শক্তিশালী কুয়েতকে নির্ধারিত সময়ে গোলশূন্য রেখে আশা জাগিয়েও বঙ্গবন্ধু সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে অতিরিক্ত সময়ের গোলে হেরে গেছে বাংলাদেশ।
২০০৯ সালের পর সাফের সেমি-ফাইনালে উঠেছিল বাংলাদেশ। হ্যাভিয়ের কাবরেরার দলের সামনে হাতছানি ছিল ২০০৫ সালের পর প্রথম ফাইনালে ওঠার কিন্তু দুর্দান্ত লড়াই করেও পারলেন না জামাল-জিকোরা। অতিথি দল হিসেবে সাফে প্রথম খেলতে এসেই ফাইনালের মঞ্চে উঠল কুয়েত।
হারলেও নতুন এক বাংলাদেশকে দেখল সবাই। এই বাংলাদেশ লড়তে জানে। পিছিয়ে পড়েও খেলতে জানে আগ্রাসী ফুটবল। ভারতের বেঙ্গালোরের শ্রী কান্তিরাভা স্টেডিয়ামে ম্যাচের ১০৭ মিনিটে আল ব্লাউসির গোলে স্বপ্ন ভঙ্গ হলো বাংলাদেশের। বাংলাদেশকে ম্যাচে লড়াইয়ে রাখার কৃতিত্বটা দিতে হবে দলের গোলরক্ষক আনিসুর রহমান জিকোকে। পুরোটা সময় গোলবারের নিচে দৃঢ়তার সঙ্গে টিকে ছিলেন তিনি। তবে ১০৭ মিনিটে কুয়েতের গোলে কিছুই করার ছিল না জিকোর। আল ব্লাউসি বক্সে ঢুকে নিঁখুত শটে গোল করে জিকোর প্রতিরোধ ভাঙতে পেরেছেন।
একটু পর তিন পরিবর্তন আনেন কাবরেরা। ইসা, সোহেল রানা ও ফাহিমের বদলি হিসেবে রহমত, সুমন রেজা ও রবিউল হাসানকে নামান। ১১২তম মিনিটে রহমতের দূরপাল্লার শট কুয়েত গোলরক্ষক দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় গ্লাভসে জমান। এর আগে ৯৯ মিনিটে কুয়েত গোলের সুযোগ তৈরি করলেও দুই দফা আল রশিদির শট অতিমানবীয়ভাবে ফিরিয়ে দেন জিকো।
অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয়ার্ধে গোল শোধ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে বাংলাদেশ। কুয়েতের চেষ্টা ছিল খেলার গতি কমিয়ে দেয়ার। ১১৭তম মিনিটে বিশ্বনাথের লং পাস ধরে রাকিব একটু দূরূহ কোণে চলে গেলেও জোরাল শট নেন, গোলরক্ষক পা দিয়ে কোনোমতে আটকান। এ অর্ধের যোগ করা সময়ে সুমনের শট এক ডিফেন্ডারের পায়ে লেগে কর্নার হয়। রবিউলের কর্নার ক্লিয়ার হলে থ্রো ইন পায় বাংলাদেশ। কিন্তু তাও ক্লিয়ার হয়।
একটু পরই বিশ্বনাথের দূরপাল্লার শট কোনোমতে আটকান গোলরক্ষক মারজুক। এরপর শেষের বাঁশি বাজতেই দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা ছড়ায়। হাতাহাতি, ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। তবে অন্যরা পরিস্থিতি সামাল দেন দ্রুতই। নিরাপত্তা রক্ষীদের সাথে মাঠ ছাড়তে হয়ে রেফারিদের।
এর আগে ম্যাচের মাত্র দ্বিতীয় মিনিটেই হ্যাভিয়ের ক্যাবরেরার দল এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু আগের দুই ম্যাচে গোল পাওয়া তরুণ ফরোয়ার্ড শেখ মোরসালিন সেই সুযোগ হাতছাড়া করেছেন। মাঠের ডানপ্রান্ত ধরে সতীর্থের কাছ থেকে পাওয়া বল কুয়েত গোলরক্ষকের হাতে তুলে দেন তিনি।
পরবর্তীতে আবারও ফিরতি বল পান এই স্ট্রাইকার। কিন্তু প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের বাধা পেরিয়ে দ্রুত শট নিতে হতো তাকে। এবার ঠিকমতো নিতে না পারা তার শটটি গোলবারের অনেক বাইরে দিয়ে চলে যায়।
এর তিন মিনিট পর পিছিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় পড়ে বাংলাদেশ। কর্নার থেকে পাওয়া বলে ডি-বক্স থেকে শট নিয়েছিল কুয়েত ফুটবলার। গোলরক্ষক আনিসুর রহমান জিকো একপাশে থাকায় বাংলাদেশ গোল হজম করার সম্ভাবনা জেগেছিল। কিন্তু সেখানে একেবারে গোললাইন থেকে দারুণ চেষ্টায় বল ফেরত পাঠান এক বাংলাদেশি ডিফেন্ডার। ফলে সেই যাত্রায় বেঁচে যায় জামাল ভূঁইয়ার দল।
