কুনমিং লেইক ও আয়ুষ্মান পাহাড়
‘অ্যাই, অ্যাই না না, খবরদার তোমরা নামবে না।’ ‘না না দাদা, নামিস না, নামিস না প্লিজ তোরা।’ জোর বহমান হিম বাতাসের শব্দ ছাড়া মোটামুটি শুনশান কুনমিং লেইকের পাড়ে প্রায় একই সঙ্গে দুই বঙ্গনারীর আতঙ্কিত যুগলকণ্ঠ চতুধর্মি আশঙ্কার ঢেরা পিটিয়ে দিতেই, পুত্রদের নিয়ে ক্ষীরসাগরমুখী যাত্রা ক্ষণিকের জন্য বাধাগ্রস্ত হল। ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের আশ্বস্ত করে বললাম, দেখছো না, সবাই কেমন খেলাধুলা করছে ঐ মাঝখানে। অতো দূরেও যাবো না আমরা। এখানে যদি তেমন বিপদজ্জনক কিছু থাকতো তাহলে নিশ্চয় এরা এদিকটা এরকম খোলা মেলা রাখতো না। অন্তত লাল পতাকা উড়িয়ে রাখতো। যারই গেছে ঐ জমাট বরফের মাঝ দিঘিতে তারা তো এদিক দিয়ে গেছে। তোমরাও চলো।
‘না না, দরকার নেই। আমি নামবো না। বেশি দূরও যাবে না বেশিক্ষণও থাকবে না। খুব বাতাস আর শীত লাগছে এখানে। দাঁড়ানো যাবে না বেশিক্ষণ এইখানে।’
‘আমি নামবো না।’ লাজুর কথার পিঠাপিঠি জানাল হেলেনও।
যাক, বাঁচা গেল। শর্তসাপেক্ষে হলেও গৃহকত্রীর অনুমতি পাওয়া গেল। আমছালা দুটোই রক্ষা পেল তাতে। কারন এরই মধ্যে পুত্রদ্বয় মা আ ফুপ্পির ঐ নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে তীব্র প্রতিবাদ জানাতে জানাতে আমার হাত থেকে মুক্ত হয়ে নিজেরাই, বরফ জমাট কুনমিং লেইকের বক্ষে এঁকে দিতে পদচিহ্ন। এতে ভালো রকমের একটা পারবারিক গোলযোগ হবার উপক্রম হয়ে পড়ছিল, কারণ আস্কারা দাতা যে আমি নিজে। আর এরকম গোলযোগ পড়লে অবস্থা হয় আমার, শ্যাম রাখি না কূল রাখি? আপাতত তা থেকে রক্ষা পেলাম।
সামনে এগুতে এগুতে ভাবনা এলো, আচ্ছা বেইজিং এর উপকণ্ঠে এই বিশাল লেইক বানিয়ে এর নাম কুনমিং রেখেছিল কেন চিং রাজারা?
ওহ হ্যাঁ, ভালো কথা এরই মধ্যে ঐ ট্রাভেল গাইড জাতীয় বুকলেটের চিংলিশ পড়ে যতোটুকু উদ্ধার করতে পেরেছি এই সামার প্যালেসের মর্ম, তাতে জেনে গেছি যে ৫৪০ একর জায়গা জুড়ে মানে প্রায় তিন বর্গ কিলোমিটার জায়গা নিয়ে বানানো এই পুরো এলাকাটাই মানবনির্মিত। আমাদের গ্রহের সূত্র মেনে এখানেও তিনভাগ জল আর একভাগ স্থল রাখা হয়েছে। তিনভাগ জলের এই কুনমিং লেইক বানাতে গিয়ে যে পরিমাণ মাটি তুলতে হয়েছে খুঁড়ে, তা দিয়ে ঐ যে দেখা যাচ্ছে ওপাড়ের পাহাড়গুলো, নাম নাকি যার হল লংজিবিটি হিল, মানে দীর্ঘায়ু পাহাড় নাকি বলবো আয়ুষ্মান পাহাড়, সেটিকে বানানো হয়েছে।
আচ্ছা, আজ থেকে প্রায় পৌনে তিনশ বছর আগে চায়নিজরা এই রকম একটা বিশাল লেইক আর পাহাড় বানালো কিভাবে? এবার মনে এই প্রশ্ন জাগতেই, মনের সেই দ্বিতীয়জন মহাউজ্জীবিত হয়ে হাজির জবাব দিতে শুরু করলো
