কে যেন হঠাৎ পেছন থেকে হাতরুমাল দিয়ে রিয়াদের নাক–মুখ চেপে ধরল। কিছু বোঝার আগেই টান দিয়ে দ্রুত একটা কালো মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিল।
রিয়াদ ছোট্ট মানুষ। বয়স সাত কিংবা আট হবে। হালকা–পাতলা গড়নের। গায়ে তেমন শক্তিও নেই। তবুও দুই হাত দিয়ে শক্ত হাতটা মুখ থেকে সরানোর অনেক চেষ্টা করল সে; কিন্তু পারল না। কিছু সময় হাত–পা দাপিয়ে গোঙাতে গোঙাতে নেতিয়ে পড়ল। কিছুই করার ছিল না তার। শক্তিহীন নিস্তেজ শরীরটা আগন্তুক মানুষটার কোলে মরা মানুষের মতো পড়ে রইল।
কয়েক ঘণ্টা পর রিয়াদের জ্ঞান ফিরল। চোখ খুলতেই দেখতে পেল ফ্যান ঘুরছে উপরে। মেঝের মাঝবরাবর পড়ে আছে সে। চার দেয়ালের ছোট্ট একটা রুম। একটাই কাঠের দরজা। আশপাশে কতগুলো পুরনো আসবাবপত্র। মাকড়শা বাসা বেঁধেছে ঘরের কোণায় কোণায়। দেখেই মনে হচ্ছে, এটা কারো থাকার ঘর নয়। কখনো কখনো হয়তো কেউ ব্যবহার করে। লাইটগুলো বন্ধ। তবে, অন্ধকার ছিল না। সবকিছু দেখা যাচ্ছিল স্পষ্ট। চাঁদের জোছনাটুকু খোলা জানালার গ্রিল ভেদ করে নির্দ্বিধায় ঢুকছিল রুমে।
উঠে বসল সে। চারদিকে চোখ ঘুরাতেই তার বয়সী আরো কয়েকজনকে দেখে বুঝতে পারল; তাদের তুলে আনা হয়েছে। কেউ চুপচাপ বসে আছে, কেউবা ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আর কেউ শুধু তার দিকে তাকিয়ে আছে। চেহারায় এক ধরনের অসহায়ত্ব। রিয়াদ বুঝতে পারে, তারা মানুষ পাচারকারী চক্রের হাতে পড়েছে। এই ভেবে ভয় পেয়ে বসে তার তনু–মন। শুনেছে, তারা নাকি জবাই করে কিডনি বিক্রি করে দেয়। কেউ কেউ নাকি আবার বিদেশেও মানুষ পাচার করে দেয়। মা বারবার বলত, রাতে বাইরে যাসনে খোকা। বাচ্চা ধরা তুইলা নিয়ে যাইবে, সাবধান! সাবধান! ভুলেও যাসনে খোকা।
দরজাটা বন্ধ। বাইরে দরজার পাশে থাকা কারো অস্পষ্ট সুরেলা আওয়াজ আসছিল। কেউ হয়তো পাহারা দিচ্ছে আর গুনগুন করে গান গাইছে। রাত এখন কয়টা বাজে কে জানে। সবকিছুই যেন ভিন্ন ভিন্ন লাগছে। রিয়াদ মনটাকে শক্ত করে। উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। দেখার চেষ্টা করে বাইরের পরিবেশ। উপর থেকে সরাসরি নিচে তেমন কিছু দেখা যায় না। হয়তো তারা বহুতলাবিশিষ্ট কোনো ভবনে আছে। আশপাশে আরো কয়েকটি ভবন। কোনোটার আবার কাজ চলছে। আর কিছু অফিস দেখা যাচ্ছে। তবে বোঝা যচ্ছিল, সুনসান নীরবতাঘেরা এক মহারাত্রি। কাউকে আওয়াজ দিয়েও লাভ হবে না। পুরো পৃথিবী যে এখন ঘুমন্ত। তাছাড়া আওয়াজ নিচে পৌঁছবে না। রিয়াদ মেঝেতে বসে পড়ে। সকলের মতো নীরব হয়ে থাকে। কাঁদতে মন চাচ্ছে তার। কিন্তু চোখের কোণায় কেন জানি পানি আসছে না।
সকাল হলো। কেউ একজন এসে দরজা খুলে খাবার দিয়ে গেল। রুটি–কলা আর পানি। লোকটা মাস্ক পরা। কর্কশ ভাষায় বলে উঠল, ‘দ্রুত খেয়ে নাও সবাই। কোনো সাউন্ড করবে না’।
একটা ছেলে দৌড় দিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করলে লোকটা তাকে ধরে দূরে ছুড়ে মারল। সে কান্না করতে শুরু করল উচ্চৈঃস্বরে। লোকটা কাছে গিয়ে মুখে আঙুল চেপে ধরে বলল, ‘একদম চুপ। কোনো আওয়াজ করবি না। আওয়াজ করলে সোজা ছাদ থেকে ফেলে দিব নিচে। বুঝলি?’
আরেকটা ছেলে বলল, ‘আমাদের ধরে আনছেন কেন? আমরা আপনাদের কী ক্ষতি করছি? দয়া করে আমাদের ছেড়ে দিন। প্লিজ, প্লিজ।’
লোকটা এবার উঠে গিয়ে কোনো কথা না বলে ঠাস করে তার গালে একটা চড় মেরে বসল। হুংকার দিয়ে বলল, ‘কোনো কথা হবে না আর। বাঁচতে চাইলে একদম চুপ থাকবি। না হলে একটা একটা করে ধরে ছাদ থেকে ফেলে দিব।’
এই বলে দরজা লাগিয়ে চলে যায় সে। ওরা আর কিছু না বলে চুপচাপ কলা–রুটি খেতে শুরু করে।
কিছুক্ষণ পর দুজন এসে সবাইকে ছাদে নিয়ে যায়। ছাদ তাদের মাথার উপরেই ছিল। এক এক করে সবাইকে ন্যাড়া করে দিতে থাকে। ন্যাড়া কেন করাচ্ছে সেটা কারো বুঝে আসছিল না। রিয়াদের সিরিয়াল সবার শেষে। সে এদিক–ওদিক তাকিয়ে ছাদ দেখছিল। পালিয়ে যাওয়ার পথ খু্ঁজছিল। তবে তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালানো প্রায় অসম্ভব। নিচে তাদের লোক আছে নিশ্চিত। গেলেই ধরে ফেলবে মে বি। ছাদ থেকে লাফ দেওয়াও সম্ভব নয়। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। তার চোখ পড়ে ওয়াশরুমের পাইপের দিকে। যা সোজা নিচের দিকে নেমে গেছে। সেটা বেয়ে বেয়ে নিচে নামতে হবে। খুব রিস্কি। পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও আছে। কিন্তু জীবন বাঁচাতে চাইলে রিস্ক তো নিতেই হবে। তবে এখন পাইপ দিয়ে নামতে গেলে নিচে গিয়ে ধরে ফেলবে ওরা। এসব ভাবতে ভাবতে সিরিয়াল আসে তার। ন্যাড়া করে দেওয়া হয় তাকে। সবাইকে ন্যাড়া করা শেষ হলে আবার ঘরে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখে।
রিয়াদ ভাবতে থাকে, কীভাবে এখান থেকে মুক্ত হওয়া যায়। ফোনও তো নেই সঙ্গে, কাউকে কল করে বলবে এখান থেকে বাঁচাতে। পকেটে শুধু একটা কলম রয়েছ। সেটা দিয়ে কী করবে? কিছু বুঝে আসছে না। রিয়াদ পুরো রুমে পায়চারি করতে থাকে। বাকিরা সবাই নীরব হয়ে বসে। কেউবা মেঝেতে শুয়ে পড়েছে। কারো চোখে আর জল নেই। শুকিয়ে গেছে সব। চিল্লালে কেউ শোনে না নিচ থেকে। ওরা আওয়াজ শুনতে পেলে ঘরে ঢুকে মারে। অমানুষের দল। দয়া–মায়া বলতে কিছু নেই তাদের। এই পরিস্থিতিতে এই ছোট ছোট বাচ্চারা কী করতে পারে? না আছে তেমন বুদ্ধি, না আছে শক্তি।
দেখতে দেখতে দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে গেল। দুপুরে একবার কিছু খাবার দিয়ে গিয়েছিল। তারপর আর খবর নেই। হঠাৎ রিয়াদের চোখ যায় রুমের এক কোণে পড়ে থাকা একটা খাতার উপর। সেটা হাতে নেয়। কতগুলো ফাঁকা পৃষ্ঠা রয়েছে। বাকিগুলো লেখায় ভরা। কিছু হিসাবপাতি আর কি। সে তার পকেট থেকে কলমটা বের করে। বসে পড়ে নিচে। একটা সাদা পেজ থেকে এক টুকরো কাগজ ছিঁড়ে। সবাই তার কাছাকাছি চলে আসে। দেখতে থাকে রিয়াদ কী করে। সকলের চোখ কাগজের টুকরোয়।
রিয়াদ খাতার উপর কাগজটা রেখে লেখে, ‘দয়া করে আমাদের বাঁচান। আমরা শিশু। আমাদের তুলে এনে একদম উপরতলার একঘরে বন্দি করে রেখেছে। প্লিজ, আমাদের কেউ বাঁচান।’
তারপর কাগজটা হাতের মুঠোয় চেপে জানালা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়। যদি কেউ দেখে তাহলে হয়তো সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসবে। কিছুক্ষণ পর আরও কয়েকটা কাগজ নিচে ফেলে দেয় তারা। কিন্তু কোনো সাড়া আসে না। এভাবে ঘণ্টাখানেক চলে যায়। এরপর ওদের থেকে একজন বলে, কয়েকটা কাগজ দিয়ে হবে না। আমাদের বৃষ্টির মতো কাগজ ফেলতে হবে। তাহলে একজন হলেও সেটা দেখবে। যেই কথা সেই কাজ। ওরা পুরো খাতার পাতা টুকরো করে আলাদা করতে থাকে। রিয়াদ সাহায্যের কথা লিখতে থাকে। একসময় সব কাগজ শেষ হয়ে যায়। সবাই হাতের মুঠোয় কাগজের টুকরোগুলো নিয়ে জানালা দিয়ে একসাথে ফেলে দেয়। সেগুলো বৃষ্টির মতো নিচে পড়তে থাকে। সবাই বুক ভরা আশা নিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে।
ঘণ্টাখানেক পর হঠাৎ দরজার সামনে কারো উপস্থিতি টের পায় ওরা। নড়েচড়ে ওঠে। দুয়েকজন উঠে দরজার দিকেও যায়। ততক্ষণে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। কেউ একজন দরজা খুলছে। সবাই মন থেকে চাচ্ছে যেন সাহায্য আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে। পাচারকারীদের কেউ যেন না হয়। দরজা খুলে সামনে দাঁড়ায় এক ব্যক্তি। অন্ধকারে চেহারা পুরোপুরি না দেখা গেলেও মধ্যবয়স্ক কোনো ব্যক্তি মনে হয়। আওয়াজ ছোট করে বলেন, ‘দ্রুত পালাও। দাঁড়িয়ে দেখছো কী? নয়তো ওরা এসে পড়বে।’
এমন কথা শুনে সবাই বের হয়ে পালায়। কেউ ছোটে সিঁড়ি বেয়ে নিচে, কেউ ছোটে ছাদের দিকে; যদি নিচে কেউ ধরে ফেলে আবার সেই ভয়ে। তার মধ্যে ছিল রিয়াদও। ছাদে গিয়ে তারা ওয়াশরুমের পাইপ বেয়ে বেয়ে নিরাপদে নিচে নামে। পেছনের দিক হওয়ায় কেউ দেখতে পায়নি। দোকান থেকে কল করে বাড়িও ফেরে নিরাপদে।
বাড়ি যাওয়ার পর রিয়াদের মনে কিছু প্রশ্ন ঘোরে। বাকি যারা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমেছিল তাদের কী হয়েছিল? তারা কি বাড়িতে ফিরেছিল নাকি ধরা পড়েছে? লোকটি আসলে কে ছিলেন? তিনি কি আমাদের ফেলা কাগজের টুকরো পেয়ে উপরে এসেছিলেন? নাকি উনি পাচারকারীদের একজন ছিলেন?
সব কনফিউশন ফেলে সে ভাবে, আল্লাহর রহমতে কাগজের বৃষ্টির কারণেই তারা বাড়ি ফিরেছে।