বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস আজ চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য খাত এখনো রুগ্নপ্রায়

আজাদী প্রতিবেদন | শুক্রবার , ৭ এপ্রিল, ২০২৩ at ১০:৪৭ পূর্বাহ্ণ

স্বাধীনতা পরবর্তী ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো স্বাস্থ্যকর হয়ে উঠেনি চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য খাত। বলা চলে অন্যান্য খাতের পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতেও চট্টগ্রাম রুগ্ন প্রায়। এর কারণ হিসেবে সবকিছুর ঢাকা কেন্দ্রিকতাকে দুষছেন চট্টগ্রামের মানুষ। অবশ্য চট্টগ্রামে এখন বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।

 

যা শেষ হলে চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য খাতে অনেকটা পরিবর্তন আসবে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা। এরই মাঝে আজ (৭ এপ্রিল) পালিত হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ প্রতিপাদ্য নিয়ে সারাদেশের ন্যায় চট্টগ্রামেও বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হচ্ছে এবার। স্বাভাবিকভাবেই স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন অর্জনঅগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা এসব কর্মসূচিতে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল, তিনটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ৫০০ শয্যার একটি জেনারেল হাসপাতাল ছাড়াও বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবায় ১৪টির বেশি সরকারি বিশেষায়িত হাসপাতাল রয়েছে রাজধানী ঢাকায়। এসবের পাশাপাশি নতুন আরো স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পরিকল্পনাও নেয়া হচ্ছে রাজধানীকে ঘিরে।

কিন্তু ফৌজদারহাটের বিআইটিআইডি (বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল এন্ড ইনফেকসাস ডিজিজেস) ছাড়া সরকারি পর্যায়ে বিশেষায়িত আর কোনো হাসপাতাল অদ্যাবধি গড়ে উঠেনি বাণিজ্যিক রাজধানী তকমা পাওয়া চট্টগ্রামের ভাগ্যে। একটি মাত্র মেডিকেল কলেজ হাসপাতালই (চমেকহা) যেন ভরসা

বৃহত্তর চট্টগ্রামবাসীর। সরকারি স্বাস্থ্য সেবা খাতে ঢাকা ও চট্টগ্রামের এই চিত্রকে বৈষম্যমূলক হিসেবেই দেখছেন চট্টগ্রামবাসী। অনেকে বঞ্চনার চোখেও দেখছেন। তবে স্বাধীনতার এত বছর পরও চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য খাতে এমন ভঙ্গুর অবস্থার পিছনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনীতিকদের দুষছেন বন্দরনগরীর

বাসিন্দারা। তারা বলছেনএলাকার জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের আন্তরিকতার অভাবের কারণেই এমনটি ঘটেছে। দফায় দফায় নির্বাচিত হলেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এলাকার মানুষের জন্য এরকম কিছু চাইতে আন্তরিক নন। যার কারণে প্রায় সব খাতেই দিনের পর দিন বঞ্চনার শিকার চট্টগ্রাম। অথচ বিএনপি

ও আওয়ামী লীগের সরকারে এ পর্যন্ত মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা চট্টগ্রামের রাজনীতিকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। তবে এর কারণ হিসেবে স্থানীয় রাজনীতিক ও জনপ্রতিনিধির আন্তরিকতার অভাবের পাশাপাশি কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রীয় কাঠামোও দায়ী বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান। তিনি আজাদীকে বলেন, আমাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামো অনুযায়ী সকল কার্যক্রম রাজধানী কেন্দ্রিক।

সামান্য বেসরকারি হাসপাতালডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স নবায়ন কার্যক্রম যেখানে সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে সম্পন্ন করা যায়, সেখানে এই কাজটিও ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এসবই কেন্দ্রীভূত কাঠামোর ফল। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও কাঠামোর বিকেন্দ্রীকরণ না হলে এমন বঞ্চনা থেকেই যাবে। তবে

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনীতিকরা সরব হলে চট্টগ্রাম এমন বঞ্চনার শিকার হতো না বলে অভিমত এই প্রবীণ চিকিৎসকের। তিনি মনে করেন, এমপিমন্ত্রীদের তো এলাকার জন্য চাইতে হবে। না চাইলে পাবে কোত্থেকে। এমপি ছাড়াও চট্টগ্রামে কতজন মন্ত্রী ছিলেন ও আছেন, তারা যদি সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে চাইতেন; তাহলে চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য খাতের চিত্র এমন হতো বলে মনে হয় না। আমরা প্রকৃতই বাণিজ্যিক রাজধানী পেতাম।

অভিন্ন মত পোষণ করেছেন পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদ চট্টগ্রামের সভাপতি ডা. এ কিউ এম সিরাজুল ইসলামও। তিনি মনে করেন, অতীতের সরকারগুলোতে চট্টগ্রাম থেকে যারা মন্ত্রীএমপি ছিলেন, এলাকার উন্নয়নের লক্ষ্যে তারা ততটা সিরিয়াস বা আন্তরিক ছিলেন বলে মনে হয় না। যার কারণে চট্টগ্রামের আজ এ

হাল। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালকে পূর্ণাঙ্গ মেডিকেল কলেজে রূপান্তরে দীর্ঘ দিন ধরে আমরা দাবি জানিয়ে আসছি, কিন্তু কোনোভাবেই তা হচ্ছে না। অথচ বেসরকারি পর্যায়ে শিক্ষকছাত্র নেই, হাসপাতাল নেইরোগী নেই, এমন প্রতিষ্ঠানও হরদম মেডিকেল কলেজে রূপান্তর হচ্ছে। অবশ্য এসব ক্ষেত্রে নাগরিক আন্দোলনও যেভাবে গড়ে ওঠা প্রয়োজন, সেভাবে হয়নি বলে অভিমত এই চিকিৎসকের।

