গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ ও বর্তমান বাস্তবতা

মো. দিদারুল আলম | সোমবার , ২৯ মে, ২০২৩ at ৪:৫০ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশে বর্তমানে গ্রামীণ পর্যায়ে স্থানীয় সরকারের ৩ টি স্তর ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদ। এ তিনটি স্তর ও আরবান পর্যায়ের স্থানীয় সরকারের নিম্নতর স্তর পৌরসভার জনপ্রতিনিধিদের নিকট জনসাধারণ প্রায় পুকুর বা দিঘির পাড়ে সড়ক, কবরস্থান, শ্মশান, মসজিদ, মন্দির, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, এতিমখানা, ঈদগাহ ইত্যাদির ভাঙ্গন প্রতিরোধের জন্য রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণের আবেদন করে থাকে। এ আবেদনের সংখ্যা বর্তমানে গ্রামীণ সড়ক উন্নয়নের জন্য প্রাপ্ত আবেদনের সংখ্যার চেয়ে বেশি বৈ কম নয়। উপজেলা পরিষদের মাসিক সমন্বয় সভায় এলজিইডির প্রকৌশলীরা এর কারণ হিসেবে বর্তমানে পুকুর ও দিঘিতে রাক্ষুসে মাছ চাষ করাকে বেশি দায়ী করতে দেখা যায়। তারা এ ধরনের রাক্ষুসে মাছ চাষের ক্ষেত্রে পুকুর বা দিঘির চার পাড়ে বেড়া বা অন্য কোনো প্রতিবন্ধক দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ প্রকল্পসমূহকে আবার অনেক সময় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ গাইড ওয়াল নির্মাণ প্রকল্প নামেও গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করে থাকে। তবে আমাদের জেলা পরিষদের প্রকৌশলীদের নিকট রিটেইনিং ওয়াল ও গাইড ওয়ালের পার্থক্য জিজ্ঞেস করাতে তারা সহজ বাংলায় আমাকে বিষয়টি বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হন নি। তারপরও আমাদের নির্বাহী প্রকৌশলী যা বললেন তা হলো গাইড ওয়াল একটি রাস্তাকে গাইড করে নিয়ে যায় আর রিটেইনিং ওয়াল মূলত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে মাটি, পাথর, কোনো সড়ক বা পুকুরের পাড়কে রিটেইন করে। তবে দুটির নির্মাণ শৈলীতে সাধারণভাবে আমার কাছে খুব বেশি পার্থক্য দৃষ্টিগোচর হয়নি যদিও অভিজ্ঞ প্রকৌশলীরা পার্থক্যগুলো আরো বেশি সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করতে পারবেন।

স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ হতে গৃহীত রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণের প্রকল্পসমূহ অধিকাংশ (গৃহীত প্রকল্পের আর্থিক বরাদ্দের সর্বোচ্চ ৫০%) ক্ষেত্রে প্রকল্প কমিটির মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়। জেলা পরিষদ এ ক্ষেত্রে ৩ লক্ষ টাকার অধিক বরাদ্দের প্রকল্প বাস্তবায়ন টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পাদনের মাধ্যমে করে থাকে। এলাকাবাসীরা যখন রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণের আবেদন করেন তখন মৌখিকভাবে একটি কথা প্রায় বলে থাকেন ‘আপনারা একটি প্রকল্প বরাদ্দ করে যতটুকু করা যায় করে দেন বাকি অংশ আমরা নিজেদের টাকায় অথবা পুকুর বা দিঘির মাছ বিক্রির টাকায় করে ফেলব’। কিন্তু অভিজ্ঞতায় দেখেছি এ প্রকল্প বাস্তবায়নে এলাকাবাসীর তেমন কোনো আর্থিক অংশগ্রহণ থাকে না এমনকি পুকুর বা দিঘির মাছ বিক্রির সময় কেউ কেউ মাছ বিক্রির টাকায় রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণের প্রস্তাব করলেও অধিকাংশ লোকজন এ প্রস্তাবে ভেটো প্রদান করে থাকে। এ সব কারণে বাস্তবে স্থানীয় জনসাধারণের অংশগ্রহণে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের বরাদ্দের অতিরিক্ত কাজ খুব কম ক্ষেত্রে সম্পন্ন হয়।

রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গেলে প্রথমেই প্রয়োজন হয় পুকুর বা দিঘির পানি সেচের। পানি সেচ দিতে গেলেই গ্রামের মানুষের নিত্য ব্যবহারের পানি নিয়ে সংকট তৈরি হয়। সাধারণত বর্ষাকালে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। পুকুরের মালিকানা নিয়ে বিরোধ প্রকাশ্যে চলে আসে। রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে নতুন করে মামলা মোকদ্দমা রুজু হওয়ার সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। অনেক সময় দেখা যায় পুকুরে জলের মালিক এক পক্ষ আবার পাড়ের মালিক অন্য পক্ষ। প্রাপ্ত বরাদ্দ দিয়ে সবার আগে কোন পাড়ে কাজ ধরবে তা নিয়েও চলে নানা যুক্তি তর্ক। তবে একটি লক্ষণীয় বিষয় হলো প্রকল্পটি সমাপ্ত হওয়ার সাথে সাথে দীর্ঘদিনের মালিকানা সংক্রান্ত বিরোধও অনেক ক্ষেত্রে নিষ্পত্তি হয়ে যায়।

সাধারণত প্রতি ১ লক্ষ টাকায় সেকশন করে কত মিটার রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করা যাবে তা নির্ভর করে সেকশনের বেড়ের দৈর্ঘ্য ও মোট উচ্চতার উপর। আবার প্রতি ১ লক্ষ টাকায় সিসি বা আরসিসি দ্বারা সড়ক উন্নয়ন করলে প্রতি লক্ষ টাকার রিটেইনিং ওয়ালের চেয়ে অধিক দৈর্ঘ্যের কাজ সম্পন্ন করা যায়। তাছাড়া সড়ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিদ্যমান রাস্তার স্যালভেজ মেটেরিয়ালগুলো ব্যবহার করলে সড়কের দৈর্ঘ্য আরো বাড়ানো সম্ভব হয় বরাদ্দ সীমাবদ্ধ রেখে। তুলনামূলকভাবে সড়ক উন্নয়নের প্রকল্প রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ প্রকল্পের চেয়ে বেশি দৃশ্যমান হয়ে থাকে। এরপরও টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণের প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে।

জেলা পরিষদে কর্মরত প্রকৌশলীরা রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণের সময় প্রতি ১.৫ মিটার অন্তর ঐড়ৎরুড়হঃধষ ধহফ াবৎঃরপধষষু বিবঢ় যড়ষব রাখার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। ডববঢ় যড়ষব দেয়ার সময় পুকুর পাড়ের প্রান্তে এক ধরনের চুড়ি বা পাইপ ব্যবহার করা হয় যাতে বৃষ্টির পানি সহজেই মাটি চুইয়ে চুড়ি বা পাইপের সাহায্যে বিবঢ় যড়ষব দিয়ে বের হয়ে পুকুরের দিকে যেতে পারে। এর ফলে রিটেইনিং ওয়ালের পক্ষে মাটির প্রেসার নেওয়া সহজ হয়। রিটেইনিং ওয়ালের মধ্যে প্রতি ৬ মিটার অন্তর ১ ইঞ্চি পরিমাণ এক্সপানশন জয়েন্ট রাখা হয় যাতে অতিরিক্ত তাপের কারণে রিটেইনিং ওয়ালটি সম্প্রসারণের সুযোগ পায়। আবার কোনো কারণে ওয়াল ভেঙে পড়লে এ এক্সপানশন জয়েন্টগুলো রাখার কারণে শুধুমাত্র একটি সেকশনের ক্ষতি হয়ে থাকে। পরবর্তীতে শুধুমাত্র এ সেকশনটি নতুনভাবে মেরামত বা নির্মাণ করে পুরো ওয়ালটি রক্ষা করা সম্ভব হয়। একাধিক সেকশন করার কারণে মাটি ধরে রাখার সুবিধাও অনেক বেশি হয়। সাধারণত পুকুরের গভীরতার (ইঞ্চিতে) হিসেব করে তার ৬০% এ যত ইঞ্চি হয় সর্বনিম্নের সেকশনটির বেড় তত দিয়ে পুকুরের গভীর হতে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ শুরু করা হয়। আবার স্থানীয় লোকজন সে হিসাবটি রদ্দা হিসেবে করে থাকে। তারা সাধারণত হিসেব করে কোন সেকশনে কত রদ্দা দিতে হবে। বর্তমানে ইটের সাইজ পরিমিত মাপের না হওয়াতে রিটেইনিং ওয়ালের উচ্চতা প্রত্যাশিত মাপের চেয়ে কিছুটা কমে যেতেও দেখা যায়। সাধারণত পুকুরের গভীরতা বেশি হলে, ভারী যানবাহনের চাপ থাকলে সেকশনের মাধ্যমে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ প্রকৌশলীদের প্রথম পছন্দ। অন্যান্য ক্ষেত্রে তারা প্যালা ওয়াল নির্মাণ করার পরামর্শ প্রদান করে থাকেন। কম বরাদ্দে প্যালা ওয়াল নির্মাণ করলে অপেক্ষাকৃত বেশি দৈর্ঘ্যের ওয়াল নির্মাণ সম্ভব হয়।

আমাদের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রায় দুঃখ করে বলেন গ্রামগঞ্জে এখন প্রকৌশলীর সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে যারা কখনো প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পা মাড়ায় নি। স্থানীয় সরকারের যে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গেলে এসব স্থানীয় ইঞ্জিনিয়াররা তাদের কারিগরি মতামত দিতে শুরু করেন। এদের কারিগরি মতামতের কারণেই আমাদের অভিজ্ঞ নির্বাহী প্রকৗশলী নিজের কারিগরি জ্ঞান নিয়ে মাঝে মাঝে সন্দেহ পোষণ করে থাকেন। তিনি সেকশনের মাধ্যমে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণের পরামর্শ প্রদান করলেও স্থানীয় জনসাধারণ আরো ভালো করার জন্য আরসিসি দ্বারা গ্রেড বিমের মাধ্যমে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণের প্রকল্প বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। এতে খরচ বাড়ে কিন্তু রিটেইনিং ওয়ালটি টেকসই হয় একথা বলা যায় না। অথচ সেকশন দ্বারা রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করে চট্টগ্রাম শহরের টাইগার পাসের দ্বিতল সড়কটি আবহমান কাল থেকে এত এত ভারী ভারী যানবাহনের লোড নিয়ে টিকে আছে। সেকশন করে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণের পক্ষে এই সড়কটি একটি যুৎসই উদাহরণ হিসেবে চট্টগ্রামবাসী গ্রহণ করতে পারে। আমাদের প্রকৌশলীরা প্রায় ক্ষেত্রে এ উদাহরণটি দিয়ে জনসাধারণকে বুঝিয়ে থাকেন। এ স্থানীয় ইঞ্জিনিয়াররা মাঝে মাঝে এমনও ঘটনা ঘটিয়ে থাকেন রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ সমাপ্ত হওয়ার সাথে সাথে মাটি ভরাট করে দিয়ে থাকেন। এ মাটির প্রেসারে রিটেইনিং ওয়াল ধ্বসে পড়ার মতো ঘটনাও প্রায় ঘটে থাকে। আমাদের প্রকৌশলীরা রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ সমাপ্ত হওয়ায় পর পর্যাপ্ত কিউরিং এবং নির্দিষ্ট মাত্রার শক্তি অর্জন করার পর মাটি ভরাটের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

জেলা পরিষদের কাজের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় এ ধরনের প্রকল্পগুলো সাধারণত প্রতিষ্ঠানসমূহের বিদ্যমান কমিটির অনুরোধে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। প্রথমে প্রাপ্ত আবেদনসমূহ হতে প্রকল্পসমূহ বাছাই করে জেলা পরিষদের সভায় অনুমোদনের পর স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ হতে চূড়ান্ত অনুমোদন গ্রহণ করতে হয়। এ প্রক্রিয়াগুলো সম্পাদিত হতে কিছুটা সময় লেগে যায়, এ সময়ের মধ্যে অনেক সময় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটির পরিবর্তন হয়। প্রকল্প কমিটি পরিবর্তিত হওয়ার ফলে শুরু হয় নতুন বিপত্তি। সাধারণত পূর্বের কমিটির সাথে নতুন কমিটির প্রায় ক্ষেত্রে বিরোধ থাকে। পূর্বের কমিটি তাদের সময়ে গৃহীত প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্প কমিটি গঠন ও আনুষঙ্গিক কাজসমূহ সম্পাদনের জন্য জেলা পরিষদের সাথে আর যোগাযোগ রক্ষা করেন না। জেলা পরিষদের অনেক প্রকল্পের চাপে এ ধরনের কিছু কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে পড়ে। এত কিছুর পরও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার ‘আমার গ্রাম, আমার শহর’ বাস্তবায়ন এবং গ্রামীণ অবকাঠামোর টেকসই উন্নয়নে গ্রামের জনসাধারণকে নিজেদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থসমূহ ত্যাগ করে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ হতে গৃহীত প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নে এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক; নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা পরিষদ, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅধ্যাপক নুরুল ইসলাম পরিপূর্ণ অর্থনীতিবিদ
পরবর্তী নিবন্ধদ্বিতীয় গানেও নজর কাড়লেন অধরা