ভ্রাম্যমাণ আদালত জব্দ করেছে ৫০ লাখ ঘনফুট বালু। নিলামে বিক্রি করা হয়েছে মাত্র ২৫ লাখ ঘনফুট। বাকি ২৫ লাখ ঘনফুট বালুর আর কোনো হিসাব নাই। এভাবে সাতকানিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২৫ লাখ ঘনফুট বালুর গায়েব হয়ে যাওয়া নিয়ে জনমনে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। সাতকানিয়া উপজেলার চরতি ইউনিয়নের দক্ষিণ ব্রাক্ষ্মনডেঙ্গা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
এছাড়া প্রথম নিলাম বিজ্ঞপ্তিতে প্রতি ঘনফুট বালুর মূল্য ধরা হয়েছিল পাঁচ টাকা। আর তৃতীয় দফায় নিলাম বিজ্ঞপ্তিতে ঘনফুট প্রতি মূল্য ধরা হয়েছে মাত্র ১ টাকা। এখন সবার প্রশ্ন ২৫ লাখ ঘনফুট বালু গেল কোথায়? আর প্রতি ঘনফুট বালুর মূল্য ৫ টাকা থেকে ১ টাকায় কেন আসল?
প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে ৫ টাকা মূল্যে ক্রেতা না পাওয়ায় এক টাকা করা হয়েছে। আর জব্দকৃত বালু থেকে কিছু বালু চুরি হয়ে গেছে। তবে এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, বালু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে প্রথম দুই বারের নিলামে ইচ্ছা করে কম মূল্যে দরপত্র জমা দিয়েছে। মূল্য কমিয়ে দরপত্র আহ্বান করায় সিন্ডিকেট করা বালু ব্যবসায়ীরা লাভবান হয়েছে।
জানা যায়, পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক সাতকানিয়ার সাঙ্গু ও ডলুনদীর তীর সংরক্ষণ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ড্রেজার যন্ত্র দ্বারা উত্তোলিত বালু নদীর তীরবর্তী বিভিন্ন এলাকায় স্তূপ করে রাখা হয়। চরতির দক্ষিণ ব্রাক্ষ্মনডেঙ্গা এলাকায় স্তূপকৃত বালু থেকে সংঘবদ্ধ একটি চক্র চুরি করে বালু বিক্রি করে আসছিল। খবর পেয়ে গত ১৪ মার্চ চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক দত্তের নেতৃত্বে সেখানে অভিযান চালানো হয়। অভিযানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজনও উপস্থিত ছিলেন। এসময় অবৈধভাবে বালু বিক্রি করার সময় সৈকত দাশ নামের একজনকে আটক করে ৭ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। একই সাথে ১ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। এসময় ওই স্তূপে থাকা ৫০ লাখ ঘনফুট বালু জব্দ করা হয়েছে বলে গণমাধ্যমকর্মীদেরকে জানিয়েছিল সংশ্লিষ্ট প্রশাসন।
এদিকে বালু নিলামে বিক্রির জন্য সাতকানিয়ার সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরাফাত সিদ্দিকীকে আহ্বায়ক ও পানি উন্নয়ন বোর্ড, পটিয়ার উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী অপু দেবকে সদস্য সচিব করে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে দেয়া হয়। উক্ত কমিটির প্রধান ও সাতকানিয়ার সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরাফাত সিদ্দিকী বালু বিক্রির জন্য দরপত্র আহ্বান করে ৪ এপ্রিল একটি নোটিশ প্রচার করেন। ১৪ মার্চ ৫০ লাখ ঘনফুট বালু জব্দ করা হয়েছে বললেও ৪ এপ্রিলে প্রচারকৃত নোটিশে বালুর পরিমাণ উল্লেখ করা হয় ৪০ লাখ ঘনফুট। বালুর মূল্য উল্লেখ করা হয়েছে ঘনফুট প্রতি ৫ টাকা। গত ১৩ এপ্রিলে অনুষ্ঠিত ওই নিলামে ৪ জন দরপত্র জমা দেন। দরপত্র জমাদানকারীদের মধ্যে সর্বোচ্চ দরদাতা হলো ২৫ লাখ ১ হাজার টাকা। কাঙ্ক্ষিত মূল্য না পাওয়ায় সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরাফাত সিদ্দিকী ১৩ এপ্রিলে পুনরায় দরপত্র আহ্বান করে নোটিশ প্রচার করে এবং ১৮ এপ্রিলে দরপত্র জমা দানের দিন ধার্য্য করেন। দ্বিতীয় দফা নোটিশে বালুর পরিমাণ আরো ১০ লাখ ঘনফুট কমিয়ে ৩০ লাখ ঘনফুট উল্লেখ করা হয়। আর প্রতি ঘনফুট বালুর মূল্য ৫ টাকার পরিবর্তে ২ টাকা চাওয়া হয়। দ্বিতীয় দফা নিলামে ২ জন দরপত্র জমা দেন। দুই জনের মধ্যে সর্বোচ্চ দরদাতা হলো ৩৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা। দ্বিতীয় দফা নিলামেও কাঙ্ক্ষিত মূল্য না পাওয়ায় গত ২৪ এপ্রিল তৃতীয় দফায় দরপত্র আহ্বান করে নোটিশ প্রচার করেন। উক্ত নোটিশ অনুযায়ী গত মঙ্গলবার দরপত্র জমাদানের দিন ধার্য্য ছিল। এতে বালুর পরিমাণ আরো ৫ লাখ ঘনফুট কমিয়ে ২৫ লাখ ঘনফুট করা হয়। প্রতি ঘনফুট বালুর মূল্য ১ টাকা চাওয়া হয়। এদিন অনুষ্ঠিত নিলামে সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে মেসার্স হাবিবা বিল্ডার্স নামের এক প্রতিষ্ঠানকে ৫১ লাখ ১০ হাজার টাকা দিয়ে বালু বিক্রি করা হয়।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, মূলত বালুর পরিমাণ ও মূল্য কমানোর জন্য বালু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে প্রথম দুই বারের নিলামে আগ্রহী অনেককে দরপত্র জমা দিতে দেয়নি এবং তারাও কম মূল্যে দরপত্র জমা দিয়েছিল।
বালু নিলাম কমিটির আহ্বায়ক ও সাতকানিয়ার সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরাফাত সিদ্দিকী জানান, ভ্রাম্যমাণ আদালত ৫০ লাখ ঘনফুট বালু জব্দ করা হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন। পরে আমরা নিলাম কমিটির লোকজন প্রাথমিকভাবে পরিমাপ করে ৪০ লাখ ঘনফুট পেয়েছি। সেই অনুযায়ী প্রথম বারে ৪০ লাখ ঘনফুট উল্লেখ করে দরপত্র আহ্বান করেছিলাম। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত দর পাওয়া যায়নি। পরে জানতে পারলাম ওই স্তূপ থেকে কিছু বালু চুরি হয়ে গেছে। এরপর আমরা পুনরায় বালুর স্তূপ পরিদর্শন করি। স্তূপে বালু কমে যাওয়ায় পরের বার ৩০ লাখ ঘনফুট উল্লেখ করে দরপত্র আহ্বান করি। কিন্তু দ্বিতীয় বারেও কাঙ্ক্ষিত দর পাওয়া যায়নি। এরমধ্যে শুনলাম স্তূপে বালুর পরিমাণ আরো কমে গেছে। ফলে তৃতীয় দফায় বালুর পরিমাণ ২৫ লাখ ঘনফুট উল্লেখ করা হয়েছে। বালুর মূল্য প্রথম বারে প্রতি ঘনফুট ৫ টাকা ও দ্বিতীয় বারে ২ টাকা চাওয়া হয়েছিল। তাতে গ্রহণযোগ্য দর না পাওয়ায় সর্বশেষ ১ টাকা চাওয়া হয়। মঙ্গলবার জমাকৃত দরপত্রের মধ্যে সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে ৫১ লাখ ১০ হাজার টাকায় বালু বিক্রি করা হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড, পটিয়ার উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী ও বালু নিলাম কমিটির সচিব অপু দেব জানান, ভ্রাম্যমাণ আদালতের দিন ম্যাজিস্ট্রেট চোখের দেখা অনুযায়ী ৫০ লাখ ঘনফুট বলেছিলেন। পরে আমাদের পরিমাপ অনুযায়ী ৪০ লাখ ঘনফুট হয়। পরিমাপের পর থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত সময়ের মধ্যে স্তূপ থেকে কিছু বালু চুরি করে বিক্রি করে ফেলেছে। ফলে দফায় দফায় বালুর পরিমাণ কম উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া জব্দকৃত একটি স্কেভেটরও চুরি করে নিয়ে গেছে। এখন আমরা জিম্মাদারের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি।