ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই বাংলাদেশ ব্যবসা সম্মেলনের আয়োজন করেছে গত রোববার। এতে বক্তারা বলেছেন, ব্যবসা–বাণিজ্যে বাংলাদেশের ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদেশি বিনিয়োগ পেতে হলে ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করতে হবে। এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া সরবরাহ ব্যবস্থায় চীনের বিকল্প হতে হলে গ্লোবাল ফ্যাক্টরি বা বৈশ্বিক কারখানার যত ধরনের সুযোগ–সুবিধা প্রয়োজন, তা নিশ্চিত করাও জরুরি। তাঁরা বলেন, বাংলাদেশের ভোক্তাশ্রেণি বিশ্বের নবম শীর্ষ। ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত ৩ কোটি ৪০ লাখে গিয়ে দাঁড়াবে। তা ছাড়া বাংলাদেশের মানুষের গড় বয়স ২৮ বছর। দেশের ৬৮ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষই কাজে নিয়োজিত। আবার বাংলাদেশের ৭৫ শতাংশ মানুষ মুঠোফোন ব্যবহার করেন। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটি ৮০ লাখের বেশি। সাড়ে ছয় লাখ ফ্রিল্যান্সার আছেন দেশে। বাংলাদেশে বিনিয়োগ করলে শ্রমিকের মজুরি পার্শ্ববর্তী দেশের তুলনায় ৪৭–৮৪ শতাংশ কম দিতে হবে। ব্যবস্থাপকদের বেতন কম দিতে হবে ৪১–৬৯ শতাংশ। এ ছাড়া বাংলাদেশে পানির খরচ ৬–৮৯ শতাংশ কম। বিদ্যুতের খরচ পার্শ্ববর্তী দেশের তুলনায় ১০–৫৫ শতাংশ সাশ্রয়ী। তাঁরা আরও বলেন, ‘ব্যবসা–বাণিজ্যের প্রসারে বাংলাদেশ সরকার চার হাজার কোটি ডলারের অবকাঠামো নির্মাণ করছে। দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থান খুবই কঠোর।’
বাংলাদেশে বিনিয়োগ খুবই সুরক্ষিত বলে মন্তব্য করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীদের রাজস্ব ও রাজস্ববহির্ভূত নীতিসহায়তা দেওয়া হয়। তা ছাড়া ব্যবসা ও বিনিয়োগকে সহায়তা দিতে বাংলাদেশ বেশ কিছু অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নির্মাণ করা হচ্ছে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল। চীন, জাপান, কোরিয়ার বিনিয়োগকারীরা ইতিমধ্যে এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগে উৎসাহ দেখিয়েছেন। ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের এই ট্রেন মিস না করতে আহ্বান জানান তিনি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) যৌথ জরিপে যে তথ্যটা আমরা সম্প্রতি পেয়েছি, সেটা হলো : দুর্নীতির কারণে ব্যবসা–বাণিজ্যের পরিবেশের উন্নতি হচ্ছে না। ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে চ্যালেঞ্জ, আমলাতন্ত্র ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি ব্যবসার পথে বাধার সৃষ্টি করেছে। এ কারণে ২০২১–২২ অর্থবছরে ব্যবসার পরিবেশের কোনো উন্নতি হয়নি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রামের ৭৪ জন জ্যেষ্ঠ ব্যবসায়ীর মতামতের ভিত্তিতে এ জরিপ পরিচালিত হয়। দৈনিক আজাদীতে গত ৩০ জানুয়ারি প্রকাশিত খবরে বলা হয়, বিগত বছরগুলোর মতো ২০২২ সালেও দুর্নীতি ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। অবকাঠামোগত দুর্বলতা, ব্যাংক থেকে ঋণ প্রাপ্তির চ্যালেঞ্জ, দুর্বল আমলাতন্ত্র, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ উদ্ভূত মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার উত্থানপতন ও নীতিগত সমস্যা ব্যবসায়ের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ২০২১–২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশের অগ্রগতির পথে নতুন নতুন সমস্যা সামনে চলে আসার কারণে দুর্নীতির তীব্রতা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। এমন তথ্যও উঠে আসে জরিপে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়ার মতো প্রতিযোগী দেশগুলো অধিক হারে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারছে। কারণ দেশগুলোর ব্যবসায় পরিবেশ বাংলাদেশের চেয়ে ভালো। এমন বাস্তবতায় আমাদের দেশের ব্যবসায় পরিবেশে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জনের কোনো বিকল্প নেই। ব্যবসায় প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নির্ধারণ করে নীতি, কৌশল ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় সংস্কার; স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দক্ষতার মাধ্যমে বেসরকারি বিনিয়োগ নিশ্চিত; নাগরিক ও ব্যবসায়িক সেবা প্রদান; ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা বিধান; আর্থিক খাতে সংস্কার আনতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমরা মনে করি, দেশে শিল্পায়ন ও দেশীয় শিল্পের বিকাশে সরকারের উচিত ব্যবসা সমপ্রসারণের পথে প্রতিবন্ধকতাগুলোর দিকে অবিলম্বে দৃষ্টি দেওয়া। শিল্পায়ন ঘটলে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। দৃঢ় হবে দেশের অর্থনীতির ভিত। ব্যবসা–বাণিজ্যের পরিবেশ উন্নত হলে উন্নয়নশীল এবং পরবর্তী ধাপে উন্নত দেশ হিসাবে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার পথটিও মসৃণ হবে, সন্দেহ নেই। আমরা আশা করব, এ ক্ষেত্রে সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা দূর করা হবে। সরকারের জন্য এটি একটি চ্যালেঞ্জও বটে। দেশে ব্যবসায় পরিবেশ উন্নত করতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার জরুরি।