আরে দূর, কি যে বল না তুমি। আরে মিয়া তিনহাজার বছর আগে যে জাতি মহাপ্রাচিরের মতো জিনিষ বানানো শুরু করতে পারে, তিনশ বছর আগে তাদের কাছে এটা বানানো কি কোনো ব্যাপার ছিল নাকি? আবার ঐ তিনহাজার বছর আগেই তো মিশরীয়রা মরুভূমির বুকে বিশাল বিশাল সব পিরামিড বানিয়েছিল দাসেদের রক্তঘামে। একই ঘটনা ঘটেছে এখানেও।
এই, এই তোমরা নামবে না কিন্তু আগে। দাঁড়াও আমি আগে নেমে নেই, তারপর নামবে তোমরা, আমার হাত ধরে। দুইপুত্রকে বগল দাবা করে কুনমিং লেইকের বুকে পা রাখার জন্য এগুতে এগুতে এতোক্ষণ মনে মনে ঐসব ভাবতে থাকলেও, এ মুহূর্তে পাড় বেয়ে নীচে নেমে লেইকের বরফ বক্ষের কাছাকাছি হতেই, ছেলেরা হুড়মুড় করে ওখানে নেমে পড়ার উদ্যোগ নিতেই, ভাবনার তাল কেটে গিয়ে বাস্তবে যে ফিরে এসেছিলাম ঠিক সময়ে, বাঁচা গেল তাতে। না হয়, ঐ রকম হুড়মুড় করে নামতে গিয়ে ওরা পড়ে গিয়ে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে না পারতাম নিজেকে নিজে মাফ করতে, না পেতাম মাফ ওদের মা আর ফুপ্পির কাছে।
ওদেরকে পাড়ে রেখে, বেশ সন্তর্পণে লেইকের বরফ বুকে ডান পা রেখে তার উপর ভর করে বা পা নামাতে যেতেই ডান পা এতো সাবধানতা সত্ত্বেও সামান্য একটু ভড়কে যেতেই মনে হল, আরে আমাদের পায়ে যা জুতা আছে তা এরকম জমাট বরফের উপর হাঁটার জন্য আদৌ উপযোগী কি?
তা তো অবশ্যই নয়। তবুও যা হোক, আমার পায়ে না হয় আছে মোটা সোলের চামড়ার জুতো, কিন্তু পুত্রদের পায়ে তো আছে যাকে বলে কেডস, তা। এ মনে হতেই ওদেরকে এই বরফের বুকে নামিয়ে আনার জন্য হাত বাড়ানোর আগেই সাবধান করে দেবার মানসে জিজ্ঞেস করলাম–
আচ্ছা বাবারা, বলো তো তোমরা, আমাদের পায়ে যে জুতো আছে, তা দিয়ে কি বরফের উপর হাঁটা যাবে ঠিকমতো?
এ প্রশ্ন শুনেই, দীপ্র ঘ্যান ঘ্যান করে প্রতিবাদ করে বলে উঠল, ‘না না বাবা, তা হবে না, তা হবে না আমরা নামতে চাই। তুমিই তো বলেছ নামতে, আবার তুমি নিজে তো নেমেছ।’
বড় পুত্রের এই প্রতিবাদে কান না দিয়ে, চুপ করে থাকা ছোট পুত্রকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কী মনে করো অভ্র? আমাদের জুতোগুলো পরে কি এখানে আমরা ভালোমতো হাঁটতে পারবো? তুমি তো ন্যাশানাল জিওগ্রাফিক আর ইউটিউব দেখো খুব।
“নো“ ভাইয়ার দিকে সভয়ে তাকাতে অভ্র এই এক শব্দ উচ্চারণ করতেই দীপ্র দাঁত কিড়মিড়িয়ে উঠতেই, ওর দিকেই প্রথমে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, “দেখো দীপ্র, ওর উপর রেগে যাচ্ছ কেন? আর আমি তো তোমাদের এখানে নামতে মানাও করছি না। কথা হচ্ছে, দৌড় ঝাপ করা যাবে না মোটেও। আর হাঁটবো, সাবধানে, একসাথে।
