জাইকাকে মাতামুহুরী গতিপথও শাসন করতে হবে
গত ২২ ও ২৮ জানুয়ারী দৈনিক আজাদীতে মাতামুহুরী নদী শাসন করা নিয়ে রিপোর্ট আমার দৃষ্টিতে আসে। দৈনিক আজাদীর চকরিয়া প্রতিনিধি রিপোর্ট দু’টি করেছেন। ‘নিজেদের খরচে মাতামুহুরী শাসন করতে চায় জাইকা’ শিরোনামে রিপোর্টে দীর্ঘ বর্ণনায় মাতামুহুরী নদী শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে যাওয়া, বর্ষাকালে প্লাবনসহ নানা বিষয় উল্লেখ করেছেন এ প্রতিনিধি।
এতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সংযোজন করে আগামীতে রিপোর্ট করার জন্য সুপারিশ রাখছি। আর তা হল– মাতামুহুরী নদী নিচের দিকে এসে বদরখালী–উজানটিয়ার মধ্য দিয়ে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত। এ নদী দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে মহেশখালী–বদরখালীর মধ্য দিয়ে কক্সবাজার শহর সংলগ্ন বাঁকখালী নদীর মোহনায় বঙ্গোপসাগরে পতিত।
কিন্তু শত হাজার বছরের এ নদী বিগত ২০/৩০ বছরের ব্যবধানে পর্যায়ক্রমে পশ্চিমে তথা নিচের দিকে এসে অনেকটা উজানটিয়া খাল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুতুবদিয়া চ্যানেলে পতিত হচ্ছে। এতে পর্যায়ক্রমে কুতুবদিয়া চ্যানেলের গভীরতায় বিরূপ প্রভাব ফেলার সমূহ সম্ভাবনা। ফলে মাতারবাড়ী বহুমুখী মেগা প্রকল্প ও বিশাল এরিয়া নিয়ে মগনামা নৌবাহিনী ঘাঁটি কুতুবদিয়া চ্যানেলে পানির গভীরতাজনিত কারণে হুমকির সম্মুখীন হতে পারে।
ব্রিটিশ পাকিস্তান আমল ত বটেই বাংলাদেশ আমলের প্রথম দিকেও চট্টগ্রাম থেকে বড় বড় যাত্রীবাহী স্টিমার মাতারবাড়ীর উত্তর পূর্ব দিক দিয়ে এসে মহেশখালী–বদরখালীর মধ্য দিয়ে মাতামুহুরী নদী হয়ে কক্সবাজার যাতায়াত করত।
কিন্তু দুঃখের বিষয় ২০/৩০ বছরের ব্যবধানে উজানটিয়ার পূর্বপাশে বদরখালী পশ্চিম সংলগ্ন মাতামুহুরী নদীতে চর জমতে শুরু করে। এতে পর্যায়ক্রমে নদী পথ পরিবর্তন হয়ে উজানটিয়া খাল দিয়ে মাতারবাড়ীর উত্তর দিকে বঙ্গোপসাগরে পতিত হচ্ছে। বিগত ৫/৭ বছর থেকে বর্ষাকালে পাহাড় পর্বতের পলি মাটি সমেত প্রবল স্রোত উজানটিয়া খালের দুদিকে ভেঙ্গে কুতুবদিয়া চ্যানেলে পতিত হতেই আছে।
মানুষ নিজেদের স্বার্থে পাহাড়–পর্বতকে যেনতেন ব্যবহার করছে। ফলে বর্ষাকালে বৃষ্টির সাথে পলি মাটি এসে উজানটিয়া খাল দিয়ে কুতুবদিয়া চ্যানেলে পড়ছে। এতে কুতুবদিয়া চ্যানেলের গভীরতা কমে গেলে মাতারবাড়ী বহুবিধ মেগা প্রকল্প এবং মগনামা নৌবাহিনীর ঘাঁটি হুমকির সম্মুখীন হবে। সারা দেশের মধ্যে কুতুবদিয়া চ্যানেলটি অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ এরিয়া। এ চ্যানেলে রয়েছে গভীরতা। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সাগরে গভীরতা অনেকটা কম। কর্ণফুলী নদীর গভীরতাও আগের মত নেই। অতএব মাতারবাড়ী কেন্দ্রীক কুতুবদিয়া চ্যানেল দেশের কল্যাণে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ এরিয়া।
পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ যথাযথ কর্তৃপক্ষের উচিত হবে জাইকার মাধ্যমে মাতামুহুরী নদী শাসন করতে গিয়ে মহেশখালী–বদরখালীর মধ্যখান দিয়ে শত হাজার বছর যাবৎ প্রবাহিত মাতামুহুরী নদী যাতে প্রবাহিত থাকে। সেই লক্ষ্যে উজানটিয়া পূর্বপাশে বদরখালী সংলগ্ন চরটি অপসারণ করতে হবে।
তা করা হলে মাতামুহুরী নদীর গতিপথ ঠিক থাকবে, উজানটিয়া খালের দুই কূল ভাঙ্গন থেকে রক্ষা হবে। কুতুবদিয়া চ্যানেলের গভীরতা অটুট থাকবে। এতে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দরসহ বহুমুখী মেগা প্রকল্প এবং বিশাল এরিয়া নিয়ে মগনামা নৌবাহিনীর ঘাঁটি পানিতে গভীরতাজনিত হুমকি থেকে রক্ষা পাবে।
উজানটিয়া খালের পক্ষে মাতামুহুরী নদীর পানির ধারণ ক্ষমতা চার ভাগের এক ভাগও নাই। ফলে গত কয়েক বছরের ব্যবধানে বর্ষাকালে পানির স্রোতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেঁড়িবাধ ভেঙ্গে তছনছ হয়ে যাচ্ছে।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলে নোয়াখালী, ভোলাসহ বৃহত্তর বরিশাল, বৃহত্তর খুলনার দক্ষিণে প্রায় ১ শত কি.মি বা তার অধিক এরিয়ার সাগরে গভীরতা কমে গেছে। ফলে স্বভাবতই কক্সবাজার জেলার মগনামা উজানটিয়া মাদারবাড়ী এরিয়াকে অত্যধিক গুরুত্ব দিতে হচ্ছে। যেহেতু এখানে কুতুবদিয়া চ্যানেলে পানির গভীরতা রয়েছে। অপরদিকে মূল ভূমি থেকে প্রায় ৪/৫ কি.মি ব্যবধানে কুতুবদিয়া দ্বীপ। মাতারবাড়ী বহুমুখী প্রকল্প, মগনামা নৌবাহিনীর ঘাঁটি এসব কিছুর কল্যাণে কুতুবদিয়া দ্বীপকে নিরাপত্তা দেয়াল বলা যেতে পারে। এদিকে কঙবাজার নদী বন্দর ১৫/২০ বা তারও আগ থেকে পলি ভরাট হয়ে অনেকটা গুরুত্ব হারাচ্ছে।
২৬.৪৩ বর্গ কি.মি এরিয়া নিয়ে মাতারবাড়ী দ্বীপ। মাতারবাড়ী ও ধলঘাট দু’টি ইউনিয়ন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ দ্বীপটি মহেশখালী উপজেলার আওতাধীন। এখানে হাজার হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান। রয়েছে দেশী বিদেশী অসংখ্য কর্মকর্তা–কর্মচারী। মাতারবাড়ীকে কেন্দ্র করে গভীর সমুদ্র বন্দরের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে মগনামাতে প্রায় ৭ শত একর এরিয়া নিয়ে নৌবাহিনীর বিশাল ঘাঁটির কাজ এগিয়ে চলছে। এমন পরিস্থিতিতে বর্ষাকালে পলি মিশ্রিত মাতামুহুরী নদীর প্রবল স্রোত গতিপথ পরিবর্তন হয়ে উজানটিয়ার খাল দিয়ে কুতুবদিয়া চ্যানেলে পড়তে থাকলে স্বভাবতই গুরুত্বপূর্ণ এ কুতুবদিয়া চ্যানেলের গভীরতা কমে আসতে পারে।
