অভিবাসন শব্দটি অর্থনীতির সাথে সম্পর্কিত। এক দেশের নাগরিক যখন স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য অন্য দেশে পাড়ি জমায় তখন তাকে অভিবাসন বলে। আবার অভিবাসন ও স্থানান্তরের মধ্যে পার্থক্য আছে। স্থানান্তর হচ্ছে, একই দেশের অভ্যন্তরে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে বসবাসের উদ্দেশ্যে গমন করা। মানুষের আবাস স্থান কতগুলো সুবিধার ওপর নির্ভর করে। প্রাচীনকালে দেখা যেত, যেখানে বা যে অঞ্চলে পর্যাপ্ত খাদ্যের জোগান ছিল সেখানে মানুষ বসবাস করত। বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে মানুষ শুধু খাদ্যের ওপর ভরসা করে আবাসস্থল গড়ে তোলে না। কারণ প্রকৃতি থেকে জোগানকৃত খাদ্যের তুলনায় মানুষ নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে সেবা কর্মের ওপর। তাই যে অঞ্চলে খাদ্যের জোগান পর্যাপ্ত মানুষ শুধুমাত্র সে অঞ্চলে বসবাস করে না। বিশেষ করে যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত থাকলে মানুষ দূরবর্তী অঞ্চলেও আবাসস্থল গড়ে তোলে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ বিশ্বের উন্নত দেশগুলো। উন্নত দেশগুলোতে কর্মস্থল থেকে ১০০ কিলোমিটারের অধিক দূরত্বেও মানুষ আবাসস্থল গড়ে তোলে। সেই আবাসস্থল থেকে প্রতিদিন গাড়ি ড্রাইভ করে ১০০ মাইলের অধিক দূরত্বে অবস্থিত কর্মস্থলে চলে যায়। অতএব বলা যায়, আবাসন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর। আবাসন ব্যবস্থার সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থার সম্পর্ক হচ্ছে ধণাত্বক। অর্থাৎ উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা বৃদ্ধি পেলে আবাসন ব্যবস্থাও বৃদ্ধি পায়। এটা হচ্ছে অভ্যন্তরীণ স্থানান্তরের একটি তত্ত্ব।
কিন্তু আন্তর্জাতিক অভিবাসন একটি ভিন্ন প্রক্রিয়া। কারণ একদেশ থেকে মানুষ সহজে অন্যদেশে গিয়ে বসবাস করতে পারে না। প্রত্যেক দেশের নিজস্ব আবাসন নীতি যেমন আছে তেমনি আছে অভিবাসন নীতিও। অনেকগুলো প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে একদেশ থেকে অন্যদেশে গিয়ে মানুষ বসবাস করতে পারে। প্রতিটি দেশের আবাসন নীতি নিজ নিজ দেশের শাসনকর্তা দ্বারা পরিচালিত হয়। যেমন বিশ্বের অনেক দেশ আছে, যে সব দেশে প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে প্রচুর। এসব প্রাকৃতিক সম্পদকে জনবলের অভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। আবার কোনো কোনো দেশে ছোটখাট কাজগুলো করার জন্য মানুষের অভাব। এ কারণে অন্য দেশ থেকে মানুষ এনে তাঁরা ছোটখাট কাজ (যেমন– রাস্তা পরিষ্কারের কাজ, বাগান করা, কৃষিকাজ করা, গৃহকর্মের কাজ করা ইত্যাদি) সম্পাদন করে। কোনো কোনো সময় দেশগুলো, আগত লোকদের স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ দিয়ে থাকে। ফলে অন্যদেশ থেকে আগত লোকেরা যখন কর্মস্থল দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করে তখন তারা হয়ে যায় অভিবাসী। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বৃটিশেরা যখন সমগ্র ভারত শাসন করতো তখন বাংলাদেশ তথা পূর্বাঞ্চলে চা বাগানের কাজ করার জন্য উরিষ্যা, বিহার, হরিয়ানা ইত্যাদি অঞ্চল থেকে দরিদ্র ব্যক্তিদের বা দরিদ্র পরিবারগুলোকে এ অঞ্চলে নিয়ে আসে। চা বাগানের ভেতর তাদেরকে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। শতাধিক বৎসর এসব শ্রমিকেরা চা বাগানের কাজ করতে করতে এ অঞ্চলে তাঁরা স্থায়ী হয়ে যায়। একসময়ের অভিবাসনকারী ব্যক্তিরা পরবর্তীতে হয়ে গেছে সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিক। দক্ষিণ আফ্রিকায় একসময়ে প্রচুর আখ চাষ হতো। কিন্তু আখ চাষ করার জন্য পর্যাপ্ত জনবল দক্ষিণ আফ্রিকায় ছিল না। আখ চাষের সুবিধার্থে ভারতের গুজরাট, হরিয়ানা ইত্যাদি অঞ্চল থেকে বহু লোককে দক্ষিণ আফ্রিকায় নিয়ে যাওয়া হয়। এদেরকে অভিবাসনকারী শ্রমিক বলা হয়। সময়ের পরিক্রমায় এসব শ্রমিকেরা সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। একসময়ের অভিবাসনকারী শ্রমিকেরা হয়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকার নাগরিক। আজ থেকে মাত্র পনের বিশ বছর পূর্বে আমেরিকা ‘ডিভি’ নামক এক নতুন অভিবাসন নীতি চালু করে। এশিয়ার কিছু কিছু দেশ থেকে তারা লটারী করে ডিভি এর মাধ্যমে অসংখ্য লোক নিয়ে আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে কাজের সুযোগ করে দেয়। এটা ছিল ঐ সময়ের আমেরিকার অভিবাসন নীতি।
অভিবাসন আবার দুই প্রকার। যেমন বৈধ অভিবাসন ও অবৈধ অভিবাসন। সাধারণত দরিদ্র শ্রেণির লোকেরা উন্নত জীবনযাত্রা মানের আশায় অবৈধভাবে যে কোনো উপায়ে অপরদেশে পাড়ি জমায়। উক্ত দেশের সরকার যদি প্রাথমিকভাবে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখায় তবে এ সব অবৈধ নাগরিক দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করার কারণে তারা নাগরিকত্ব পেয়ে যায়। পরবর্তীতে সরকার তথা প্রশাসন যদি কঠোর হয় তবে এসব নাগরিকদের অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। যেমন চলতি জুন’২৩ মাসে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক নিজেই অবৈধ অভিবাসনকারীদের ধরার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষদের সাথে নিয়ে বের হন। তিনি প্রায় শতাধিক অবৈধ অভিবাসন ব্যক্তিদের ধরে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দেশে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। অথচ তিনিও তাঁর পূর্বপুরুষেরা ছিল ব্রিটেনে এক সময়ে এ রকম অভিবাসী। মালেশিয়াতেও এ রকম অভিযান পরিচালনা করে অবৈধ অভিবাসীদের ধরা হয়। তবে দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, এরূপ অবৈধ অভিবাসীদের মধ্যে অধিকাংশ হয় বাংলাদেশী।
আমি অর্থনীতি বিষয়ের অনার্স ও মাস্টার্স শ্রেণির জন্য তেরটি পাঠ্যগ্রন্থ রচনা করেছি। তার মধ্যে দুইটি হচ্ছে দুই শ্রেণির ‘জনসংখ্যা অর্থনীতি’। এ পাঠ্যবই দুইটিতে দুইটি অধ্যায় আছে অভিবাসন নিয়ে। এ বিষয়গুলো সেখানে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। সেখানে একটি বিষয় পাঠ্যসূচিতে ছিল না। তা হলো– ধনীদের অভিবাসন বা দেশত্যাগ। ধনীরা কখনো অবৈধভাবে দেশত্যাগ বা অভিবাসী হয় না। বিশ্বে অধিকাংশ ধনী দেশ হয় পুঁজিবাদী। তারা সবসময় পুঁজির পরিমাণ বৃদ্ধি করতে চায়। তাছাড়া শিল্প ও বাণিজ্যে এগিয়ে থাকার জন্য তারা বিশ্বের ধনী ব্যক্তিদের বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে আকৃষ্ট করে। যেমন– মালেশিয়া, সৌদিআরব, অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা ইত্যাদি দেশ। এ দেশগুলো অভিবাসীদেরকে স্থায়ী নাগরিকত্বও দিয়ে থাকে। ফলে বিশ্বের ধনী ব্যক্তিরা নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে চলে যায়। ২০২৩ সালের প্রথমদিকে ‘হেনলি প্রাইভেট ওয়েলথ মাইগ্রেশন’ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। উক্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়– অধিক সম্পদের মালিকেরা ক্রমাগত নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে অভিবাসী হয়ে যাচ্ছে। এসব অভিবাসীরা মিলিয়ন, মিলিয়ন ডলারের মালিক। হেনলি প্রাইভেট ওয়েলথ মাইগ্রেশন রিপোর্ট অনুসারে ২০২২ সালে চীন থেকে দেশ ছেড়েছে ১০,৮০০ জন চীনা নাগরিক। ভারত থেকে দেশ ছেড়েছে ৭,৫০০ জন। যুক্তরাজ্য ছেড়েছে ১,৬০০ জন, রাশিয়া ছেড়েছে ৮,৫০০ জন। ব্রাজিল ছেড়েছে ১৮০০ জন। এসব মিলিয়নিয়ারদের গন্তব্য স্থান হচ্ছে বিশ্বের দশটি দেশ। এ দশটি দেশ হচ্ছে অষ্ট্রেলিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড, কানাডা, গ্রিস, ফ্রান্স, পুর্তগাল ও নিউজিল্যান্ড। উক্ত তথ্যে আরো দেখা যায়, ২০২২ সালে অষ্ট্রেলিয়ায় অভিবাসী হয়েছে ৩৮০০ মিলিয়নিয়ার। সংযুক্ত আরব আমিরাতে হয়েছে ৫,২০০ জন। বিশ্বের অভিবাসী তথা অভিবাসন প্রক্রিয়ায় শুধু এ দুই দেশ নয়। আরো বেশ কিছু দেশকে ধনী ব্যক্তিরা বা মিলিয়নিয়ারেরা বেছে নিয়েছে বসবাসের জন্য। তার মধ্যে তৃতীয় স্থানে আছে সিঙ্গাপুর। সেখানে ২০২২ সালে অভিবাসী হয়েছে ২,৯০০ জন মিলিয়নিয়ার। চতুর্থ স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্র। এ দেশে ২০২২ সালে ১৫০০ জন মিলিয়নিয়ার বা ধনী ব্যক্তি বসবাসের জন্য স্থানান্তর হয়েছে অভিবাসী হিসেবে। ধনী ব্যক্তিদের এর পরের পছন্দের দেশগুলো হয় যথাক্রমে সুইজারল্যান্ড, কানাডা, গ্রিস, ফ্রান্স, পুর্তগাল ও নিউজিল্যান্ড। ২০২৩ সালের মাত্র পাঁচ মাসে এরূপ অভিবাসীর সংখ্যা আরো অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। হেনলি ব্যক্তিগত সম্পদ অভিবাসন প্রতিবেদন ২০২৩–এ দেখা যায়, এ কয়েক মাসে শুধু অষ্ট্রেলিয়ায় অভিবাসী হয়েছে প্রায় ৩০০০ ধনী ব্যক্তি। এ প্রতিবেদনে ২০২৩ সালের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে– এসব দেশে ২০২২ সালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ ধনী বা মিলিয়নিয়ারেরা অভিবাসনের সুযোগ গ্রহণ করবে। যেসব মিলিয়নিয়ারেরা নিজ দেশ ত্যাগ করে অভিবাসনের সুযোগ গ্রহণ করছে তার মধ্যে শীর্ষে আছে চীন। ২০২২ সালে চীন থেকে ১০,৮০০ জন ধনী নিজ দেশ ত্যাগ করে অভিবাসনের সুযোগ গ্রহণ করেছে। এরপরে আছে ভারত, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ব্রাজিল, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, মেক্সিকো, দক্ষিণ আফ্রিকা ও জাপান। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, আমেরিকা থেকে চলে যাওয়া ধনীর সংখ্যা খুবই কম। একেবারে নেই বললেই চলে। এখানে মিলিয়নিয়ার বা ধনী ব্যক্তি বলতে বোঝানো হয়েছে যে, যাদের বিনিয়োগযোগ্য সম্পদ ১ মিলিয়ন বা ১০ লাখ মার্কিন ডলার বা তার বেশি। সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৩ সালে অষ্ট্রেলিয়া সবচেয়ে বেশি ধনী ব্যক্তিকে আকর্ষণ করবে। অর্থাৎ চলতি বছর বিশ্বে স্থানান্তর হওয়া ধনী ব্যক্তি ও পরিবারগুলোর বেশির ভাগ যাবে অষ্ট্রেলিয়ায়। এরপরে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের অবস্থান। এদেশে বর্তমানে প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার ৯০০ জন মিলিয়নিয়ার বাস করছেন। যাঁদের এক একজনের সম্পদের পরিমাণ ১০ লাখ মার্কিন ডলারের বেশি। এ ছাড়া ১০ মিলিয়ন বা ১ কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগযোগ্য সম্পদ আছে এমন ২৯৮ জন সেন্টি–মিলিয়নিয়ার ও ২০ জন বিলিয়নিয়ার বা শত কোটিপতি রয়েছেন। সংযুক্ত আরব আমিরাত দেশটি ধনীদের জন্য কেবল নিরাপদ আশ্রয় নয়, বরং সম্পদ সংরক্ষণের জন্যও একটি ভালো জায়গা বলে মনে করা হয়। ভারত ও বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য ধনীরা প্রতিবছর আরব আমিরাতে পাড়ি জমাচ্ছেন। তবে বিপরীত কথা হচ্ছে যে, ধনীরা অন্য দেশে অভিবাসন বা চলে যাওয়ার কারণে নিজ দেশের অর্থনীতি হয়ে যাচ্ছে দুর্বল। বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে ধনীদের অর্থ পাচারের কারণে এ দেশের অর্থনীতি হয়ে যাচ্ছে রুগ্ন। এ প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে।
লেখক : প্রফেসর, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, ইউএসটিসি