২৯ মিনিটে আল রশিদির শট জিকো অনেকটা লাফিয়ে এক হাতে ফিস্ট করার পর দ্রুত হেডে ক্লিয়ার করেন ইসা।
পরের মিনিটেই বাঁ দিক থেকে মোরসালিন ক্রস বাড়িয়েছিলেন বক্সে। রাকিব পাহারায় রাখা ডিফেন্ডারের পায়ে লেগে বল ছুটছিল জালের দিকে, তবে আটকান গোলরক্ষক আব্দুল রহমান মারজুক। এরপর আলি মুহাইসেনকে তুলে মাহাদি দাস্তিকে নামান কুয়েত কোচ।
৪০তম মিনিটে আল রশিদির শট ঝাঁপিয়ে কর্নার করে দেন জিকো। প্রথমার্ধে কুয়েতের এই ২৪ বছর বয়সী রাইট উইঙ্গার সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছেন বাংলাদেশকে।
দ্বিতীয়ার্ধে গোলের জন্য মরিয়া হয়ে উঠে দুই দলই। তবে গোলের দেখা পায়নি কেউই। কুয়েত ফ্রি-কিক ও কর্নার থেকে গোল করার চেষ্টা করে। কিন্তু সফল হয়নি। ৫৪ মিনিটে বরং চমক দেখানোর চেষ্টা করেন রাকিব। কিন্তু তার নেওয়া বাঁ পায়ের বুলেট গতির শট অল্পের জন্য ক্রসবারের ওপর দিয়ে গেছে।
৬১ মিনিটে আবারও ভীতি ছড়ান রাকিব। মোরসালিনের রক্ষণ চেরা পাসে আগের ম্যাচের মতো বাইলাইনের কাছাকাছি গিয়ে জোরালো শট নিয়েছিলেন। কিন্তু এই উইঙ্গারের শট ক্রস বারে লেগে প্রতিহত হলে আবারও হতাশ হতে হয় তাদের । ৬৩ মিনিটে কুয়েতের একটি ফ্রি-কিক প্রতিহত করেন জিকো। একটু পর আবারও গোলের চেষ্টা করে কুয়েত। কিন্তু আল রশিদির শট সেভ করেন জিকো।
৬৭তম মিনিটে অধিনায়ককে তুলে ফয়সাল আহমেদ ফাহিমকে নামান কোচ। জামাল মাঠ ছাড়েন স্ট্রেচারে করে। পরের মিনিটেই আথবি সালেহর জোরাল শট উড়ে যায় ক্রসবারের উপর দিয়ে। এরপর আব্দুল্লাহর শট ফিস্ট করে ফেরান জিকো। গোলের জন্য মরিয়া কুয়েতের অপেক্ষা বাড়ে আরও।
৭১তম মিনিটে একক প্রচেষ্টায় আক্রমণে উঠেছিলেন মোহাম্মদ হৃদয়। কিন্তু সে আক্রমণ পূর্ণতা পায়নি রাকিব-ফাহিম অফসাইডের ফাঁদে পড়ায়। একটু পরই সহকারী রেফারিকে কিছু একটা বলে লালকার্ড দেখেন বাংলাদেশের ফিজিও ডেভিড মাগান। ৭৪তম মিনিটে আল রশিদির সাইড ভলি ফেরান জিকো।
৮৫ মিনিটে মোরসালিনকে তুলে মোহাম্মদ ইব্রাহিমকে নামান কোচ। ৮৭তম মিনিটে দারুণ সুযোগ আবারও পান রাকিব। ফাহিমের নিচু ক্রসে ডাইভিং হেডের চেষ্টা করলেও নাগাল পাননি বলেন। বল-মাথার সংযোগ হলে আনন্দের উপলক্ষ্য পেতে পারত বাংলাদেশ। যোগ করা সময়ের প্রথম মিনিটে বক্সে ঢুকে জোরালো শট নিয়েছিলেন আব্দুল্লাহ। কিন্তু সেটি ক্রসবারের একটু ওপর দিয়ে গেছে।
এবারের সাফে নতুন এক বাংলাদেশকে দেখল সকলে। লেবাননের কাছে ২-০ গোলের হার দিয়ে আসর শুরু বাংলাদেশের। তবে পরের দুই ম্যাচে মালদ্বীপ ও ভুটানের বিপক্ষে মনে রাখার মত দুটি ম্যাচ উপহার দেয় দল। দুই ম্যাচেই পিছিয়ে পড়ে ৩-১ গোলের জয় তুলে নিয়ে মাঠ ছাড়ে মোরসালিন-রাকিবরা।
২০০৩ সালে সাফে নিজেদের একমাত্র শিরোপা জেতা বাংলাদেশ সবশেষ ফাইনাল খেলে পরের আসরে, ২০০৫ সালে। দেড় যুগ পর ফের ফাইনালের মঞ্চে ওঠার হাতছানি ছিল। কিন্তু কুয়েতকে কয়েক দফায় দফায় কাঁপিয়ে দিয়েও পারল না কাবরেরার দল। ১-০ গোলে হেরে বিদায় নিলেও এখানেই বাংলাদেশের স্বপ্ন যাত্রার শেষ নয়। এটাই স্বপ্নযাত্রার নতুন শুরু।