ইউক্রেন–রাশিয়ার অসম যুদ্ধের শেষ কোথায়?
ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার চাপিয়ে দেয়া অসম যুদ্ধের এক বছর হলো চলতি সপ্তাহে। এই যুদ্ধ কখন থামবে তার কোন লক্ষণ এখনো পর্যন্ত দৃষ্টিগোচর নয়। আগামী দিনগুলিতে দেখা যাবে তেমন সম্ভাবনা একেবারে নেই বললেই চলে। কেননা দু–পক্ষের মধ্যে যে যুদ্ধংদেহী মনোভাব তাতে কোন শিথিলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। না রাশিয়া না ইউক্রেন– কেউ বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি নয়। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির ছাড় দেবার কথা না। কেননা উনি তো রাশিয়া দখল করতে যাননি। ছাড় দেয়া উচিত রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের। কেননা তিনি এসেছেন গায়ের জোরে পরদেশ, স্বাধীন দেশ দখল করার জন্যে। এখন যদিও বা তার (পুতিন) দশা অনেকটা ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’র মত, কিন্তু তিনি চাইলেও ছাড়তেও পারছেন না। তাতে যে তার ‘আয়রন ম্যান’ ইমেজ একেবারে রসাতলে যাবে, নিজ পাবলিকের কাছে তো আর মুখরক্ষা হবে না। অতএব মরুক নিজ সেনা, মরুক সবাই, হোক দেশ ধ্বংস, ‘সামনে যাই থাকুক ট্রেন চলবে’, চলবে যুদ্ধ, চলছে যুদ্ধ। গেল বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পুতিন উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ দিক থেকে ইউক্রেন আক্রমণ শুরু করেন। ‘মেসাইয়া’ (ত্রাণকর্তা) রূপ ধারণ করে তিনি বলেন, ‘ইউক্রেনের ন্যাটো–সামরিকজোটের সদস্যপদ রোধ করা, দেশটিকে অসামরিকীকরণ এবং নাৎসীদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে এই অভিযান’। পুতিনের এই অজুহাত ‘কল্পনাপ্রসূত’ ও ‘অবাস্তব’ বলে উড়িয়ে দিয়ে ইউক্রেন ও যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা শক্তি পাল্টা যুক্তি দেন এই বলে, ‘কিয়েভে রয়েছে একটি সরকার যা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত এবং খোদ রাষ্ট্র প্রধান ভ্লাদিমির জেলেনস্কি নিজেই একজন ইহুদি। তার নিকটজনেরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ‘হলোকাস্টে’ নিহত হয়েছিলেন’। প্রেসিডেন্ট পুতিন ধরেই নিয়েছিলেন দিন কয়েকের মধ্যে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সরকার উৎখাত করে সেখানে ‘তাঁবেদার’ সরকার গঠন করবেন এবং যেভাবে গায়ের জোরে ক্রিমিয়া দখল করেছিলেন ঠিক সেভাবে কিয়েভও নিজ দখলে নিয়ে পররাজ্য দখলের ‘খেল‘ চালাবেন। কিন্তু তার অংকে যে ভুল ছিল সে তিনি বুঝলেন যখন রুশ সৈন্যরা ইউক্রেনের উত্তর–পূর্বে ইউক্রেন সেনাবাহিনীর কঠোর প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়। দেখা গেল জলপাই রঙের সাধারণ সৈনিকের পোশাকে ইউক্রেনের তরুণ প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি তার সদর দফতরের বাইরে একটি ভিডিও রেকর্ড করছেন। তাতে দেখা যায় তিনি বহাল তবিয়তে আছেন এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতায় রয়েছেন। ইতিমধ্যে যুদ্ধের ৩৬৫ দিন গড়িয়েছে। এরপর গোটা বিশ্ব দেখেছে ইউক্রেনে রাশিয়ার স্থল, সমুদ্র, আকাশ থেকে বৃষ্টির মত বোমা বর্ষণ, নিরীহ নাগরিক হত্যা, ধর্ষণ, গুম এবং হত্যার মত ঘটনা। দিন যত গেছে তত বেড়েছে নিহতের সংখ্যা, দু–পক্ষেরই। কোন পক্ষই এখনো তক হতাহতের কোনো পরিসংখ্যান প্রকাশ করেনি। তবে যুদ্ধ বিশ্লেষকদের মতে, এই পর্যন্ত প্রায় দুই লক্ষ রুশ সেনা নিহত বা আহত হয়েছে, অন্যদিকে ইউক্রেনের দিকে এই সংখ্যার পরিমাণ এক লক্ষ। রুশ আগ্রাসনে প্রায় ৩০ হাজার ইউক্রেন নাগরিকের মৃত্যুর হয়েছে বলে অনুমান করা হয়। রাশিয়ার আক্রমণে ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরের ঘরবাড়ি, দোকান পাঠ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিশুদের ডে–কেয়ার সেন্টার, থিয়েটার হল, এমন কী হাসপাতাল মাটির সাথে মিশে গেছে। ইউক্রেনবাসী দেশত্যাগী হতে বাধ্য হয়েছেন। অনেককে রাশিয়ায় নিয়ে গেছে রুশ বাহিনী। বলা হচ্ছে নিরাপদ স্থানে, যদিও অনেকের দাবি তাদেরকে তাদের মতের বিরুদ্ধে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ইউক্রেনে হত্যা, লুন্ঠন, অত্যাচার, ধর্ষণ ও গণহত্যার মত অনেক ঘটনা ঘটেছে বলে ইউক্রেন সরকার, মার্কিন সরকার সহ পশ্চিমী শক্তিগুলি দাবি করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউক্রেন–যুদ্ধকে সব চাইতে বড় সামরিক–যুদ্ধ বলে ধরা হচ্ছে। এই যখন যুদ্ধ–মাঠের পরিস্থিতি তখন পুতিন ও জেলেনস্কি– এই দুজনের কারো দিক থেকে এই সামরিক সংঘাত কমানো বা পরিত্যাগ করার কোন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে প্রতীয়মান নয়।
অন্যদিকে এমন যখন টানটান উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তখন কোন আগাম–জানান না দিয়ে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ সফর করলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। যদিও বা অনেক দিন থেকে এমন একটি সফর যে হতে পারে সেই ব্যাপারে কানাঘুষা চলছিল। বাইডেনের কাছের হাতেগোনা কয়েক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছাড়া অন্য কেউ তার এই সফরের ব্যাপারে আগেভাগে কিছু জানতেন না। চরম গোপনীয়তা রক্ষা করা হয় এই সফরকে ঘিরে। শনিবার প্রেসিডেন্ট বাইডেন ওয়াশিংটন ডিসিতে তার স্ত্রীর সাথে ডিনার সারেন, পরবর্তীতে রাতের আঁধারে এয়ার ফোর্স ওয়ানে চড়ে যাত্রা শুরু করেন। পোল্যান্ড বোডের্র থেকে তিনি ১০ ঘন্টা ট্রেন জার্নি শেষে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ পৌঁছান। হোয়াইট হাউসের পাবলিক সিডিউলে দেখানো হয়েছিল বাইডেন সোমবার পর্যন্ত ওয়াশিংটন থাকবেন, যেখান থেকে তিনি পোল্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন। কানাঘুষা চলছিল যে তিনি পোল্যাড বর্ডার কিংবা ইউক্রেনের পশ্চিম নগরী লাভিভে ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সাথে দেখা করবেন। তার সাথে ছিল জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান এবং দুই রিপোর্টার, ছোট্ট একটি টিম। সফর শেষে তিনি পোল্যান্ড এক বিশাল সমাবেশে ভাষণ দেন। তাতে তিনি ইউক্রেনের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ সমর্থনের আশ্বাস পুনর্ব্যক্ত করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই সফরকে নানা ভাবে দেখা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন এমন সময় ইউক্রেন সফর করলেন যখন এই যুদ্ধ প্রায় এক বছরে পা দিলো। পেন্টাগন ও সিক্রেট সার্ভিস কেউ চায়নি ঝুঁকি নিয়ে বাইডেন ইউক্রেন সফর করুক। কেননা সেখানে মার্কিন সেনাবাহিনীর কোন ঘাঁটি নেই, সে দেশের আকাশের উপরও তাদের কোন দখল নেই। অসম্ভব কোন কিছুর সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেবার জন্যে অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাইডেনের এই সফরের ঘন্টা কয়েক আগে মস্কোকে এই ব্যাপারে জানিয়ে দিয়েছিল। তারপরও দেখা যায় বাইডেন ও জেলেনস্কি যখন সেন্ট মাইকেলস ক্যাথেড্রাল থেকে বেরিয়ে আসছেন তখন ‘সাইরেন’ বেজে উঠে। প্রশ্ন – তারপরও এই ঝুঁকি নেয়া কেন? এই ঝুঁকিপূর্ণ–সফরের মধ্যে দিয়ে বাইডেন সরকার জেলেনস্কি ও বিশ্বকে জানিয়ে দিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের পাশে আছে এবং থাকবে। এর আগে সোমবার প্রেসিডেন্ট বাইডেন এই বলে ঘোষণা দেন যে, ‘তার সফরের লক্ষ্য হলো ইউক্রেনের গণতন্ত্র, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখন্ডতার প্রতি আমাদের অটল সমর্থন ও প্রতিশ্রুতি পুনর্নিশ্চিত করা’। পাশাপাশি তিনি রুশ জনগণকে লক্ষ্য করে বলেন, তাদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউরোপের কোন বিরোধ নেই। তাদের বিরোধ পুতিনের এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে।
বাইডেনের এই সফরকে বিশ্ব নেতারা কী ভাবে দেখছেন। এই সফরের পর জাপানি প্রধানমন্ত্রী ইউক্রেনকে আরো ৫.৫ বিলিয়ন ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। জার্মান সরকারের এক মুখপাত্র সফরের প্রশংসা করে বলেন, ‘গুড সিগন্যাল’। এর বাইরে তিনি আর কোন মন্তব্য করেননি। তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, যুদ্ধ উস্কে দিতে পারে তেমন কোন সামগ্রী তুরস্ক রাশিয়াকে দেবেনা। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে ইউক্রেনের কাছে কেমিক্যাল, মাইক্রোচিপস বিক্রীর ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছিল। অন্যদিকে চীন এই সফরকে খুব একটা সহজভাবে নিতে পারেনি। তারা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ও ইউরোপের এমন কিছু করা উচিত নয় যাতে পরিস্থিতি আরো ভয়ানক রূপ ধারণ করতে পারে। চীন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েবিন বলেন, ‘চীন নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্র নিয়মিতভাবে ইউক্রেনের কাছে অস্ত্র সরবরাহ করছে’। তিনি অন্যকে দোষারোপ না করে ও গুজব না ছড়িয়ে ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রকে আহবান জানান। অভিযোগ উঠেছিল যে চীন রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহ করতে যাচ্ছে। সেই প্রসঙ্গে চীন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের এই মন্তব্য। স্বাভাবিক কারণে, প্রেসিডেন্ট পুতিন বাইডেনের এই সফরকে মেনে নিতে পারেননি এবং তিনি বলেন, বাইডেনের ইউক্রেন উপস্থিতি এটাই প্রমাণ করে যে এই যুদ্ধ হচ্ছে রাশিয়া ও পশ্চিমা শক্তির সাথে, এটি ইউক্রেন–রাশিয়ার যুদ্ধ নয়। অবশ্য পুতিন এটিকে ‘যুদ্ধ’ বলতে প্রস্তুত নন। তিনি এই যুদ্ধকে বলেন, ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’। ইতিমধ্যে বাইডেন ইউক্রেনকে আরো ৫০০ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন। তবে ইউক্রেনের দীর্ঘদিনের দাবি– এফ–১৬ যুদ্ধ বিমান– এখনো পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলি দিতে অস্বীকার করে আসছে। ইউরোপীয় অংশীদাররা অবশ্য ন্যাটোর যুদ্ধবিমান পাঠানোর বিষয় বিবেচনা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। সব শেষে এটাই বলি, যুদ্ধ কোন সময় কোন মঙ্গল বয়ে আনতে পারেনা। আমরা চাই এই যুদ্ধ থামুক। শুভ বুদ্ধির উদয় হোক পুতিনের। শুভবুদ্ধির উদয় হোক সবার মাঝে।
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট