পাহাড়, সমুদ্র, উপত্যকাময় বাংলার বায়ু অত্যন্ত নির্মল ও চমৎকার নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া। বাংলার এহেন অপরূপ রূপ আর সমৃদ্ধিতে আকৃষ্ট হয়ে ব্রিটিশ বেনিয়ারা এদেশে বাণিজ্য করতে আসে। কিন্তু, লোভাতুর এ বেনিয়া গোষ্ঠী ছলে বলে কৌশলে বাংলার শাসনভার নিজেদের হাতে তুলে নেয়। দুইশ বছরের নিঠুর শাসনে ব্রিটিশ বেনিয়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাসহ সারা ভারতবর্ষের মানুষের পায়ে দাসত্বের শৃঙ্খল পরিয়ে রেখেছিল।
বঙ্গবন্ধুর অসীম ত্যাগ, আপোষহীন বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক হয়ে ওঠেছিল। তাই, ৭০’র নির্বাচনে বাংলার মানুষ নৌকা প্রতীকে বঙ্গবন্ধুকে ভোট দিয়েছিল। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানের রাখা ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন এবং ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
এরপর ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরস্ত্র ঘুমন্ত বাঙালির উপর হামলা ও নারকীয় তাণ্ডব চালিয়ে ব্যাপক গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ চালিয়ে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং পশ্চিমা হানাদারদের প্রতিরোধে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে বাংলার মানুষকে আহ্বান জানান, শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদ আর আড়াই লক্ষ মা–বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে পাকিস্তানি নরপিশাচদের হটিয়ে বাঙালি ১৬ ডিসেম্বর বিজয় কেতন উড়িয়েছিল। যার মহমন্ত্রে বাঙালি জাতীয়তাবাদে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাংলার সাড়ে সাত কোটি জনতা মরণ–পণ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিল, সেই মহান জাতির পিতা তখনো পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী। নানা প্রেক্ষাপটের পর অবশেষে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাঙালির প্রাণের মানুষ, প্রাণের নেতা বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন বাংলায় প্রত্যাবর্তন করেন। এই ১৯৭২ সালেই অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ পরিচালনার জন্য একটি শক্তিশালী ও মননশীল সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন। এই সংবিধানের ভিত্তিতে তিনি যখন যুদ্ধ বিধ্বস্ত পোড়ামাটি ও ধ্বংসস্তুপ থেকে ফিনিঙ পাখির মতো গা ঝাড়া দিয়ে দেশকে উন্নয়নশীলতার দিকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন স্বাধীনতা শত্রু একাত্তরের পরাজিত শক্তি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নানামুখী ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে থাকে। স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা ও জয়রথ থামাতে না পেরে স্বার্থলোভী ও চাকুরিচ্যুত কতিপয় সেনা অফিসারকে দিয়ে ক্যু রচনা করে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। ভাগ্যক্রমে, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে স্বামীর কর্মস্থল পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করায় সেদিন বেঁচে যান। কালবৈশাখীর প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়া, বৃষ্টি ও দুর্যোগকে তোয়াক্কা না করে সেদিন স্বাধীনতার সপক্ষের গণতন্ত্রকামী লাখ লাখ মানুষের মিছিল গিয়ে জড়ো হয়েছিল কুর্মিটোলায়। কুর্মিটোলা থেকে শেরে বাংলা নগরের জনসমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ স্বাধীনতার অমর শ্লোগান ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে গর্জন তুলে প্রকম্পিত করেছিল বাংলার আকাশ বাতস। লাখো কণ্ঠে ঘোষিত হয়েছিল ‘পিতৃহত্যার বদলা নিতে/লক্ষ ভাই বেঁচে আছে, শেখ হাসিনার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই।’
দেশের মাটিতে পা দিয়ে লক্ষ লক্ষ জনতার সংবর্ধনায় আপ্লুত শেখ হাসিনা সেদিন বলেছিলেন, ‘সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির পিতা হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই’।
১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বৈরাচারী সামরিক জিয়া সরকারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশে না ফিরলে, স্বৈরাচারী দালাল সরকারদের পৃষ্ঠপোষকতায় বার বার সংঘটিত ন্যক্কারজনক হত্যা চেষ্টায় দমিত না হয়ে, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দেশের মানুষকে সাথে নিয়ে কাজ না করলে দেশ তাঁর স্বাধীনতার উদ্দেশ্য পূরণের বিপরীতে একাত্তরের পরাজিত শক্তি ও পাকিস্তানের তাবেদারী করতে করতে অন্ধকারে নিমজ্জিত থেকে যেত। শেখ হাসিনা ফিরে এসেছিলেন বলেই আওয়ামী লীগ দল হিসেবে শক্তিশালী অবস্থানে ফিরতে পেরেছে, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের এই দিনে আমাদের কামনা– তিনি যেন দীর্ঘজীবী হোন, নিরোগ হোন।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয়তু শেখ হাসিনা, বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, সিডিএ ও কোষাধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