দেশের মধ্যে বৃহত্তর চকরিয়া (পেকুয়া উপজেলা সহ) অন্যতম সমৃদ্ধ এরিয়া। বান্দরবান পাহাড়–পর্বত থেকে উপজেলার মধ্যভাগ দিয়ে মাতামুহুরী নদী প্রবাহিত। মাতামুহুরী নদী পাহাড়–পর্বত থেকে বাঁশ, কাঠ আহরণ পরিবহনে সহায়ক। মধ্যখানে শুষ্ক মৌসুমে ব্যুরো চাষে, বর্ষাকালে অনাবৃষ্টি আসন চাষে অবদান রেখে আসছে এ নদী। এই নদী পশ্চিমে তথা নিচের দিকে এসে সাগরের লোনা পানির সহায়তায় মাছ ও লবণ চাষে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে আসছে। জনকল্যাণে দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী। আজাদীর রিপোর্টে জানতে পারি, জাইকা স্বউদ্যোগে মাতামুহুরী নদী শাসন করতে চাচ্ছে। যাতে বৃহত্তর চকরিয়াবাসীর কল্যাণ হয়। কিন্তু এখানে পশ্চিম দিকে এসে নদীর গতিপথ সাবেক নিয়মে ঠিক রাখতে শাসন করা না হলে জাইকার এ অবদান পূর্ণ্যতা পাবে না।
ঔধঢ়ধহ ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঈড়ড়ঢ়বৎধঃরড়হ অমবহপু জাইকা আমাদের বাংলাদেশে বিভিন্নখাতে উন্নয়নে অবদান রেখে আসছে। জাপান আমাদের অন্যতম বন্ধু প্রতীম দেশ। পাহাড়–পর্বত থেকে বর্ষাকালে মাতামুহুরী নদী প্রবাহিত হয়ে এসে চকরিয়ার দুই কুলে ভাঙ্গছে। যেহেতু পানির সাথে পলি এসে নদীর গভীরতা কমে গেছে। জাইকার সহায়তায় চকরিয়া অংশে মাতামুহুরী নদী খনন করা হউক, দুই পাড়ে, মজবুত বাঁধ দেয়া হউক। এসব কিছু হবে চকরিয়ার হয়ত কয়েক লাখ জনগণের কল্যাণে। কিন্তু বর্ষাকালে মাতামুহুরী নদী পশ্চিমে নিচের দিকে ভিন্নরূপ ক্ষতির প্রভাব ফেলছে। আর তা হল উজানটিয়া–করিয়ার দিয়া বেঁড়িবাধ ভেঙ্গে তছনছ করে কুতুবদিয়া চ্যানেলের গভীরতায় প্রভাব ফেলছে এবং এই ক্ষতি জাতীয় স্বার্থের উপর আঘাত করবে।
আগেই উল্লেখ করেছি, অনেক যাচাই বাছাই এর পর মাতারবাড়ী দ্বীপকে বেছে নেয়া হয়েছে দেশের মেগাপ্রকল্পগুলোর জন্য। আরও হচ্ছে এখানে গভীর সমুদ্র বন্দর। এর মাত্র ২ কি.মি উত্তরে কুতুবদিয়া চ্যানেলকে সামনে রেখে প্রায় ৭ শত একর এরিয়া নিয়ে নৌবাহিনীর ঘাঁটির কাজ চলমান।
কাজেই জাইকা মাতামুহুরী নদী শাসন করতে পশ্চিমে নিচের দিকে এসে গতিপথ আগের মত ঠিক রাখতে অতীব গুরুত্ব দিতে হবে। অতএব বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ড ও যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অনুধাবন করতে হবে। জাইকাকে মাতামুহুরী নদী শাসনে গতিপথ বিষয়েও অন্তর্ভুক্ত করাতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট