এবার বইয়ের দাম বেশি। এমন অভিযোগ পাঠকের। এরপরও খালি হাতে ফিরছেন না তারা। হাতে হাতে শোভা পাচ্ছে নতুন বইয়ের প্যাকেট। কাব্য, গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনী কিংবা প্রবন্ধ। পছন্দ হলেই কিনছেন। এ যেন কালো কালির প্রেম ভুলিয়ে দিচ্ছে বাড়তি দামের চাপ। এ প্রেম চোখে পড়ে নগরের এম এ আজিজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন জিমনেশিয়াম মাঠে, অমর একুশে বইমেলায়।
দশম শ্রেণি পড়ুয়া ছেলেকে নিয়ে সাতকানিয়া থেকে বইমেলায় এসেছেন সাইফুল আলম। কিসের বই কিনেছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে বললেন, বইয়ের যা দাম, হিসেব করে কিনতে হচ্ছে। এরপরও বাছাই করে নিজের জন্য তিনটা প্রবন্ধগ্রন্থ এবং ছেলের পছন্দের কয়েকটি কিশোর গল্পগ্রন্থ ও সায়েন্স ফিকশনের বই কিনলাম। গতকাল শুক্রবার ছিল মেলার তৃতীয় দিন।
ছুটির দিন হওয়ায় পাঠক, লেখক এবং দর্শনার্থীর উপস্থিতি ছিল প্রথম দুইদিনের চেয়ে বেশি। অন্যদিন বিকেলে উন্মুক্ত হলেও গতকাল মেলার দরজা খুলে সকাল ১০টায়। সকালে উপস্থিতি কম থাকলেও বিকেল হতেই বৃদ্ধি পায় পাঠক, লেখক ও দর্শনার্থীর সংখ্যা।
সন্ধ্যার পর উপচেপড়া ভিড়ে হাঁটাও ছিল কঠিন। মেলায় কথা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. জাপান বড়ুয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রচুর মানুষ দেখছি, কিন্তু খুব কম সংখ্যক লোকের হাতে বই দেখছি। তার মানে যারা আসছেন সবাই পাঠক নন।
আবার এমনও হতে পারে, বইয়ের দাম বেড়ে যাওয়ায় ইচ্ছে থাকলেও সবাই কিনতে পারছেন না। এর মধ্যেও ইতিবাচক দিক হচ্ছে, ঘুরতে ঘুরতে পছন্দ হলে কেউ একটা বই কিনবেন। বাসায় নিয়ে গেলে সেটা অন্যরাও পড়বেন। এতে বইয়ের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হবে।
বইয়ের দাম বেশি অভিযোগের সত্যতা মিলেছে অ্যাডার্ন পাবলিকেশন এর বিক্রয়কর্মী সৈয়দ মাহমুদুল হাসানের কথায়। তিনি বলেন, প্রচুর মানুষ আসছে। কিন্তু বিকিকিনি নাই। দৈনিক খরচের টাকাও উঠেনি। বইয়ের দাম বেশি।
গতবার কমিশন দিয়ে ২০০ টাকায় যে বই বিক্রি হয়েছে এবার তা ২৭০ টাকা লাগছে। খড়িমাটির মনিরুল মনির বলেন, কাগজের দাম বেশি। অন্যান্য উপকরণের খরচও বেড়েছে। তাই বইয়ের দামও বেশি রাখতে হচ্ছে। এরপরও বিক্রি ভালই হচ্ছে। ঢাকা বইমেলার স্টলের চেয়ে এখানে ভালো হচ্ছে।
এদিকে মেলায় আসা নতুন বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে– নির্ঝর নৈঃশব্দের ‘আরজ আলী আলো–আঁধারির পরিব্রাজক’, শৈবাল চৌধুরীর ‘সৌমিত্র চট্টপাধ্যায় বঙ্গসংস্কৃতর অগ্নিপুরুষ’ এবং আবু মোশাররফ রাসেল এর ‘মায়াভবন’। এছাড়া আখতারুল ইসলাম এর কিশোর কবিতা ‘আজ সারাদিন ছুটি আমার’ পাঠকের আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল।
এবার প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে আকাশ ইকবালের গবেষণাগ্রন্থ ‘কিংবদন্তি মৌলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী’। গ্রন্থটির ভূমিকায় লেখা হয়, ‘চট্টগ্রামের ইতিহাসে বহু খ্যাতনামা ব্যক্তি রয়েছেন, যাঁরা কেবলমাত্র বাংলাদেশের ইতিহাসেরই বরেণ্য ব্যক্তি নন, পুরো উপমহাদেশের সমাজজীবন ও রাজনীতিতে দ্যুতি ছড়িয়েছেন। এঁদের মধ্যে মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী অন্যতম।
‘কিংবদন্তি মৌলানা মনিরুজ্জামান ইসলামবাাদী’ গ্রন্থে ইসলামাবাদীর অসাধারণ চারিত্রিক অবয়বকে যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে, তা মৌলানা ইসলামাবাদী সম্পর্কে যথার্থই একটি অমূল্য গবেষণা গ্রন্থ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ জাভেদ হোসেনের কাব্যগ্রন্থ ‘ছায়াবাজি প্রেম’ নিয়েও ছিল পাঠকের আগ্রহ। গ্রন্থের ফ্ল্যাপে লেখা হয়, ‘গোধূলি সন্ধ্যেবেলা/ হৃদয় পোড়ানো ঘ্রাণে/ চারুলতা হেম/ আবছা আলোয় দেখা/ ঝাঁপসা প্রথম তুমি/ ছায়বাজি প্রেম’।
এদিকে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রকাশিত কেশব জিপসীর একশ লাইনের দীর্ঘ কবিতার বই ‘বাঙালি ধ্রবতারা’ও বেশ সাড়া জাগিয়েছে। শিশু–কিশোর উপযোগী এ গ্রন্থে ‘বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবন, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর আপোষহীন নেতৃত্ব এবং স্বাধীনতা পরবর্তী পঁচাত্তরের নির্মম হত্যাকাণ্ডের কাহিনী ছন্দবন্ধ উপস্থাপন করেছেন কেশব জিপসী।
প্রসঙ্গত, মেলার আয়োজক চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। তবে চট্টগ্রামের সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদ, নাগরিক সমাজ, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাহিত্যিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী এবং অন্যান্য শিল্প–সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতরাই সম্মিলিতভাবে এ মেলা বাস্তবায়ন করবেন। সম্মিলিত উদ্যোগে এবারের মেলাটি চতুর্থ আয়োজন। মেলা প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা ও ছুটির দিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকে।
মেলায় ১০৮ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ১৪০টি স্টল রয়েছে। এর মধ্যে ডাবল স্টল ৩২টি এবং সিঙ্গেল স্টল ৭৬টি। মেলা প্রাঙ্গণের আয়তন এক লক্ষ দুই হাজার ৩০০ বর্গফুট।
আজ পেশাজীবী সমাবেশ : আজ শনিবার বইমেলা মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে পেশাজীবী সমাবেশ। পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের সহযোগিতায় আয়োজিত এ সমাবেশের আলোচ্য বিষয় ‘একুশের চেতনায় পেশাজীবীদের ভূমিকা’।
এতে প্রধান অতিথি থাকবেন একুশে পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক। প্রফেসর ড. একিউএম সিরাজুল ইসলামের সভাপতিত্বে প্রধান বক্তা থাকবেন পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রিয়াজ হায়দার চৌধুরী। চসিকের পক্ষে সমাবেশে অংশ নিবেন ৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোরশেদুল আলম।