পর্ব–৪
মাধবদী প্রবেশ করতেই রাস্তার পাশে অসংখ্য ব্যানার আর তোরণ। সংখ্যাটা বোঝাতে অসংখ্য শব্দটা কম হয়ে যাচ্ছে! ‘সর্বগ্রাসী’ সম্ভবত কাছাকাছি শব্দ। আওয়ামী লীগের ত্রি–বার্ষিক সম্মেলন উপলক্ষ্যে লাগানো এসব তোরণ–ব্যানার–ফেস্টুন। নরসিংদী শহরের দিকে যত এগোচ্ছি, এই পাবলিসিটি স্টান্ট এর নমুনা ততই বাড়ছে। যাত্রীবাহী দ্রুতগামী বাস আর পাগলাটে ট্রাকের হাত থেকে বাঁচতে আমি সাইকেল চালাচ্ছি মূল সড়কের পাশে প্রসারিত করা ফুট দুয়েকের সরু অংশে। তোরণ মানেই সেই ফুট দুয়েক অংশে তোরণ খাড়া করার কাজে নিয়োজিত বাঁশের দখলে চলে যাওয়া। নিরাপদে সাইকেল চালানোই মুশকিল। পুরো জেলাটাকেই এরা ব্যানার–ফেস্টুনে মুড়িয়ে ফেলেছে। সাধারণের চোখে ব্যাপারটা কী পরিমাণ দৃষ্টিকটু ব্যাপারটা কেউ আমলেই নেননি। এসব রাজনীতিবিদদের বিত্ত নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু বিভবের দিক থেকে এরা বড় হতদরিদ্র।
পাঁচদোনা বাজার সংলগ্ন মহাসড়কের কাছেই মেহেরপাড়া ইউনিয়ন ভূমি অফিস। এর সাথে গায়ে গায়ে লাগানো বাড়িটি গিরিশ চন্দ্র সেনের। কোরান অনুবাদ করার জন্য মুসলিমরা তাঁকে ডাকেন ‘ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন’ নামে। অন্য অনেক ঐতিহাসিক জায়গার মতো অন্যরা এখনও এই বাড়ির ইট–সুরকি খুলে নেয়নি। বুড়ো মানুষের দাঁতের মতো নড়বড়েও হয়নি দালানের ইট। লাল রঙের বাড়িটি বহাল তবিয়তেই আছে। ঈষৎ লাল দেয়ালের বাড়িটির সবুজ জানালাগুলো মনকাড়া। ব্যালকনিটাও বেশ মনোহর। দোতলায় উঠার জন্য বাড়ির পেছনে সুন্দর একটা লোহার প্যাঁচানো সিঁড়ি আছে। এখান থেকে টানা চালিয়ে নরসিংদী শহর পেরিয়ে প্রবেশ করলাম শিবপুরে। আমি আগে ভাবতাম হিমালয়েই শুধু শিবের রাজ্য। ভারতের হিমাচল, গাড়োয়াল, কুমায়ুনের একচ্ছত্র অধিপতি শিব ঠাকুর। তাঁর প্রভাব যে এই অঞ্চলেও ছিল, এই ব–দ্বীপের নানান নামই এর প্রমাণ। শিবগঞ্জ, শিববাড়ি, শিবপুরের ছড়াছড়ি এই দেশজুড়ে। বেলাবতে পেলাম অগ্রগামী সেবা সংস্থা নামক এনজিও–র অফিস। ইংরেজিতে সংক্ষেপ করে ব্র্যাকেটে লেখা হয়েছে অঝঝ! এজন্যই সবকিছুর সংক্ষেপ ভালো নয়! বারৈচার আগে পেরোলাম আড়িয়াল খাঁ নদী। একই নামের ভিন্ন নদী গতকাল পেরিয়েছি মাদারীপুরে। রায়পুরার শেষ মাথায় পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ পেরিয়ে ঢুকলাম কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলা। ভৈরবের দুর্জয় মোড় চির ব্যস্ত। ঢাকা–সিলেট মহাসড়কে ভৈরবের যে অংশটুকু