতে আমাদেরকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু সিটি কর্পোরেশন বা সিডিএ নয়, এই সমন্বয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর, পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্যা সংস্থাগুলোকেও যুক্ত করতে হবে। সবার সমন্বয় ছাড়া চট্টগ্রামকে ভয়ংকর এই বিপদ থেকে উদ্ধার করা কঠিন হবে বলেও স্থপতি আশিক ইমরান মন্তব্য করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধওমর হাজ্জাজ চিটাগাং চেম্বারের নতুন সভাপতি
পরবর্তী নিবন্ধমেয়র ও সিডিএ চেয়ারম্যানের পদত্যাগ করা উচিত