দীপ্রকে নামানোর পর অভ্রকে নামিয়ে ঘাড় তূলে পাড়ের উপরের তাকাতেই চোখে পড়লো ওদের মা আর ফুপ্পির দুই আশংকিত ও আতঙ্কিত মূর্তির। হাত নেড়ে ওদের অভয় দিয়ে, দু পুত্রকে বগল দাবা করে হাঁটতে শুরু করলাম সামনের দিকে।
এ, এক নতুন অভিজ্ঞতা আমার নিজেরও। বরফ দেখেছি, তুষারের মধ্যে হেঁটেছিও এর আগে ইউরোপে, কিন্তু এরকম জমাট লেইকে হাঁটা তো দূরের কথা, টেলিভিশন ছাড়া চর্মচক্ষে বাস্তবে তো দেখিনি আগে।
লেইকের গোটা শুভ্র বুকটাই জমে হয়ে আছে পেলব মসৃণ। শুধুই মসৃণই না, একটু বেশি রকমেরই। মসৃণ যার টের পাচ্ছি পিচ্ছিল ভাব জুতার তলায়। অতি সাবধানে তাই নিচের দিকে তাকিয়ে পা ফেলছি, দু পুত্রকে দু হাতে শক্ত করে ধরে। পাড় থেকে প্রায় মিটার বিশেক এভাবে আসার পর, ভাবলাম দরকার নেই আর সামনে এগোনোর। দাঁড়িয়ে তাই পুত্রদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করলাম যে আর এগুবো না সামনে। এতে দীপ্র যে নাখোশ হয়েছে, তা পরিষ্কার তার চেহারায় বোঝা গেলেও, মুখে বললো না কিছুই। ঐদিকে নির্বিকার অভ্রর চোখ ন্যস্ত হয়ে আছে, জমাট লেইকের মাঝখানটাতে, যেখানটায় হয়েছে লোকজনের বিরাট জনসমাগম।
কতো দূর হবে আছে ওরা, আমাদের কাছ থেকে? চোখ আন্দাজে মনে হচ্ছে হবে হয়তো তিনশ বা চারশ মিটার দূরে। তবে স্থির নয় সেই জনসমাগম। নড়াচড়া করছে ওরা নানান রঙের পোষাকে। কেউ কেউ করছে স্কেটিং। কারো কারো দেহ ভঙ্গিমা আর তাদের দু হাতে ধরা লাঠি মতো কিছু দেখে মনে হচ্ছে, ওরা স্কিইং করছে। অবশ্য এ বিষয়ে আমার জ্ঞান অন্যান্য আর সব বিষয়ের মতোই অজ্ঞানতার পর্যায়ের, যার কারণে বুঝতে পারছি না এরকম সমতল বরফ স্কিইং করার জন্য আদৌ উপযুক্ত কি না?
টিভিতে মাঝেমধ্যে স্কিইং এর যে সব দৃশ্য দেখেছি, তাতে তো মনে হয়েছে স্কিইং করার উপযুক্ত জায়গা হলো বরফে মোড়া পাহাড়ি ঢাল। সে যাক, সাদা বরফের উপর নানান রঙের জ্যাকেট প্যান্ট পরা ঐ জনসমাগমের নানান গতির নড়াচড়া দেখে মনে হচ্ছে ঐখানে বসে গেছে জমজমাট রঙের মেলা। সাথে সাথেই বহুকাল আগে শোনা বাপ্পিলাহিড়ীর গানটা বেজে উঠল মনের কোথাও
‘মাকা যায় মাকা যায়, রাম পাম পু,
মাকা যায় মাকা যায় রাম পাম পু
হলুদ বেগুনি সবুজ সাদা নীল ;
রঙয়ে রঙয়ে মিশে হলো তোমার আমার মিল।’
আচ্ছা বুঝলাম, রঙে রঙে না হয় মিল হলোই কোনো লায়লি মজনু, বা শিরি ফরহাদের। তা তো হতেই হবে কোনো না কোনোভাবে, তাতে কিছু যায় আসে না। কথা হচ্ছে ঐ মাকা যায়, মাকা যায় মানে কী? আর রাম পাম পু রই বা মানে কী?