এদিকে, সরকারি পর্যায়ে বিশেষায়িত চিকিৎসা সুবিধা না থাকায় সংকটাপন্ন রোগীদের নিয়ে এখনো ঢাকায় ছুটতে হয় চট্টগ্রামের মানুষকে। বিশেষ করে আগুনে পোড়া রোগীদের বিশেষায়িত চিকিৎসা সুবিধা চট্টগ্রামে নেই বললেই চলে। এছাড়াও ক্যান্সার, হৃদরোগ, অর্থোপেডিক ও কিডনি রোগেরও বিশেষায়িত

চিকিৎসার পর্যাপ্ত সুবিধা এখনো গড়ে উঠেনি চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামে বিশেষায়িত একটি শিশু হাসপাতাল স্থাপনে প্রকল্প অনুমোদন হলেও ভূমি জটিলতায় ৪/৫ বছর ধরে সেটিও আটকে আছে। যদিও সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী প্রকল্পটির ভূমি জটিলতা কেটেছে। দুই একরের স্থলে দেড় একর জায়গায় হাসপাতালটি গড়ে তোলা হবে। শাহ আমানত ব্রিজের পার্শ্ববর্তী এলাকায় এ হাসপাতালটি হবে।

পিপিপি (পাবলিকপ্রাইভেট পার্টনারশিপ) এর আওতায় চমেক হাসপাতালের নিচ তলায় কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার গড়ে তুলেছে ভারতীয় একটি প্রতিষ্ঠান। যেখানে কিছু রোগী ডায়ালাইসিস বাবদ অল্প ফি দিলেও বাকি টাকা সরকার ভর্তুকি হিসেবে দিচ্ছে। তবে অধিকাংশ রোগীকে বেসরকারি আদলে উচ্চ ফি’র

বিনিময়ে ডায়ালাইসিস সেবা নিতে হচ্ছে এই সেন্টার থেকে। মোটকথা কিডনি রোগের বিশেষায়িত চিকিৎসার পাশাপাশি ডায়ালাইসিস সুবিধাও সরকারিভাবে সেভাবে গড়ে উঠেনি চট্টগ্রামে। নেই বিশেষায়িত কোনো ট্রমা সেন্টার। বহু বছর ধরে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালকে মেডিকেল কলেজে রূপান্তরের দাবি থাকলেও এ নিয়ে কোনো অগ্রগতি দৃশ্যমান নয়।

অবশ্য, স্বাস্থ্য খাতের বেশ কিছু প্রকল্প বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। এর মাঝে চিকিৎসাবিদ্যায় একটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় বড় পাওয়া বলে মনে করছেন চট্টগ্রামবাসী। চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় নামে অনুমোদনের পর এরইমাঝে এর কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়টির অবকাঠামো নির্মাণের কাজ এখনো শুরু হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়টির অধীনে ৮শ শয্যার একটি হাসপাতালও গড়ে তোলা হবে।

এর বাইরে চমেক হাসপাতালে ১৫ তলা বিশিষ্ট বিশেষায়িত ক্যান্সার ভবনের নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলছে। একই ভবনে হৃদরোগ ও কিডনি রোগের বিশেষায়িত চিকিৎসা সুবিধাও থাকছে। যেখানে অন্তত ৫০ শয্যার কিডনি ডায়ালাইসিস সুবিধাও যুক্ত থাকবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। পাশাপাশি চমেক হাসপাতালে ৬ তলা বিশিষ্ট আধুনিক একটি রেডিওলজি এন্ড ইমেজিং ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে।

দীর্ঘ বছর আটকে থাকার পর চীনের অর্থায়নে দেড়শ শয্যার বিশেষায়িত বার্ন ইউনিট এখন বাস্তবায়নের পথে। গত ৩০ মার্চ বিশেষায়িত এ বার্ন ইউনিট স্থাপনে চীনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক চুক্তি সই হয়েছে। চমেক হাসপাতাল সংলগ্ন গোঁয়াছি বাগান এলাকায় এক একর জায়গায় এটি গড়ে তোলা হবে।

১৩১৩ শয্যার চমেক হাসপাতাল ২২শ শয্যায় উন্নীত হয়েছে। শয্যা সম্প্রসারণের আওতায় ২০ তলা বিশিষ্ট নতুন ভবন নির্মাণের কথা রয়েছে হাসপাতাল এলাকায়। এছাড়াও অন্তত দশতলা বিশিষ্ট নতুন একটি ভবন নির্মাণে প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে। এসব প্রকল্পের কাজ শেষে

পুরোদমে সেবা চালু হলে চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য খাতের ভগ্ন দশা আর থাকবে না বলে মনে করছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা। এর বাইরে আটকে থাকা বিশেষায়িত শিশু হাসপাতাল ও বিশেষায়িত বার্ন হাসাপাতাল প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য খাতে অনেকটা পরিপূর্ণতা আসবে বলেও অভিমত সংশ্লিষ্টদের।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহেমসেন লেইন থেকে আসামি নিলয় গ্রেপ্তার
পরবর্তী নিবন্ধছাত্রলীগ নেতা জাবেদুল এক বছরের জন্য বহিষ্কার, অন্যদের আল্টিমেটাম