গবেষক–কলামিস্ট আলহাজ্ব আহমদুল ইসলাম চৌধুরী দৈনিক আজাদীতে একটি জরুরি বিষয় অবতারণা করে ধর্মপ্রাণ মানুষের অসহনীয় বিড়ম্বনার কথাই জানিয়ে দিলেন। ১৭ মে বুধবার দৈনিক আজাদীর সাপ্তাহিক কলাম ‘প্রবাহ’ এ তিনি যে কথা বললেন তা যেন সবার মনের কথা। যা সবাই বলতে চায়, কিন্তু বলার মতো সুযোগ হয়ে ওঠে না। ‘আকদ ও জানাজায় অংশগ্রহণ করতে গিয়ে বিব্রতকর পরিবেশের মুখোমুখি’ শিরোনামে লেখায় কলামিস্ট আলহাজ্ব আহমদুল ইসলাম চৌধুরী অকপটে যা বলেছেন তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল পাওয়া যায়।
মসজিদে প্রতি জুমার দিবসে ইমাম খতিব সাহেবগণ খুতবার আগে কমপক্ষে ৩০/৪০ মিনিট বক্তব্য রাখেন। কিছু ইমাম–খতিব প্রাসঙ্গিক দিক নির্দেশনামূলক গঠনমূলক তাৎপর্যপূর্ণ বক্তৃতা দেন সত্য, কিন্তু অনেক ইমাম–খতিবের বক্তব্যে তেমন সারবত্তা খুঁজে পাওয়া যায় না। অগোছালো এলোমেলো বক্তব্য দিয়ে যেন সময় পার করা। মুসল্লিদের মনোযোগ আকর্ষণে অনেকে সক্ষম হন না। অথচ সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বক্তব্য দিলে মুসল্লিরা উপকৃত হতে পারেন এবং চলার পথে দিশা লাভে সক্ষম হন। দেশ ও সমাজে বিরাজিত নানা অবক্ষয় প্রবণতার বিরুদ্ধে মুসল্লিদের সচেতন করে তোলার যে সুযোগ একজন ইমাম–খতিবের রয়েছে তা তাঁরা কতটা ঠিকভাবে পালনে সক্ষম হচ্ছেন তাই আজ বড় জিজ্ঞাসা। একজন ইমাম–খতিব যদি যোগ্য বিজ্ঞ বিচক্ষণ ও ইল্্ম ও আমলে অনন্য হন, এর সরাসরি প্রভাব পড়ে মুসল্লিদের মাঝে। তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে মুসল্লি তথা এলাকার মানুষের মাঝে অনুকূল পরিবর্তন আসে। কেননা, এখনো সমাজে তাঁদের যথেষ্ট প্রভাব ও সম্মান–কদর আছে। তাঁরা যদি ব্যক্তিত্ববান, দায়িত্বশীল, জ্ঞানী ও বিচক্ষণ হন তাঁদের দ্বারা এলাকাবাসী নানাভাবে উপকৃত হন। তা কি অস্বীকার করা যাবে? লেখক আলহাজ্ব আহমদুল ইসলাম চৌধুরী বলতে চেয়েছেন, ইমাম–খতিবগণ যেন সত্যিকার অর্থে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে জুমার দিনে সারগর্ভ বক্তব্য রাখেন। আধা ঘণ্টা বা পৌনে এক ঘণ্টা ধরে তাঁরা যে বক্তব্য রাখার সুযোগ পান, তা যেন তাঁরা পুরোপুরি কাজে লাগান। তাঁদের কাছে গঠনমূলক তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্যই আশা করেন মুসল্লিরা। একজন ইমাম খতিব আলেম দেশে বিরাজিত সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, দুর্নীতি, মাদক, নারী–শিশু নিপীড়ন, ইভটিজিং, বাল্য বিয়েসহ সামাজিক নানা অনাচার অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে তাঁর আওতাধীন মুসল্লি ও জনসাধারণকে সচেতন করে তোলেন তবে তাতে অনুকূল প্রভাব পড়তে বাধ্য। এভাবে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজসহ দেশে ইতিবাচক রূপান্তর ঘটবে এ আশা করা যায়।
এখানে আরেকটি বিষয়ে কিছু বলা জরুরি মনে করি। কোনো পাড়া বা মহল্লায় কোনো মানুষ মা–বাবা, স্ত্রী ও তিন চারজন সন্তান রেখে হঠাৎ মারা গেল। বা কেউ কোনো দুর্ঘটনায় মারা গেল বেশ কয়েকজন সন্তান সন্তুতি রেখে। তাহলে একমাত্র উপার্জনক্ষম পরিবারের কর্তাকে হারিয়ে এই অসহায় পরিবারের অবস্থা কী দাঁড়াবে একটু ভেবে দেখুন। কীভাবে এই পরিবার টিকে থাকবে, নিহতের স্ত্রী–সন্তানদের ভরণ পোষণ, পড়াশোনার দায়িত্ব কে নেবে? আমাদের দেশ এখনো এতটা কল্যাণরাষ্ট্র হয়ে ওঠেনি যে, অসহায় পরিবারগুলোর দায়িত্ব নেবে। এখানেই দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে পারেন একজন ইমাম–খতিব ও আলেম। তাঁর মহল্লার কোনো ব্যক্তি হঠাৎ স্বাভাবিকভাবে হোক বা নানা দুর্ঘটনায় হোক মারা গেলেন, তাঁর অসহায় পরিবারের পাশে মহল্লা বা সমাজের বিত্তবান মানুষেরা যাতে এগিয়ে আসেন এই আহ্বান–অনুরোধ রাখতে পারেন একজন ইমাম–খতিব। তাঁরা মহল্লাবাসী দশজন বা পনের জন বিত্তবান ব্যক্তি বাছাই করে তাঁদেরকে বলতে পারেন, আপনারা এই পরিবারটির ভরণ পোষণের দায়িত্ব নিন। সন্তানদের পড়াশোনার সুযোগ করে দিন। অন্যদিকে সড়ক দুর্ঘটনাসহ নানা দুর্ঘটনায় মৃত ব্যক্তির পরিবারকে সরকার এককালীন লাখ তিন লাখ টাকা অনুদান দিয়ে থাকে। তা কিন্তু যথেষ্ট নয়। সরকারের তরফ থেকে দেয়া এককালীন লাখ–দুই তিন লাখ টাকা দান অনুদান দিয়ে এই অসহায় পরিবারকে তো বেশি দিন বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। তা দিয়ে হয়তো মাস ছয়েক বা বছর খানেক চলা যাবে। তারপর কী হবে? পরিবারটির অসহায়ত্ব কীভাবে মোচন হবে? হ্যাঁ, এই জায়গায় বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন সম্মানিত ইমাম–খতিবগণ। তাঁরা জুমার দিনে প্রদত্ত ভাষণে বিত্তবান লোকদেরকে অনুরোধ করতে পারেন, আপনারা প্রতি মাসে দুই/তিন হাজার টাকা করে এই অসহায় পরিবারকে আর্থিক সাহায্য করুন। কিংবা জাকাতের টাকা দিয়েও অসহায় গরিব পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানো যায়। সারা বছর ধরে দেওয়া টাকা জাকাত হিসেবে ধরা যায়। বছর শেষে তা জাকাতের টাকা হিসেবে সমন্বয় করা যেতে পারে। অসহায় পরিবারকে এককালীন দান অনুদান দেয়ার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে এসে সত্যিকার অর্থে প্রতি মাসে পরিবারগুলোর মাসিক খরচ জোগানো যে বড় জরুরি দায়িত্ব তা আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। ইমাম আলেম উলামাদেরকে এ ব্যাপারে মানুষের মাঝে দায়িত্বানুভূতি জাগাতে হবে। একটি মানবিক কল্যাণমূলক সমাজ ও দেশ গড়ায় আলেম ও ইমাম সমাজের দায়িত্ব কম নয় তা তাঁদেরও উপলব্ধি করা দরকার।
নামাজে জানাজায় সময়ের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। খুব দীর্ঘক্ষণ ধরে বক্তব্য দেয়ার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পরকালে নাজাত ও জান্নাত পেতে চাইলে অনন্ত জীবনে সুখ শান্তি চাইলে আপনাকে পুণ্যময় জীবন গঠন করতে হবে, মানবিক জীবনাচারে অভ্যস্ত হতে হবে ইত্যাদি কথা বলে মুসল্লিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন জানাজা নামাজের ইমাম সাহেব। তবে মৃত ব্যক্তির ভালো দিকগুলো আলোচনা করতে প্রিয় নবীর (দ) নির্দেশনাও রয়েছে। এতে মৃত ব্যক্তি উপকৃত হন বলে হাদিস শরিফে উল্লেখ রয়েছে। আর আলোচনা এমন দীর্ঘ করা যাবে না, যাতে কারো বিরক্তি ঘটে। মৃত ব্যক্তির পক্ষে দোয়া ও ক্ষমা চেয়ে একজন ওয়ারিশও সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিতে পারেন। এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।
বিয়ের আবশ্যিক শর্ত ‘আক্বদ’ নিয়েও সময়ক্ষেপণের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছেন লেখক আলহাজ্ব আহমদুল ইসলাম চৌধুরী। নানা মসজিদ–মাজার–খানকাহ শরিফে জুমার দিনে বা আসরের নামাজ শেষে ‘আক্বদ’ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এখানেও অনেকের আপত্তি। ‘আক্বদ’ সম্পন্ন করতে ২০/২৫ মিনিটের চেয়ে বেশি লাগার কথা নয়। কিন্তু সময়ের দিকে অনেকেই লক্ষ্য করেন না। নানা ছুতায় ‘আক্বদ’ অনুষ্ঠানে অধিক সময় নিয়ে আত্মীয় স্বজন–শুভানুধ্যায়ীদেরকে কষ্টে ফেলার কোনো মানে হয় না। বলা হয়ে থাকে ‘আদ্্দীনু ইউসরুন’ অর্থাৎ ইসলামের বিধানসমূহ অত্যন্ত সহজ। আমরাই তা কঠিন করে ফেলছি। তাই, জানাজা নামাজ বা আকদ যাই বলি না কেন, আমরা যেন সময়ের দিকে লক্ষ্য রাখি। কেউ যেন কারো দুর্ভোগের কারণ হয়ে না দাঁড়াই। সব কাজে সবাইকে দায়িত্বশীলতা ও মানবিকতার পরিচয় দিতে হবে এটা যেন আমরা মনে রাখি।
লেখক : সাংবাদিক, নির্বাহী পরিচালক, ইসলামী গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