হাজার বছরের ঐতিহ্য জ্ঞানগরিমায় গর্বিত চট্টগ্রাম। প্রতিকূল পরিবেশ পরিস্থিতি মোকাবিলা করে চট্টগ্রামের মানুষ শিক্ষায় দীক্ষায় অনন্য স্থান দখল করে নিয়েছেন এবং চট্টগ্রামকে করেছেন আলোকিত। চট্টগ্রামের যে সব আলোকিত সন্তান নিজ জ্ঞান ও গরিমায় বিশ্বকে আলোকিত করেছেন তাঁদের অন্যতম কিংবদন্তি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম।
১৯২৯ সালে চট্টগ্রামের পটিয়ায় নুরুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা আবদুর রহমান ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ্ ও মায়ের নাম মোহসেনা বেগম। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। প্রথম নজরুল ইসলাম সাবেক এমপি এবং ছোটজন জহিরুল ইসলাম ছুট্টু ছিলেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ।
১৯৪৫ সালে চট্টগ্রাম মুসলিম হাইস্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। পরে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অবিভক্ত বাংলায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। এরপর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতিতে স্নাতক শ্রেণিতে তিনি ভর্তি হন। প্রথম বর্ষ শেষ করতেই কলকাতায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে তিনি ফিরে আসেন ঢাকায়। ঢাকায় এসে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনুষদে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে লাভ করেছিলেন কালিনারায়ণ বৃত্তি। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর নুরুল ইসলাম পাকিস্তান সরকারের বৃত্তি নিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। চার বছর পর ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে রিডার পদে যোগ দেন। এ বিষয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘হার্ভার্ড থেকে অর্থনীতির ওপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন শেষে ১৯৫৫ সালের মধ্যভাগে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করি। অর্থনীতি বিভাগকে তখন দুটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। প্রথমত, যোগ্য শিক্ষকের প্রচণ্ড অভাব। কারণ, বেশির ভাগ জ্যেষ্ঠ শিক্ষক, যাঁরা হিন্দু ছিলেন, তাঁরা ১৯৪৭ সালে এবং তার পরপরেই ভারতে চলে গিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, পুরানো পাঠ্যসূচি, যেখানে অর্থনীতি বিষয়ক সাম্প্রতিক জ্ঞানের শাখাগুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল না।
আমার প্রথম কাজ ছিল পাঠ্যসূচিকে আধুনিকায়ন করা। আমি সেটা ব্যাপক আকারেই করেছিলাম, বিশেষ করে অর্থনৈতিক তত্ত্বের ক্ষেত্রে (ব্যষ্টিক, সামষ্টিক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য)। জ্যেষ্ঠ শিক্ষক না থাকায় বিএ সম্মান ও এমএ স্নাতকোত্তর উভয় শ্রেণিতেই প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা একটানা পড়াতে হতো। এর মধ্যেই আমাকে পাঠ্যসূচি আধুনিকায়নের কাজ করতে হয়েছিল। সে সময় পড়ানোর দায়িত্ব খুব গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হতো এবং শ্রেণিকক্ষে বক্তৃতা দেওয়ার পাশাপাশি ছোট ছোট দলে ছাত্রছাত্রীদের টিউটরিয়াল ক্লাসও নিতে হতো। ছাত্রছাত্রীদের কাছে একজন শিক্ষকের বিধিসম্মত নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে এই কাজকে বিবেচনা করা হতো।
স্বাধীনতা–উত্তর পরিকল্পনা কমিশনে যখন আমি আর্থিক ব্যবস্থা ও বাজেট প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করছিলাম, তখন এই অভিজ্ঞতা খুবই কাজে লেগেছিল। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এ সময়ে আমি পূর্ব পাকিস্তানের নির্ধারিত কিছু বৃহদাকার শিল্পকারখানায় শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ায় যুক্ত ছিলাম। এ জন্য আমাকে সর্বনিম্ন মজুরির অর্থনীতির ওপর পড়াশোনা করতে হয়েছিল এবং কিছু উন্নয়নশীল দেশের অভিজ্ঞতা থেকেও শিক্ষা নিতে হয়েছিল।’ [প্রথম আলো ১০ মে ২০২৩]
