দোতলা থেকে এক তলার দূরত্বে মকছেদ আলী সাঁই–এর সাথে আমার প্রথম পরিচয়। কোলকাতায় বালিগঞ্জের একটি দোতলা বাড়িতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। উপরের তলায় তখন একটি স্টুডিও। দেয়ালে ভারি পর্দা ঝুলিয়ে শব্দের মান নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দুটি অপেশাদার টেপ রেকর্ডার মেঝেতে রাখা। চেয়ার টেবিল নেই। মেঝেতে বসেই রেকর্ডিং–এর সব কাজ সারতে হয়। রাতে ঐ স্টুডিওতেই শব্দ সৈনিকদের থাকার ব্যবস্থা। বালিশ আর চাদর দেয়াল ঘেঁষে দিনের বেলা এক পাশে রেখে দেয়া হত। ২৫মে, ১৯৭১ থেকে পঞ্চাশ কিলোওয়াট শক্তি সম্পন্ন একটি ট্রান্সমিটারে অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয়। এই স্টুডিও থেকে অধিবেশনের জন্য পুরো অনুষ্ঠান রেকর্ড করা হত এবং তা প্রতিদিন নির্ধারিত সময়ে সরবরাহ করা হত ট্রান্সমিটার থেকে প্রচারের জন্য। পরে দোতলার অন্য একটি কক্ষে আরো একটি স্টুডিও একই অপেশাদার মানে তৈরি করা হয়। অনুষ্ঠান, সংবাদ ও প্রকৌশল বিভাগের সার্বক্ষণিক কর্মীরা বাড়িটিতে থাকতেন। এছাড়াও থাকতেন সঙ্গীত শিল্পী, কথক, গীতিকার। সবাই শব্দ সৈনিক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য এসেছেন। একদিনে আসেননি। ভিন্ন ভিন্ন দিনে তাঁরা আসতেন। তাঁদেরই অন্যতম মকছেদ আলী সাঁই। তাঁর সাথে প্রথম পরিচয় হয় তাঁর উদাত্ত অনবদ্য কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে। রাত তখন আনুমানিক এগারটা। স্টুডিওতে অনেকটা সময় কাজ করার পর দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলাম। একতলার সিঁড়ির নিচের এক চিলতে জায়গা থেকে কিছু এলোমেলো কণ্ঠস্বর ভেসে আসছিল। হঠাৎ নিস্তব্ধতা। এর পরেই ভেসে এলজ্জ‘আমি অপার হয়ে বসে আছি, ওহে দয়াময়’। কণ্ঠে নিবেদনের অপরূপ ভঙ্গি। চড়ায় কণ্ঠস্বর যেন অসীমকে ছোঁয়ার প্রয়াসে নিমগ্ন। দোতলা বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল বিচ্ছেদের হাহাকার আর স্রষ্টার সাথে মিলনের আর্তি। মকছেদ আলীর সঙ্গে এই আমার প্রথম পরিচয়। একতলায় নেমে এলাম। একতলার সিঁড়িকোঠায় একগুচ্ছ মানুষের নীরব হয়ে বসে থাকা। সবাই মগ্ন হয়ে গান শুনছেন। মোঃ আব্দুল জব্বার, অনুপ ভট্টাচার্য্য, সরদার আলাউদ্দিন। এরা সবাই খ্যাতনামা সঙ্গীত শিল্পী। আরও অনেকে ছিলেন। সবার সাথে মুহূর্তের দৃষ্টি বিনিময়। আমি একপাশে দাঁড়িয়ে গানটি শুনলাম। গান শেষ হলে বসে পড়লাম মেঝেতে। জব্বার তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে উচ্চ কণ্ঠে উঁচু মানের প্রশংসায় মকছেদ আলীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। তাঁর সাথে এই আমার দ্বিতীয় পরিচয়। গানটি যে লালনগীতি তা বুঝতে পেরেছিলাম গান শেষের ভণিতা থেকে।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কি শুধু লালনগীতি করেন’। সংক্ষিপ্ত উত্তর,‘ছেঁউড়িয়াতে যাতায়াত আছে। লালনগীতিই করি।’ এই সামান্য কথার ভঙ্গি থেকে তাঁর বিনয় ও পরিমিতি অনুভব করতে পারলাম।
কুষ্টিয়ায় মোঃ আব্দুল জব্বার তাঁর কাছেও গান শিখেছেন একথা তখন জব্বারের কাছ থেকেই শোনা। সবার অনুরোধে আবার গান শুরু হল। মধ্যরাত পর্যন্ত চলল হৃদয় জুড়ান কথা ও সুরে বয়ে যাওয়া অপূর্ব এক লালনের নদী। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হল। শেষ হয়ে গেল স্বাধীন বাংলা বেতারের কর্মময় ঐতিহাসিক দিনগুলি। ঢাকায় ফিরে এসে ১৯৭২–এ জানুয়ারির প্রথম দিকে যোগ দেই বাংলাদেশ বেতারে, শাহবাগে। ১৯৭৪–এর মার্চে মাসে বদলী হয়ে যাই ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসে। একটি ভবন থেকে পাশের অন্য একটি ভবনে, বদলীর দূরত্ব এটুকুই। বন্ধুবর শহীদুল ইসলাম তখন ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসের পরিচালক। মকছেদ আলী সাঁই সেখানে নিজস্ব শিল্পী হিসেবে কর্মরত। এখানে এসে তাঁকে নতুনভাবে আবিষ্কার করলাম। লালনের গান সম্পর্কে তাঁর অসাধারণ তত্ত্বীয় জ্ঞান, তাঁকে নতুন করে চিনতে শেখাল। বাউল সাধনার বিভিন্ন পথ ও পর্যায়, বাউলদের নিজস্ব পরিভাষা, লালনের গানের সুর বৈচিত্র্য, বিষয় ভিত্তিক গানের বিভাজন ও গায়কী সবকিছু তিনি নিষ্ঠাবান দার্শনিকের মতো ব্যাখ্যা করতে পারতেন। এ–সব জেনেছি অবসরে তাঁর সাথে কথা বলতে বলতে, গান শুনতে শুনতে। ১৯৭৪ সালে লালনের মৃত্যু দিবসে আধা ঘণ্টা সময় সীমার একটি অনুষ্ঠান প্রচারের পরিকল্পনা নেয়া হল। মকছেদ আলী একা কথা বলবেন এবং গান গেয়ে তা ব্যাখ্যাও করবেন। অসাধারণ এক অনুষ্ঠান তিনি শ্রোতাদের উপহার দিয়েছিলেন। সংক্ষেপে পরিপূর্ণ এক লালন উঠে এসেছিল অনুষ্ঠানটিতে।
রেডিও পাকিস্তান ঢাকায় লালনের কোন পরিচর্যাই হয় নি। একজন শিল্পীর কথা মনে পড়ছে। নাম এম. এ. গফুর। তিনি মাঝে মধ্যে ঢাকা কেন্দ্র থেকে লালনগীতি পরিবেশন করতেন। বিচ্ছিন্নভাবে হয়তো বা কেউ কেউ গেয়ে থাকতে পারেন। এই প্রচার এত নগণ্য, এত ক্ষুদ্র যে তা উল্ল্লেখ করার মতো নয়। স্বাধীনতার পর দ’ুবছরের মাথায় ১৯৭৪ সাল থেকে লালনের প্রচার ও প্রসার শুরু হয়। এর পেছনে কারণ একটাই। মকছেদ আলীর মতো লালনগীতির শিল্পী তখন ছিল বলেই এটা সম্ভব হয়েছিল। এরপর শহীদুল ইসলামের (পরিচালক, ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস) নামটি উচ্চারণ করতে হয়। আমি নিজেও যুক্ত ছিলাম। একদিন শহীদুল ইসলামের অফিস কক্ষে বসে আছি। মকছেদ আলী সাঁই এসে বসলেন। দেখেই বুঝতে পারলাম কিছু একটা বলবেন। কুষ্টিয়া শহরের একটি মেয়ের কথা জানালেন। খুব ভালো লালনগীতি গায় এবং গান শিখেছে তাঁরই কাছে। অনুরোধটি ছিল কুষ্টিয়া থেকে তাকে নিয়ে আসবেন। গান শুনে উপযোগী মনে হলে তার গান যেন বেতার থেকে প্রচার করা হয়। শহীদ আর আমার মানসিকতা একই। মকছেদ আলী সাঁই –এর উপর আমাদের আস্থা প্রচণ্ড। নির্ধারিত একটি দিনে মেয়েটিকে ঢাকায় নিয়ে এলেন, সঙ্গে তার বাবা। পরিচালকের কক্ষে আমরা বসলাম। অল্প বয়সী একটা মেয়ে। দেখে শহীদও আমার মনে হয়েছিল এতটুকু মেয়ে আবার কি গান করবে? আমি এবং শহীদ দুজনেই দ্বিধান্বিত। তখন সে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। এটা জেনে গান শোনার ইচ্ছেটা স্তিমিত হয়ে এল। অনেক দূর থেকে এসেছে, গান তো শুনতেই হবে। হারমোনিয়াম নিয়ে আসা হল। প্রথম থেকেই শিল্পীর প্রতি শহীদ আর আমার অনাস্থার ভাব এসে গিয়েছিল। মেয়েটি গান ধরল, ‘সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন’। সুরের টানে কথা উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। এত অল্প বয়সী একটি মেয়ের পক্ষে এভাবে গান গাওয়া কেমন করে সম্ভব! কণ্ঠের সে কি লালিত্য আর অনুরণন! ঐ সময় ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস থেকে ‘রংধনু’ শিরোনামের একটি অনুষ্ঠান প্রচার করা হত। সময় সীমা ছিল কুড়ি মিনিট। অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশ বেতারের প্রতিটি কেন্দ্র থেকে সমপ্রচার করা হত। পরিকল্পনা নেয়া হল রংধনুতে কুড়ি মিনিট সময় সীমা জুড়ে শিল্পীর গান প্রচার করা হবে। নতুন একজন শিল্পীর প্রথম অনুষ্ঠান কুড়ি মিনিটব্যাপী প্রচারের পরিকল্পনা বেতারের ইতিহাসে সেটাই ছিল প্রথম এবং শেষ। গান রেকর্ড করে তা যথারীতি প্রচার করা হল। এই শিল্পীর নাম ফরিদা পারভীন এবং তাঁকে তুলে আনার কৃতিত্ব মকছেদ আলী সাঁইয়ের।
মকছেদ আলী সাঁই লালনের আখড়ার সাথে একান্তভাবে জড়িত ছিলেন। সেখানকার প্রায় সমস্ত বাউলদের সঙ্গে তাঁর ছিল সখ্য। তাঁদের সঙ্গে মিশতেন নিবিড়ভাবে। তাঁরাও তাঁকে ভালবাসতেন গভীরভাবে। ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসের নানা ধরনের কাজের মধ্যে একটি ছিল মৌলিক সুরে গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে স্থানীয় সব শিল্পীদের কণ্ঠে মৌলিক সুরে লোক সঙ্গীত সংগ্রহ করা। ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস থেকে পরিকল্পনা করা হল লালনগীতি সংগ্রহের এবং তা বাস্তবায়নের একমাত্র নির্ভরযোগ্য মানুষটি হলেন মকছেদ আলী সাঁই। দাপ্তরিক পর্যায়ে দায়িত্ব দেয়া হল তাঁকে। কুষ্টিয়ায় চলে গেলেন তিনি। ফিরে এলেন আট–দশজনের একটি দল নিয়ে যাঁরা বাউল এবং শুধুমাত্র লালনগীতি গেয়ে থাকেন। প্রত্যেকের সঙ্গে একতারা আর ডুগি। তাঁরা এসে উঠলেন এখনকার শেরাটন হোটেলের উল্টো দিকে শাকুরা বলে পরিচিত বিল্ডিংয়ের পেছনের মাজার শরীফে। মাজার এর পাশেই ছিল বেশ বড় একটি ঘর। সেখানে প্রতিদিন সন্ধ্যে থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত গান হত। মারফতি, মুর্শিদী, কখনও আধুনিক কিংবা নজরুলগীতিতে জমে উঠত আসর। মাজারের খাদেমের নাম জানু। তাঁর সাথে অন্তরঙ্গ ছিলেন মকছেদ আলী সাঁই। তাঁর অনুরোধেই বাউলদের সেখানে থাকতে দিয়েছিল জানু। বাউলরা খেতেন হোটেলে। রেকর্ডিং চলত বিকেল থেকে রাত দশটা–এগারটা পর্যন্ত। একদল চলে গেলে অন্য একটি দল নিয়ে আসা হত। যাঁরা রেকর্ড করে গেছেন তাঁদের মধ্যেও অনেকেই আবার আসতেন। এভাবেই লালনগীতি সংগ্রহের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়। এদেরই একজন প্রখ্যাত বাউল খোদা বক্স বিশ্বাস। পরবর্তীতে যিনি ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমীতে লালনগীতির প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এভাবেই মকছেদ আলীর একক সহযোগিতায় বাংলাদেশ বেতারের মাধ্যমে শ্রোতাদের কাছে লালনগীতি উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল।
শুধু বাউলদের ঢাকায় এনে লালনগীতি রেকর্ড করা হত তা নয়। লালনের সমাধি স্থলে গিয়েও ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসের জন্য লালনগীতি সংগ্রহ করা হয়েছিল। এরই অংশ হিসেবে লালনের আখড়াতে গিয়েছিলাম মকছেদ আলী সাঁইসহ আমি। এর আগেও সেখানে গেছি। এবার থাকার ব্যবস্থা হল হাঁটা পথের দূরত্বে মকছেদ আলীর শ্বশুর বাড়িতে। খাওয়ার সময়টুকু বাদ দিয়ে সকাল ১১টা থেকে প্রায় ভোর রাত পর্যন্ত কাটাতাম লালন শাহর সমাধি স্থল প্রাঙ্গণে। আখড়ায় বাউলদের আনন্দ মেলা বসেছে। নানা অঞ্চল থেকে বিচিত্র সব চেহারার বাউলেরা এসেছেন। আখড়াতেই তাঁদের আহার এবং নিদ্রা। আট–দশজনের এক একটি দল। এভাবে অনেক দল বসে আছে। আলাদা আলাদাভাবে, কিন্তু কাছাকাছি। ইচ্ছে মতো গান করছেন তাঁরা। কি এক নেশার ঘোর, কি এক নিমগ্নতায় ডুবে যায় গান গাওয়ার সময়। দলের অন্য যাঁরা শোনেন তারাও হারিয়ে যান কোন এক অচিন জগতে। পাশাপাশি অনেক কণ্ঠের গান ভেসে যায় বাতাসে। কথা আর সুর তাঁদের টেনে নেয় বাউল–দর্শনের গহীনে। আমাদের কাজ ছিল বাউলদের নির্বাচন করা। গান শুনে শুনে বিশেষ করে মকছেদ আলীই কাজটি করতেন। তারপর তাঁদের নিয়ে যাওয়া হত কিছুটা দূরের একটি বাড়িতে। দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত রেকর্ডিং করা হত লালনগীতি। তিন দিন কেটে গেল এভাবে। তৃতীয় দিন সন্ধ্যে বেলা লালন শাহর মৃত্যু দিবস উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান। স্থানীয়ভাবে আয়োজন করা হয়েছে। ড. আনোয়ারুল করিম একজন খ্যাতিমান গবেষক। তিনিই নেতৃত্ব দিচ্ছেন। যথারীতি অনুষ্ঠান শুরু হল। এক সময় আমার নাম ঘোষণা করা হল কিছু বলার জন্য। আমি ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস থেকে লালনগীতি সংগ্রহ, প্রচার ও সংগ্রহের বিষয়ে আলোকপাত করলাম এবং এখানে এসে আমার ভালো লাগার কথাটিও বললাম। হঠাৎ দর্শকদের মধ্য থেকে একজন দাঁড়িয়ে উঠে ক্ষুব্ধ স্বরে যা বলল তার মর্মার্থ হচ্ছেজ্জবাউলদের গান রেকর্ড করে সেগুলো লক্ষ লক্ষ টাকায় বিদেশে বিক্রি করা হচ্ছে এবং বাউলরা কোন টাকা পাচ্ছে না। আনোয়ারুল করিম আমার খুব পরিচিত। আমি কিছু বলার আগেই তিনি মাইক্রোফোনের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাঁকে খুবই বিব্রত মনে হচ্ছিল। ঘটনার জন্য তিনি দুঃখ প্রকাশ করলেন। এক পর্যায়ে তাঁকে থামিয়ে দিয়ে আমি কথা বলতে শুরু করলামজ্জ‘কে কথাটি বললেন উঠে দাঁড়ান।’ (ঐ মুহূর্তে লোকটাকে চিহ্নিত করতে পারছিলাম না) একই কথার পুনরাবৃত্তি করার পরও লোকটি উঠে দাঁড়াল না। আমি বললাম, ‘যিনি কথাটা বলেছেন তাঁকে আমার সঙ্গে আগামীকাল ঢাকায় যেতে হবে। ঢাকায় গিয়ে তিনি যেখানে ইচ্ছে আমার বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ লিখিতভাবে জানাতে পারেন। আমার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি করার দাবিও জানাতে পারেন। আমি নিজে তাঁর সঙ্গে থেকে সমস্ত ব্যবস্থা করে দেব। আর এই মুহূর্তে আপনি আমার কাছে এসে দাঁড়ান। যে প্রমাণের ভিত্তিতে আপনি কথাটা বলছেন তা উপস্থিত সবাইকে জানিয়ে দিন। জানানটা আপনার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।’
হঠাৎ করে দর্শকদের মধ্যে একটা নীরবতা নেমে এল। একজন বয়সী বাউল উঠে দাঁড়িয়ে সবার পক্ষ থেকে ক্ষমা চাইলেন অত্যন্ত বিনয়ের সাথে। আরো কিছু কণ্ঠস্বর ভেসে এলজ্জভুল করে বলে ফেলেছে, কিছু মনে করবেন না। পুনরায় অনুষ্ঠানটি শুরু হল। এক পর্যায়ে মকছেদ আলী সাঁইয়ের নাম ঘোষণা করা হল কিছু বলার জন্য। তিনি গানও গাইবেন। প্রথমেই সবার পক্ষ থেকে আমার কাছে ক্ষমা চাইলেন। কিন্তু কথার মাঝেই দর্শকদের একজন দাঁড়িয়ে বলে উঠলজ্জআমরা জানতে চাই উনি সাঁই হলেন কেমন করে? কণ্ঠে আক্রমণাত্বক ভঙ্গি। মকছেদ আলী স্বভাব সুলভ বিনয়ী ভঙ্গিতে নিবেদন করলেনজ্জ‘আমি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে মুক্তিযুদ্ধের সময় কাজ করেছি। সেখানে সবাই আমাকে নাম ধরে না ডেকে সাঁই বলে ডাকত। নামের সঙ্গে তারাই সাঁই যুক্ত করে দিয়েছেন। এ অধমের কি সাঁই হওয়ার যোগ্যতা আছে? যোগ্যতা যে নেই সেটা আপনারাও বোঝেন।’
এরপর তিনি আর কোন কথা বলেন নি। পরবর্তী নির্ধারিত ঘোষণা না দেয়ার জন্য আমি ইশারায় নিষেধ করে মাইক্রোফোনের সামনে এসে বললামজ্জ‘মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাস স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আমরা এক সঙ্গে কাজ করেছি। আমরা সবাই তাঁকে ভালবেসে সাঁই বলে ডাকতাম, ভালাবাসার ডাক নিয়ে প্রশ্ন না করাই ভাল। এই ভালবাসার পথ ধরেই তাঁর নামের সাথে সাঁই যুক্ত হয়ে গেছে।’ কুষ্টিয়ায় ছেঁউড়িয়ার সেই অনুষ্ঠানের সাঁই নিয়ে উত্থাপিত প্রশ্নের রেশ ধরে বলি আমরা সবাই মকছেদ আলী সাঁইকে একান্তভাবে ভালবেসেছিলাম আর তাঁর ভালবাসা নিবিড় হয়ে ছুঁয়ে ছিল সাধক লালনের সমগ্র সত্তা জুড়ে যেন মনে হয় চাঁদের আলোতে লালনের নদীতে ভেসে বেড়ান অপার হয়ে বসে থাকা একজন মানুষ।