এ প্রশ্ন সেই যখন গানটা শুনেছিলাম প্রথম, তখন যেমন মনে পড়েছিল, আবার এতোদিন পর এই সামার প্যালেসের কুনমিং লেইকের শ্বেত শুভ্র বুকের উপর দাঁড়িয়ে যখন সেই গানটাই মনে পড়লো, সেই প্রশ্নটাও ফিরে এলো সাথে!
‘আচ্ছা বাবা, আমরা আরেকটু সামনে যাই না। ইস আগে বললে না কেন যে এখানে আসবে? তাহলে আমরা বরফের উপরে হাঁটা যায় এমন জুতো কিনে নিয়ে আসতাম।’ হাত ঝাঁকিয়ে দীপ্র কথা ক’টি বলতেই, কিছু না বলেই তিন বাপ বেটা ফের চালালাম পা সামনের দিকে।
ফের এগিয়ে এখন আমরা যে জায়গাটায় এসেছি, তার থেকে লেইকের ওপাশে দেখতে পাচ্ছি সেই আয়ুষ্মান পাহাড়টিকে, যার উপরে দেখা যাচ্ছে মাথা উঁচু করে সটান উর্ধ্বমুখী হয়ে আছে খাঁটি চায়নিজ স্থাপত্যরীতিতে তৈরি করা, তিন নাকি চারতলা উঁচু রাজকীয় প্যাগোডাটি। সেটির পাদদেশে, আর আশেপাশে ছড়িয়ে আছে আরো বেশ কটা চায়নিজ স্থাপত্যের একতলা ভবন।
আচ্ছা, বলোতো দেখি, ঐ যে ওই পাড়ে পাহাড়ের মতো উঁচু জায়গাটার উপর যে লাল রঙের দালানটা আছে ওটা কী?
‘ওটা প্যাগোডা’। এতোক্ষণ চুপ করে থাকা অভ্রর মুখ থেকে এ কথা বেরিয়ে আসতেই বেশ চমৎকৃত হয়ে বললাম
ভেরি গুড বাবা। তা তুমি কিভাবে জানলে যে ওটা প্যাগোডা?
‘টিভিতে দেখেছি তো।’ অভ্রর জবাবের সাথে সাথে দীপ্র বলে উঠলো
‘কেন বাবা আমরা তো শ্রীলংকাতেও দেখেছিলাম অনেক প্যাগোডা। তাই না?’
তা ঠিক আছে। কিন্তু তুমিই বলো, রং আর ডিজাইন কি একরকম নাকি শ্রীলংকার প্যাগোডা আর এই চায়নিজ প্যাগোডার? শ্রীলংকার প্যাগোডাগুলো তো সব সাদা রঙের, আর ওগুলোর আছে একটা বড় গম্বুজ।
না, তা না। তবে আমিও জানতাম যে ওটা প্যাগোডা। বুঝলাম অভ্র আগে জবাব দিতে না পারার ছুতা দাঁড় করালো দীপ্র।
ঠিক আছে। আমি জানি যে, তুমিও জানো। এখন বলো তো এটার নাম কেন সামার প্যালেস হল?
“সামারে এসে এখানে কিং থাকতো তাই আর কি। ছোট ভাইয়ের কাছে একটু আগে হেরে যাওয়াটাকে সমতায় ফিরিয়ে আনতে দ্রুত বলে উঠল দীপ্র।
‘বাবা, বাবা ওই যে দেখো কী সুন্দর একটা ব্রিজ।’ পাশ থেকে অভ্র এসময় এ কথা বলে আমাদের দৃষ্টি আরো বাঁ দিকে, জমাট লেইকের উপরে দাঁড়িয়ে থাকা বেশ বড় আর উঁচু সেতুটার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই, মনে পড়লো এটাই সম্ভবত এখানকার বিখ্যাত সেই সেভেনটিন হোল ব্রিজ বা সতেরো সুড়ঙ্গের সেতু।
‘বাবা, বাবা, ওই যে দেখো ঐখানে মনে হয় এঙিডেন্ট হয়েছে।’ উদ্বিগ্ন গলার দীপ্রর এই কথা এসময় দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিল লেইকের মাঝখানের সেই রঙ্গয়ের মেলায়। হ্যাঁ, তাইতো মনে হচ্ছে দেখছি? সাদা পোশাক পড়া বেশ কয়েক জোড়া লোক ছুটছে স্ট্রেচার হাতে করে ভিড় ফুঁড়ে।
লেখক: ভ্রমণ সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক।