জুম্‌’আর খুতবা

কুরআন ও হাদীসের আলোকে লায়লাতুল কদরের ফযীলত

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ১৪ এপ্রিল, ২০২৩ at ৫:১০ পূর্বাহ্ণ

পবিত্র কুরআনের আলোকে লায়লাতুল কদর:

মহান আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র লায়লাতুল কদর এর মর্যাদা প্রসঙ্গে “আল কদর” নামে একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা নাযিল করেছেন। এরশাদ হয়েছে, “নিশ্চয়ই আমি তা (আল কুরআন) অবতীর্ণ করেছি মহিমান্বিত রজনীতে। তুমি কি জান মহিমান্বিত রজনী কি? মহিমান্বিত রজনী হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। সে রাতে ফেরেস্তাগণ এবং রূহ (জিব্রাইল আ🙂 অবতীর্ণ হন প্রত্যেক কাজে তাদের প্রভূর অনুমতিক্রমে সে, শান্তিইশান্তি সে রজনীতে উষার আবির্ভাব পর্যন্ত।” (সূরা আল কদর)

লায়লাতুল কদর’র অর্থ ও তাৎপর্য:

লায়লাতুল কদর শব্দ দুটি আরবি। লায়লাতুন অর্থ রাত বা রজনী, কদর অর্থ সম্মান মর্যাদা সুতরাং লায়লাতুল কদর অর্থ সম্মানিত বা মর্যাদা মন্ডিত মহিমান্বিত রজনী। আমাদের দেশে যা শবে কদর নামে প্রচলিত। শব শব্দটি ফার্সী, আরবি লায়লাতুন শব্দের সমার্থবোধক। ইমাম যুহরীর বর্ণনা মতে কদর রজনী অন্যসব রজনীর তুলনায় অধিক সম্মানের অধিকারী এ কারণে এ রজনীকে লায়লাতুল কদর বলা হয়। (কুরতুবি ২০:১৩০)

তাফসীরে কবীরে কদরের নাম করণ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, এ রজনীতে আল্লাহ তা’য়ালা স্বীয় সম্মানিত কিতাব আল কুরআন সম্মানিত রাসূলের মাধ্যমে সম্মানিত উম্মতের জন্য অবতীর্ণ করেছেন, এ কারণে কদর শব্দটি এ সূরায় তিনবার উল্লেখ করা হয়েছে। (তাফসীরে কবীর)

তাফসীরে খাজেনে উল্লেখ হয়েছে কদর শব্দের এক অর্থ হলো সঙ্কীর্ণ হওয়া, এ অর্থের প্রেক্ষিতে বলা হয় এ রজনীতে আসমান হতে জমীনে এতো অধিকসংখ্যক ফেরেস্তা অবতীর্ণ হয় পৃথিবী সঙ্কীর্ণ হয়ে যায়। (তাফসীরে খাযেন ৪:৩৯৫)

হাদীস শরীফের আলোকে লায়লাতুল কদর :

প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত উবাদা ইবন সামিত রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লায়লাতুল কদর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন, নবীজি এরশাদ করেছেন, এটা রমজান মাসের শেষ দশকে তোমরা তালাশ করো এটা বিজোড় রাত্রিতে হবে। যেমন একুশ, তেইশ, পঁচিশ, সাতাশ ও ঊনত্রিশ রাতে। যে ব্যক্তি এ রাতের অনুসন্ধানে ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় ইবাদতে নিয়োজিত থাকে তার পূর্বের সকল গুণাহ ক্ষমা করা হবে। (মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং: ২২৭০৩)

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি লায়লাতুল কদরে ঈমানের সাথে ও সওয়াবের আশায় সালাত আদায় করবে তাঁর অতীতের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। (বুখারী শরীফ হাদীস নং ১৯০১)

হযরত আনাস ইবন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রমজান মাস প্রবেশ করলে রসূলুল্লাহ এরশাদ করলেন, নিশ্চয় এ মাস তোমাদের নিকট উপস্থিত হয়েছে আর এতে এমন এক রজনী রয়েছে যা হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। যে এটা থেকে বঞ্চিত হলো সে সকল কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো। এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করা হয় শুধু হতভাগা ব্যক্তিকে। (ইবন মাযাহ, হাদীস নং ১৬৪৪)

হাদীস শরীফে বর্ণনায় এসেছে একদা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামের সম্মূখে পূর্ববর্তী নবী হযরত আইয়ুব (.) হযরত যাকারিয়া (.) হযরত হিযকীল (.) ও হযরত ইউশা আলায়হিস সালাম প্রমূখ যারা আশি বছর করে আল্লাহর ইবাদত বন্দেগীতে মগ্ন ছিলেন। সাহাবায়ে কেরাম এ বর্ণনা শুনে ইর্ষান্বিত হলেন, তখন জিবরাইল (.) প্রিয় রাসূলের দরবারে উপস্থিত হলেন নবীজিকে সান্তনা দিলেন, বললেন আপনার প্রভূ আপনাকে তার চেয়ে উত্তম দিয়েছেন। অত:পর সূরাতুল কদর তিলাওয়াত করলেন তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনন্দিত হলেন। (তাফসীরে কুরতবি: ২০:১৩২)

আল্লাহ তা’য়ালা নবীজিকে দয়া করে আশি নয় বরং এক রজনীর ইবাদতকে ৮৩ বৎসর ৪মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ উল্লেখ করছেন।

উম্মতে মোহাম্মদীর মর্যাদা:

আল্লাহ তা’য়ালা নবীজির উম্মতদের এমন সব বৈশিষ্ট্য দান করেছেন যা পূর্ববর্তী উম্মতদের কাউকে দান করেননি, লায়লাতুল কদর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, লায়লাতুল কদরের পবিত্র রজনী আল্লাহ তা’য়ালা শুধুমাত্র আমার উম্মতকে দান করেছেন পূর্বেকার উম্মতের কারো জন্য এ মর্যাদা নসীব হয়নি। (আদ্‌দূররুল মনসুর ৬:৩৭১)

লায়লাতুল কদরের লক্ষণ:

প্রখ্যাত সাহাবী হযরত উবাই ইবনে কাব (রা.) বলেন, রমজানের শেষ দশকে ২৭ শের রজনী হল শবে কদর। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে এর লক্ষণ গুলো বলে দিয়েছেন এর একটি হল শবে কদরের পরবর্তী দিবসে সূর্য এমন ভাবে উদিত হবে সূর্যের রশ্মিতে প্রখরতা ও তেজ থাকবেনা। (মুসলিম শরীফ) এ ছাড়া আরো লক্ষণ হলো সে রাতে হালকা ধরনের বৃষ্টি হবে। রাসূলুল্লাহ এরশাদ করেছেন আমি কদরের রজনী পেয়েছি। সে রাতে পানিও কাদার মধ্যে সিজদা করেছি। (বুখারী ও মুসলিম)

উম্মতে মোহাম্মদীকে লায়লাতুল কদর দান করার তাৎপর্য:

বিখ্যাত হাদীস গ্রন্থ মুআত্তা শরীফে ইমাম মালিক (🙂 বর্ণনা করেন “প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পূর্ববর্তী নবীদের উম্মতের বয়স সম্পর্কে অবহিত হলেন, তিনি তাদের তুলনায় স্বীয় উম্মতের বয়স কম দেখতে পেয়ে মনে করলেন আমার উম্মতের লোকেরা কম বয়সের কারণে পূর্ববর্তী নবীদের উম্মতের সমান আমল কীভাবে করতে পারবে। তখন আল্লাহ তা’য়ালা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ রজনী লায়লাতুল কদরের রজনী দান করলেন। (মুআত্তা ইমাম মালেক, হাদীস নং ১৫)

আল্লাহ তা’য়ালা নবীজিকে দয়া করে আশি নয় বরং এক রজনীর ইবাদতকে ৮৩ বৎসর ৪মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ উল্লেখ করছেন।

লায়লাতুল কদর রমজানের শেষ দশকে:

হযরত আয়শা সিদ্দিকা (রা🙂 থেকে বর্ণিত, রসূলুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমরা লায়লাতুল কদরকে রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রজনী সমূহে তালাশ কর। (বুখারী শরীফ, হাদীস নং ১৯১৩)

সংখ্যা গরিষ্ট ওলামায়েকেরামের মতে সাতাশতম রজনীতে লায়লাতুল কদর।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) শবে কদর সাতাশতম রজনীতে হওয়ার পক্ষে তিনটি দলীল পেশ করেছেন

. লায়লাতুল কদর শব্দটিতে নয়টি অক্ষর আছে সূরা কদরে তা তিনবার উল্লেখ হয়েছে সুতরাং গুণফল দাড়ায় সাতাশ।

.সূরা কদরে শব্দ সংখ্যা ত্রিশ তন্মধ্যে “হিয়া” শব্দটি সাতাশতম।

.হযরত ফারুকে আজম (রা.) কদর এর নির্দিষ্টতা সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস এর নিকট জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেজোড় সংখ্যা আল্লাহ তা’য়ালার নিকট অধিক প্রিয়, বেজোড় সংখ্যা থেকে সাত সংখ্যাটি আরো বেশী প্রিয়। অত:পর সাত আসমান, সাত যমীন, সপ্তাহের সাতদিন, জাহান্নামের সাত স্তর, তাওয়াফের সাত চক্কর, সাফা মরওয়ায় সাতবার প্রদক্ষিণ, সাতবার কক্ষর নিক্ষেপ, সূরা ফাতেহায় সাত আয়াত, কুরআনের সাত কেরাত, আসহাবে কাহাফের সাতজন গুহাবাসী ইত্যাদি উল্লেখ করেছেন। (গুনীয়াতুত তালেবীন, পৃ: ২৮৭)

আল্লাহ তা’য়ালা পাঁচটি বিষয় গোপন রেখেছেন:

.ইবাদত বন্দেগীতে আল্লাহ সন্তুষ্টি গোপন রেখেছেন।

.তাঁর নাফরমানিতে তার ক্রোধ ও শাস্তি গোপন রেখেছেন।

.নামাযের মধ্য সালাতুল ওস্‌তাকে গোপন রেখেছেন।

.তাঁর সৃষ্টির মধ্যে তাঁর প্রিয় বান্দাকে গোপন রেখেছেন।

.রমজানুল মুবারকে লায়লাতুল কদর গোপন রেখেছেন।(গুনীয়াতুত তালেবীন,পৃ: ২৮৭)

লায়লাতুল কদরে চারস্থানে নূরের পতাকা উত্তোলন করেন:

সৈয়্যদুল আউলিয়া শাহেনশাহে বাগদাদ হযরত বড়পীর আবদুল কাদের জিলানী (.) প্রণীত গুনীয়াতুত তালেবীন কিতাবে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, হাদীস এরশাদ হয়েছে, আল্লাহ তা’য়ালা কদরের রজনীতে জিরবীল (🙂 কে সিদরাতুল মুনতাহার সত্তর হাজার ফেরেস্তা নিয়ে পৃথিবীতে আগমন করার নির্দেশ দেন। জিবরীল (🙂 ফেরেস্তাদের বহর নিয়ে নূরের পতাকাসহ জমীনে অবতরণ করেন। পৃথিবীর চারটি স্থানে নূরের পতাকা উত্তোলন করেন। ১. পবিত্র বায়তুল্লাহ শরীফে, . মসজিদে নববী শরীফে, . বায়তুল মুকাদ্দাসে, . তুরে সীনা মসজিদে। এরপর ফেরেস্তাগণ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েন প্রত্যেক ইবাদতরত নারীপুরুষের গৃহে প্রবেশ করেন। উম্মতের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তবে যে গৃহে কুকুর, শূকর, প্রানীর ছবি, মদ্যাপায়ী, ব্যাভীচারী, সুদখোর ব্যক্তি আছে সে গৃহে ফেরেস্তা প্রবেশ করেন না। (গুনীয়াতুত তালেবীন, পৃ: ২৮৮)

লায়লাতুল কদরের আমল:

কিয়ামুল লায়ল, কুরআন তিলাওয়াত, যিকরআযকার, প্রিয় নবীজির উপর অধিকহারে দরুদ শরীফ পাঠসালাতসালাম, পিতামাতা ও মুরব্বীদের কবর যিয়ারত, দানসাদকা ইত্যাদি এ রজনীর পূণ্যময় আমল। হযরত আয়েশা (রা.) এ রাতে কি দুআ পাঠ করবেন জিজ্ঞেস করলেন রসূলুল্লাহ এরশাদ করেছেন এ দুআ পড়বে “আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউবুন কারীম তুহিব্বুল আফওয়া ফাআফু আন্নী” অর্থাৎ হে আল্লাহ আপনি বড় ক্ষমাশীল আপনি ক্ষমা করা পছন্দ করেন অতএব আমাকে ক্ষমা করুন। (মুসনাদে আহমদ বিন হাম্বল, ,১৭১ ও ফিকহুস সুনান ওয়াল আছার, পৃ: ৪৮২)

আল্লাহ আমাদের আপনাদের সকলকে কুরআনের বরকত দান করুন। কুরআনের আয়াত ও প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ দ্বারা আমাদের নাজাত দান করুন। নিশ্চয় তিনি মহান দানশীল, সৃষ্টি জগতের মালিক পূণ্যময় অনুগ্রহশীল ও দয়ালু।

হে আল্লাহ শবে কদরের ফযীলত আমাদের নসীব করুনআমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর;

খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

মুহাম্মদ ইকরাম উদ্দিন

দোহাজারী, চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম।

প্রশ্ন: মসজিদ নির্মাণ, উন্নয়ন ও মৃতব্যক্তির কাফন দাফনে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে কিনা? জানালে কৃতার্থ হব।

উত্তর: যাকাত আদায় হওয়ার জন্য অন্যজনকে মালিক বানানো শর্ত। এ কারনে মসজিদ নির্মাণ ও উন্নয়নে যাকাতের টাকা ব্যবহার করা যাবেনা। যেহেতু এক্ষেত্রে ফকিরকে মালিক বানানো হচ্ছেনা। এভাবে মৃতব্যক্তির কাফনে দাফনে, সড়ক নির্মাণে, ব্রিজ কালভাট স্থাপন ও মাদরাসার ভবন নির্মাণে যাকাত দিলে যাকাত আদায় হবেনা। কারণ এসব ক্ষেত্রে কোনো গরীব লোককে মালিক বানানোর শর্তটি পাওয়া যায়না। তবে এক্ষেত্রে কোনো ফকিরকে যদি মালিক বানিয়ে দেয়া হয় পরে সে যদি ওসব খাতে ব্যয় করে তাহলে যাকাত আদায় হবে। এতে উভয়ে সওয়াব পাবে। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যদি শত হাতে সাদকা বদল হয় তাহলে সবাই দাতার মতো সওয়াব পাবে এবং দাতার সওয়াবে হা্রস পাবেনা। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড:৫ম, পৃ: ৪৪, রদ্দুল মোখতার, ফাতওয়া আলমগীরি, খন্ড:১ম, পৃ: ২৫০, মাজমাউল আনহুর, খন্ড:, পৃ: ৩২৭৩২৮)

পূর্ববর্তী নিবন্ধমুছে যাক সকল গ্লানি এই নববর্ষে
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে