আজ ৮ই মে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। প্রতি বছরের মত এ বছরও সারা বিশ্বে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুদের জন্য এ দিবস আনন্দের সাথে পালিত হয়। এ বৎসরের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে-“Be Aware, Share Care: Strengthening Education to Bridge the Thalassaemia Care Gap” অর্থ্যাৎ থ্যালাসেমিয়া রোগীর সেবা মাঝে কোন প্রকার বৈষম্য বন্ধে প্রয়োজনীয় শিক্ষা দরকার। এর জন্য সতর্ক অংশীদারত্ব ও সেবার প্রয়োজন। এ দিনে থ্যালাসেমিয়া রোগী, রোগীর অভিভাবক, চিকিৎসক সমাজ, নার্সিং প্রফেশনাল, সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ও সর্বোপরি মিডিয়া সকলে মিলে এ সমস্ত রোগীর সেবাদানে যে সমস্ত ফাঁক ফোকর আছে তা বন্ধ করতে সবাইকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা নিতে হবে। এটা কেবল পুথিগত শিক্ষা নয়। সেবা দানের ক্ষেত্রে আর্থ সামাজিক দিকটাও খেয়াল রাখতে হবে। ১৯৯৪ সাল থেকে থ্যালাসেমিয়া ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন প্রতি বৎসর ৮ই মে এ দিবস পালন করার জন্য সকলকে আহবান করে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে সকল দেশের সরকার, সামাজিক প্রতিষ্ঠান অভিভাবক সংস্থা, চিকিৎসক সমাজ ও শিল্পপতিদের থ্যালাসেমিয়া রোগীদের কল্যাণার্থে এগিয়ে আসার উদাত্ত আহবান। এখন কেবল থ্যালাসেমিয়াকে রক্ত দিলে হবে না, সে সাথে রক্তের ধরণ, পরিমাণ, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সব কিছু দেখতে হবে। সর্বোপরি এ সব রোগীকে সাধারণ মানুষ হিসাবে গণ্য করে সর্বক্ষেত্রে সমান অধিকার ও সুযোগ দিতে হবে।
এ বৎসর আমার সুযোগ হয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন-“Overview of Thalassaemia in Bangladesh” বিষয়ে একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করার। এশিয়া মহাদেশের অনেক দেশ যেমন কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, থ্যাইল্যান্ডের এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞগণ তাদের দেশের থ্যালাসেমিয়া পরিস্থিতি নিয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন। তবে আমরা তাদের থেকে অনেক পিছিয়ে আছি। এদিকে আমরা সৌভাগ্য হয়েছিল থ্যালাসেমিয়ার উপর থ্যাইল্যান্ডের মাহিদুল বিশ্ববিদ্যালয়ের রক্ত রোগ বিভাগের প্রধান প্রফেসর ইমিরেটাস ডা: সুটাথের সাথে একসাথে গবেষণা করার। কিছু কিছু রোগীর জেনিটিক প্রোফাইল তৈরী করে তা উপস্থাপন করেছি। তবে এ রোগ সারা বাংলাদেশে জালের মত জড়িয়ে আছে। আমরা জানি না কে এ থ্যালাসেমিয়ার বাহক। বিবাহের পূর্বে থ্যালাসেমিয়া বাহক নির্ণয় করা জরুরি। তবে এ পরীক্ষা ব্যায়বহুল এবং তা কয়েকটি জেলায় করা হয়। অথচ পাশের দেশ ভারতের পশ্চিম বাংলায় প্রতিটি জেলা হাসপাতালে এ পরীক্ষা করা হয়।
তবে বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা অপ্রতুল। বিশেষ করে বড় বড় শহরে যেমন ঢাকা বা চট্টগ্রামে কিছুটা সঠিক চিকিৎসা হলেও জেলা শহরে এ অবস্থা ভীষণ করুণ। রোগীদের কোনো ফলোআপ নেই। কখন রক্ত নেয়ার জন্য আসবে বা কত ব্যাগ রক্ত দিবে তা আগে থেকে নির্ধারণ করা হয় না। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা রোগীকে সমস্ত খরচ বহন করতে হয়। বিশেষ ক্ষেত্রে হাসপাতালে ডাক্তার সাহেব দরিদ্র তহবিল থেকে কিছুটা ফান্ডের ব্যবস্থা করে। সরকার বা হাসপাতাল থেকে কোনো ব্যবস্থা নেই। বেসরকারি পর্যায়ে রক্ত সঞ্চালনের ব্যবস্থা করা দরকার। আমি কক্সবাজারে কয়েকবার থ্যালাসেমিয়া রোগীর জন্য চিকিৎসা ক্যাম্প করেছিলাম। ওখানকার অবস্থা ভয়াবহ। এমনিতে ভৌগোলিক অবস্থার কারণে কক্সবাজারে রোগীর সংখ্যা বেশী, সবাই রক্ত শূন্যতায় ভুগছে। পেটে বড় বড় দলা অর্থাৎ লিভার ও প্লীহা বড় হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রামে অতীব জরুরি। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১০ হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে। এটি একটি জনসমস্যায় পরিণত হবে। এজন্য দরকার বাহক যাচাই কর্মসূচি। উন্নত বিশ্বের গর্ভকালীন পেটের জরায়ু থেকে রক্ত পরীক্ষা করে দেখা হয়।
যদি আগত শিশুর থ্যালাসেমিয়া রোগ হবার আশংকা থাকে তাহলে ঐ যুগলকে গর্ভপাতের উপদেশ দেয়া হয় অথবা থ্যালাসেমিয়া শিশু সারা জীবন রক্ত দেয়ার জন্য তৈরী থাকতে হবে। বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়া রোগীর কল্যাণে সরকারী পর্যায়ে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। প্রথমত থ্যালাসেমিয়া রোগীর জন্ম নিরুৎসাহিত করতে হবে এবং দ্বিতীয়ত যারা থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে তাদের দ্রুত শনাক্ত করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন ও প্রকার ভেদে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রক্ত নেয়ার জন্য আসতে হবে। রক্ত সঞ্চালন বিনামূল্যে বা কম খরচে করতে হবে। প্রয়োজনে ল্যাবরেটরী পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে যাতে কোনো জটিলতা দেখা যাচ্ছে কিনা। কিন্তু কিছু ওষুধ সারাজীবন খেতে হয় যেমন– ফলিক এসিড, ভিটামিন ডি ও ই। রোগীকে নানাবিধ রোগ থেকে দূরে থাকতে হবে কারণ কোন রোগ হলে রক্তের হিমোগ্লোবিন কমে যাবে। আমি ২০০৮ সালে ব্রাজিলের সাপালো শহরে একটি থ্যালাসেমিয়া সেমিনারে গিয়েছিলাম ওখানকার সিটি কর্পোরেশন থ্যালাসেমিয়া রোগীদের বিনামূল্যে সমস্ত সেবা দিয়ে থাকে।
সিউল কনফারেন্স এ বৎসর মার্চ মাসের ৩০ তারিখ থেকে ১লা এপ্রিল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে আমার স্ত্রী ডা: রাজিয়া সুলতানা উপস্থিত ছিল। সম্মেলনে এশিয়ার অনেক নামকরা রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ উপস্থিত ছিলেন। তাদের উপস্থাপনা ছিল অনেক ক্ষেত্রে গবেষণামূলক জেনিটিক পর্যায়ে। বাংলাদেশ থেকে আমিই একমাত্র প্রবন্ধ উপস্থাপন করি। এজন্য আমি নিজেকে ধন্য বা গর্বিত মনে করছি। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের নিয়ে আমার দীর্ঘ ২০ বৎসর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল হিসাবে আমার এই সাফল্য। আমি বাংলাদেশ তথা চট্টগ্রামের সকল থ্যালাসেমিয়া রোগীকে উৎসর্গ করছি।
লেখক : শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, প্রধান ফিজিশিয়ান থ্যালাসেমিয়া সেবা কেন্দ্র