পড়েছে, তা দুইটা নদ–নদী দিয়ে বেষ্টন করা– ব্রহ্মপুত্র নদ আর মেঘনা নদী। মেঘনা নদীর উপরের শহিদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতু ছাড়াতেই দেশের সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ জেলায় পা রাখলাম! জেলার নাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া! আশুগঞ্জ ছাড়িয়ে সরাইলে। কুট্টা বিশ্বরোড থেকে বামের রাস্তা ধরেই পথচলা এবার।
সরাইলের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তার ধারেই শুয়ে থাকা পারাবত পাগলার মাজারের দেখা পেলাম। খুব সম্ভবত কবুতরপ্রেমী ছিলেন এই ভদ্রলোক। এদিকে বেশ সাবধানে চালাতে হয়। রাজপথের রাজা এনা পরিবহণের রাজত্ব পথজুড়ে। এনা দেখলেই আমি পাশের সরু অংশে সাইকেল নামিয়ে দেই। এই পথে চলতে হলে ‘এনা’দের সমীহ করতেই হবে! আরো বেশ খানিক চালিয়ে বিজয়নগরে। বিশাল সব কড়ই গাছ ঝুঁকে আছে রাস্তার উপর। চান্দুরার শ্যামলী ঘাটের টিনের হোটেলগুলোতে খাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও খুব তাড়াতাড়ি চলে আসায় হলো না সেটা। এখনো রান্নাই চড়েনি। এই দোকানগুলোর মূল খদ্দের ট্রাক চালক, প্রাইভেট গাড়ির আরোহী আর মোটরবাইকাররা। আমি বছর কতক আগে একবার এখানে টেংরা মাছ খেয়ে অভিভূত হয়ে গেছিলাম।
চান্দুরার শেষ মাথায় লোহর নদ। আরো কিছুক্ষণ চালাতেই হবিগঞ্জ আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সীমানা সোনাই নদ পেরিয়ে হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলায় প্রবেশ করলাম। বেজুড়া, সায়হাম ছাড়িয়ে শাহাজীবাজারের আগে থামলাম মায়ের দোয়া হোটেলে। খাবার হোটেলের সামনে অনেকগুলো ট্রাক দাঁড় করানো দেখেই নির্দ্বিধায় ঢুকে পড়লাম। খাবারের ব্যাপারে ট্রাক ড্রাইভারদের রুচি ভালো। এদের পছন্দের হোটেলগুলোতে খেয়ে কখনোই নিরাশ হতে হয়নি। এবারও নিরাশ হতে হলো না। সাইকেল আর আমার ঝড়ে পড়া বকের ন্যায় চেহারা দেখেই হোটেল মালিক যত্ন করে খাওয়াল। সিলিং ফ্যানের পাশাপাশি চার্জার ফ্যানের যত্ন–আত্তিও মিলল ওনার সূত্রে। শাহজীবাজারের একটু বাদে এক ছেলে সাইকেল চালাতে চালাতেই বেশ খানিকক্ষণ গল্প করল। আমি আজ ঢাকা থেকে রওনা দিয়েছি শুনে ছেলের চক্ষু চড়কগাছ। স্কয়ারের একটা উইং–এ কাজ করে। কালচে ঠোঁট ফাঁক করে হলদে দাঁত দেখিয়ে চা পান আর পান খাওয়ার দাওয়াত দিল। পান খাই না দেখে চায়ের দাওয়াত কবুল করলাম।
খানিক বাদেই প্রবেশ করলাম শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলায়। দেশের নতুনতম উপজেলাগুলোর একটি এই জনপদ প্রচন্ড ব্যস্ত। শায়েস্তাগঞ্জের আগে সুতাং নদ। আর বাজারের পরে পড়ল খোয়াই নদ। কিছুদূর এগিয়ে প্রবেশ করলাম বাহুবল উপজেলায়। মিরপুর বাজারে আমার পথ গেল বেঁকে। ডানের রাস্তা ধরলাম আমি। এই পথই নিয়ে যাবে আজকের গন্তব্য শ্রীমঙ্গলে। ওই রাস্তায় অল্প এগোতেই আকাশ ঘনকালো হয়ে এলো। জল্ভারাতুর মেঘ দিগন্তে চোখ রাঙাচ্ছে। আজ পুরোদিন রোদই ছিল। বৃষ্টিবাদল অসুবিধায় ফেলেনি। বৃষ্টির চোখরাঙানি শুরু হলো বলে! দারাগাঁও টি এস্টেট পেরোতে না পেরোতেই ঝুম বর্ষণ। বড়ো বড়ো ফোঁটায় ধোঁয়া উঠছে রাস্তার পিচ থেকে। এই বৃষ্টিতে এগোনো মুশকিল বুঝতে পেরে দারাগাঁও আর রশিদপুর টি এস্টেটের মাঝখানে থেমে গেলাম। ফিনলে কোম্পানির এই দুই বাগানের চা শ্রমিকেরাই মূলত ক্রেতা–বিক্রেতা এই বাজারের। বাজারের নাম কামাইছড়া। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে একটা চায়ের দোকানে সেঁধিয়ে গেলাম। বৃষ্টির তীব্রতা বাড়ার সাথে এবার শুরু হলো বজ্রপাত। এমন বৃষ্টি যে দোকানের মাঝামাঝিতে বসা আমিও পানির ছাঁট থেকে রেহাই পাচ্ছি না। লোকজনকে বাঁচাতে শেষে ঝাঁপ নামাতে হলো দোকানের। আমার মতো হঠাৎ নামা বৃষ্টিতে আরও অনেককেই নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছে এই দোকান। তিন কাপ চা আর ঘন্টা দেড়েক সময় নষ্ট হওয়ার পরে অবশেষে বৃষ্টি একটু কমে আসতেই আবার সাইকেলে চাপলাম। ৩ কি.মি. পথ যেতে না যেতেই আবারও বাদলের হানা। এবার আরও তেড়েফুঁড়ে। রশিদপুর গ্যাস ফিল্ডের সামনের দোকানটায় অপেক্ষা করতে হলো আরও বিশ মিনিটের মতো।
বৃষ্টি শেষ হওয়ার পর পথে নামতেই বুঝলাম এই বৃষ্টির মাহাত্ম্য! চা বাগান এমনিতেই সুন্দর। তবে বৃষ্টির ঠিক পরপর চা বাগান অনিন্দ্য সুন্দর। খর্বকায় চা গাছের সবুজাভ চাদরে মোড়ানো ঢেউখেলানো টিলাগুলো। উঁচুনিচু রাস্তায় সাইকেলে চালাতে হলে সতর্ক চোখ রাখতে হয় পথের উপর। চা বাগানের সবুজাভ পাতায় লেগে থাকা বৃষ্টির ফোঁটা তার উপর থেকেই চোখ সরাতে দিচ্ছে না। একেবারে উভয় সংকট। সংকটটাকে আরো প্রকট করতে চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য নিয়ে হাজির রবার বাগানও। চা বাগান সংলগ্ন রবার বাগানগুলোও খুবই চমৎকার। সার বাঁধা গাছের সারি কেমন ঘোর লাগায়। তবে বিপরীত রূপ চা বাগান থেকে বেরিয়ে আসা ছড়াগুলোর। তীব্র বৃষ্টির পরে ছড়ার পানি প্রচণ্ড জোরে অপেক্ষাকৃত বড় ছড়ায় গিয়ে মিশছে। পানির রং আর গতি–দুটোই ভয় পাইয়ে দেয়।