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় তিনি নিয়োজিত ছিলেন ১৯৫৫ হতে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত। শিক্ষকতা, পরিকল্পনা কমিশন গড়ে তোলা এবং দেশি–বিদেশী সংস্থায় গবেষণা এই তিন পর্বে তাঁর কর্মজীবন বিভক্ত হলেও শিক্ষকতা পেশাটি তাঁর কর্মজীবন বিভক্ত হলেও শিক্ষকতা পেশাটি তাঁর কাছে সবচেয়ে প্রিয়। শিক্ষকতা পেশায় থাকা অবস্থায় অধ্যাপক নুরুল ইসলাম নানা ধরনের কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫৬ সালের আগস্টে অনুষ্ঠিত অর্থনীতিবিদদের সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে যোগ দেন ড. এম টি হক, এ সাদেক, আব্দুর রাজ্জাক, আবদুল্লাহ ফারুক ও নুরুল ইসলাম। ওই সম্মেলনে তাঁরা প্রথম দ্বৈত অর্থনীতির ধারণা উত্থাপন করেন।
১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক্স (পিআইডিই)। সেখানে প্রধান হিসেবে ১৯৬৫ সালে যোগ দেন অধ্যাপক নুরুল ইসলাম। এ প্রতিষ্ঠানের গবেষণাকর্মের মাধ্যমে পূর্ব–পশ্চিমের বৈষম্য আরও স্পষ্ট হয়। ১৯৬৯ সালে গণ–অভ্যূত্থানে আইয়ুব খান বিদায় নেওয়ার পর তিনি ছয় দফা অর্থনৈতিক রূপরেখা প্রণয়নে সহায়তা করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরামর্শে ছয় দফা বাস্তবায়নের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নিয়েও কাজ করেন তিনি। এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন আরও কয়েকজন অর্থনীতিবিদ।
৭০ এর নির্বাচনে জয়ের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা ভিত্তিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা তৈরির জন্য অর্থনীতিবিদদের নিয়ে যে প্যানেল করেছিলেন, তার প্রধানও ছিলেন তিনি। এই পরিকল্পনা তৈরির সময় নিয়মিত বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে তাঁদের নিয়মিত বৈঠক হতো। এক পর্যায়ে নুরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ছয় দফার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা করলে তো এক পাকিস্তান থাকে না। জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ছয় দফার ভিত্তিতেই পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।
১৯৭১ সালের মার্চে মুজিব–ইয়াহিয়া বৈঠকেও সেই রূপরেখা পেশ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর এপ্রিলের শুরুতে তিনি আগরতলা হয়ে দিল্লিতে যান। সেখান থেকে নুরুল ইসলাম যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে এক বছরের জন্য নিয়োগ পান তিনি। বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য দেন তিনি। নিক্সন প্রশাসন প্রচণ্ডভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করলেও শিক্ষাবিদ ও জনপ্রতিনিধিদের সমর্থন তাঁরা পান। স্বাধীনতার পরপরই তিনি দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে চট্টগ্রামে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করে ঢাকায় এসেই শুনতে পেলেন, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে থেকে মুক্তি পাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করলে তাঁকে পরিকল্পনা কমিশনের দায়িত্ব নিতে বলা হয়। বঙ্গবন্ধুর কথায় নুরুল ইসলাম কাজে লেগে পড়লেন। একটি নতুন ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ খুবই কঠিন কাজ হলেও সানন্দে তাঁরা সেই চ্যালেঞ্জ নিলেন। তাঁরা প্রথমে দুই বছরের জন্য একটি পুনর্বাসন কর্মসূচি নিলেন ১৯৭২–৭৩ অর্থবছরে। এরপর পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করলেন (১৯৭৩–৭৮)।
১৯৭৫ সালে মার্চ–এপ্রিলের দিকে ছুটি নিয়ে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম দেশের বাইরে যান। এর মধ্যে ঘটে যায় ১৫ আগস্টের হৃদয়বিদারক ঘটনা। একদল বিপথগামী সেনাসদস্যের হাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। নুরুল ইসলামের আর দেশে ফেরা হলো না।
দেশে–বিদেশে অধ্যাপক নুরুল ইসলামের ২৫টির বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রথমা প্রকাশন থেকে তাঁর চারটি বই প্রকাশিত হয়েছে। এগুলো হলো করাপশন, ইস কন্ট্রোল অ্যান্ড ড্রাইভারস অব চেঞ্জ: দ্য কেস অব বাংলাদেশ (২০১৬), অ্যান ওডেসি : দ্য জার্নি অব মাই লাইফ (২০১৭), ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ : আ প্রাইমার অব পলিটিক্যাল হিষ্ট্রি (২০১৯) এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : কাছে থেকে দেখা (২০২০)।
অধ্যাপক নুরুল ইসলাম মৃত্যুর আগপর্যন্ত খাদ্যনীতিবিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) ইমেরিটাস ফেলো হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৮৭ সালে তিনি সংস্থাটির মহাপরিচালকের জ্যেষ্ঠ নীতি পরামর্শক হিসেবে যোগ দেন। সুদীর্ঘ কর্মজীবনে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) অর্থনীতি ও সামাজিক নীতি বিভাগের সহকারী মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া তিনি আজকের বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) প্রথমে চেয়ারম্যান ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগেও অধ্যাপনা করেন তিনি। তাছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ভিজিটিং একাডেমিক পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো উয়েল, অক্সফোর্ড কেমব্রিজ এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস্।
বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে কৃতিত্বের সাথে কাজ করেছেন। তিনি কর্মজীবনের শেষটা অনেকটা স্বেচ্ছানির্বাসনে থাকলেও প্রতিনিয়ত দেশের উন্নতির জন্য কতটা ভাবতেন, উদ্বিগ্ন থাকতেন। যখনই সুযোগ পেয়েছেন, দেশের নীতিনির্ধারকদের গঠনমূলক পরামর্শ দিতে বা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের স্বার্থে ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। সভা–সেমিনারে যেকোনো মঞ্চে আমন্ত্রণ পেলেই দেশে ছুটে এসেছেন, স্বাস্থ্যগত বা অন্য নানা বাধা উপেক্ষা করে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর এ দেশে তাঁর যথাযথ মূল্যায়ন আর কখনোই করা হয়নি।
পাঁচ বছর আগে ঢাকায় নুরুল ইসলামের আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘অ্যান অডিসি জার্নি অব মাই লাইফ’ এর প্রকাশনা অনুষ্ঠানে রেহমান সোবহান বলেছিলেন, ‘নুরুল ইসলাম একজন পরিপূর্ণ অর্থনীতিবিদ। আমি মনে করি, বাংলাদেশের অমর্ত্য সেন হতে না পারার কোনো কারণ তাঁর ছিল না।’ অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদও সেই অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘আমি উনাকে দেখি আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত দেশের প্রধান অর্থনীতিবিদ হিসেবে।’ [দৈনিক আজাদী ১০ মে ২০২৩]
তিনি বলতেন ‘সরকার আগ্রহ না দেখালে নিজে থেকে পরামর্শ দিতে যাবে না’ তাহলে মনে করবে তুমি পদ–পদবি চাইছ। এই কথাগুলো ছিল তাঁর অভিমানের বহিঃপ্রকাশ। এ ভাবেই লোক চক্ষুর আড়ালে চিরতরেই চলে গেলেন আমাদের চট্টগ্রামের গর্ব আলোকিত কিংবদন্তি অর্থনীতিবিদ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠজন অধ্যাপক নুরুল ইসলাম। অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলাম নিজের কাজ ও সাধনার মাঝে বেঁচে থাকবেন। তাঁর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সম্পাদক–শিল্পশৈলী